মায়া

মা–হারা নাতনির কোমল স্পর্শে যেন শূন্য হৃদয়টা ভরে ওঠে। তাই তো গোসল করানোর এক ফাঁকে খুনসুটিতে এভাবেই মেতে ওঠেন রুপালি বর্মন আর তাঁর নাতনি প্রিয়ন্তী বর্মন। মা হারানোর পর প্রিয়ন্তীর সব দায়িত্ব পালন করে আসছেন দাদি
ছবি: লেখক

এই তিন কুলে আমার আর কেউ নাই। মা, ভাই-বোইন কেউ নাই। বাপের দেশ জোড়দীঘি, বিয়া হইছে সন্তোষপুর জঙ্গলে, হায় রে জঙ্গল আর জঙ্গল—আমরা ৬০-৭০ ঘর বর্মনরা এই জঙ্গলে বাস করতাম। জঙ্গলের জমিনে চাষ করি, লাকড়ি খুঁটি, ভালাই চলতাছিল। তারপর তো দেশে শুরু হইল মুক্তিযুদ্ধ। পাঞ্জাবিরা আমগো গেরামের হিন্দু বাড়িতে আগুন দিল কতবার, কত মায়–ঝিয়েরে ধইরা লইয়া গেল, মাইরা ফালাইলো। আমরা পলায়া পলায়া থাকছি। ওই সময় এই গেরামের মেলা হিন্দু বর্মনরা চইলা গেল গা ভারত। আমার স্বামী গিরিন বর্মন আর গেল না, হে কইলো বাপ-দাদার দেশ থুইয়া কই যামু মাগি, আর গেল না। একে একে তিনটা পোলা হইয়া মইরা গেল, ভগবানের কাছে কত মানত করলাম, শেষে একটা পোলা রাইখা গেল ভগবান। পোলাডার বয়স যখন তিন মাস, পোলার বাপও অসুখে মইরা গেল গা, আমার কপালও পুড়ল বাপু...হায় রে, মাথার ওপর আসমানডা ভাইঙ্গা পড়ল। আমরা কী করমু, কই যামু এই বাচ্চা লইয়া?
মুসলমানগর জমিনে হারা দিন–রাইত কাম কইরা আমার এই পোলা পরিমলরে মানুষ করছি, পোলার দিকে চাইয়া আর বিয়া বহি নাই। কয়েক বছর আগে পোলারে বিয়া করাইলাম পাশের গেরামের কণিকা বর্মনের লগে। বিয়ার পর যখন হুনলাম বউ পোয়াতি, আমার একটা মাত্র পোলার ঘরে আইব নতুন মানুষ, মনে মনে ভাবলাম, এই সুখ কপালে সইব আমার? মনে মনে যার লাইগা ডরাইছিলাম তা–ই হইল, এক রাইতে পেটে ব্যথা উঠল বউয়ের, গেরামের দাইরে খবর দিলাম, দাই কইলো এহানে সম্ভব না, রোগীরে নিয়া যাইতে হইব শহরের হাসপাতালে।

শহরে লইয়া যাইয়া এক ক্লিনিকে ভর্তি করলাম, সিজারে মেয়া সন্তান হইল, আমি দাদি হইলাম। হায় ভগবান, ছেড়িডা জন্মাইনের ৩ দিন পর ক্লিনিকেই আচমকা মইরা গেল মা। ৩ দিন বয়সে দুনিয়ার এতিম হইল প্রিয়ন্তী, হেই ৩ দিন বয়স থেইকাই অরে কোট্টার (কৌটার) দুধ কিনা খাওয়াইছি, কিছুদিন পরে আর কিনতে পারি নাই টেহার লাইগা, কই টেকা পামু, ভাত জোটে না জাগোর কপালে, দুধ কিনমু কেমনে? দুধ খাওনের লাইগা ছটফট করে, কান্দে; তারপর থেইকা খালি সুজি খাওয়াইয়া কোনোমতে বাঁচাইয়া রাখছি প্রিয়ন্তীরে, আমার বনুরে (বইনে) বাঁচায় রাখছে ভগবান।

কথাগুলো বলে শেষ করলেন মা–হারা ২ বছরের ছোট্ট শিশু প্রিয়ন্তীর ঠাকুমা রুপালি বর্মন। ময়মনসিংহের ফুলবাড়ীয়া উপজেলার নওগাঁও ইউনিয়নে সন্তোষপুর বনাঞ্চলে বসবাস করে রুপালি বর্মনের পরিবার। বন বিভাগের এই জায়গায় রুপালির মতো কমপক্ষে আরও ২০ থেকে ২৫টি পরিবার বসবাস করে আসছে যুগের পর যুগ ধরে। একসময় এ এলাকায় হিন্দু বর্মন পরিবারগুলোর সংখ্যা বেশি থাকলেও মুক্তিযুদ্ধের সময় বহু পরিবার জীবন রক্ষার্থে পালিয়ে যায় ভারতে। ফলে বনাঞ্চলে একসময় তাদের চাষের জমি থাকলেও স্বাধীনতা–পরবর্তী সময়ে সব জমিজমা চলে যায় বন বিভাগের আওতায়, পাশাপাশি সুযোগ বুঝে প্রভাবশালীরাও গিলে খেয়েছে সময়ে সময়ে।

সোজাসাপ্টা বললে দিনমজুরের কাজ করে চলতে হয় পরিবারগুলোর, কাজ করতে পারলে খেতে পারে আর কাজ না করলে অনাহারে থাকতে হয়। হিন্দু এই পরিবারগুলোর শেষ ভরসা মাথা গোঁজার ঠাই বলতে একমাত্র বসবাসের ঘরটা থাকলেও তা নিয়েও রয়েছে তাদের নানান সংশয়, যেকোনো মুহূর্তে বন বিভাগের নির্দেশে উচ্ছেদ হয়ে যেতে পারে রুপালি বর্মনের মতো হতদরিদ্র পরিবারগুলো। তখন হয়তো মাথার ওপর খোলা আকাশটা ছাড়া আর কিছুই থাকবে না তাদের ভাগ্যে, যদিও এমন ভাগ্যকে মেনে নিয়েই রুপালি বর্মনদের দিন–রাত কাটে এই বনাঞ্চলে।

প্রিয়ন্তীর মা কণিকা বর্মনের মৃত্যুর পর ওর বাবা পরিমল বর্মন অনিতা নামের পাশের গ্রামের আরেকটা মেয়েকে বিয়ে করেন, প্রায় ২ বছর হতে চলল বিয়ের। সৎমায়ের সংসারে ছোট্ট প্রিয়ন্তী পায়নি যেমন স্নেহ, মায়া–মমতা, তেমনি সামনের দিনগুলোতে আসলে কী আছে এই ছোট্ট শিশুর ভাগ্যে, তা বলতে পারে না কেউই। জন্মের পর থেকেই দাদিই লালন পালন করে আসছে শিশুটিকে। কোলে–পিঠে করে মানুষ করে যাচ্ছেন বয়সের ভারে ন্যুব্জ দাদি রুপালি বর্মন।

আক্ষেপ করে প্রিয়ন্তী দাদি রুপালি বর্মন বলেন, একসময় এই গহিন জঙ্গলে আইসা ঘর বানছি, অহন হুনি এই জায়গা আমগোর না। সরকারি জায়গা, বনের জায়গা বন; বন বিভাগ তুইলা দিলে আমগোরে হরি নাম লইয়া যাইতে হবে গা। ছোট্ট প্রিয়ন্তীরে পিঠের ওপর বাইন্ধা সারা দিন মানুষের খেতে–খামারে কাজ করছি। কারণ, নিজে খাই না খাই, দুধের বাচ্চারে তো খাওনের কষ্ট দেওয়া যাইব না। আমার সবকিছু দিয়া এই পর্যন্ত নাতিরে পাইলা আইলাম। গেরামের মেম্বার-চেয়ারম্যানের কাছে প্রিয়ন্তীর লাইগা সাহায্য চাইছিলাম, কইছি একটা শিশু কার্ড কইরা দেন, কিন্তু কেউ কিছু দেয় নাই। অহনা বুড়া হইয়া গেছি, কাম করতে পারি না, ভাবতাছি আমি মইরা গেলে এই এতিম মেয়েটার কী হইব, বাপেও দেখব না, সৎমাও দেখব না।

ছোট্ট প্রিয়ন্তীর ভাগ্যে কী আছে আমরা কেউ হয়তো জানি না। দারিদ্র্যের চরম কশাঘাতে অবজ্ঞা–অবহেলা–অনাদরে তিলে তিলে কষ্টে কাটবে হয়তো শিশুটির দিন–রাত। প্রিয়ন্তী কখনো কল্পনাও করতে পারবে না তার মায়ের মুখটা আদতে কেমন ছিল দেখতে।

সরেজমিন সন্তোষপুর বনাঞ্চলে রুপালি বাড়ির ওপর গিয়ে দেখা যায়, প্রিয়ন্তীকে দুপুরে গোসল করাচ্ছেন তার দাদি। কদিন ধরে দুধ খেতে চাইলেও পাতিলে জাল করে রাখা হয়েছে শুধু সুজি, ঘরে টাকাও ফুরিয়ে যাচ্ছে, সারা দিন ছেলে পরিমল কাজ করে যা পায়, তা দিয়ে চলতে হয় পরিবারটিকে। এদিকে করোনার কারণে মাঠে কাজের চাহিদাও কম।

সংশ্লিষ্টরা মনে করছে, শুধু প্রিয়ন্তী নয়, বাংলাদেশের মতো এমন উন্নয়নশীল দেশেও বহু শিশু এভাবেই অনাদরে, অযত্নে, অবহেলায় ও কষ্টে দিন কাটাচ্ছে। সরকারিভাবে শিশু সুরক্ষার জন্য সরকারের নানা উন্নয়নমূলক কার্যক্রম চালু থাকলেও তৃণমূলের এমন অনেকেই সেবা পান না। সমাজে প্রিয়ন্তীর মতো এমন শিশুদের শিক্ষা–স্বাস্থ্যের মতো গুরুত্বপূর্ণ মৌলিক অধিকারগুলো সংরক্ষণে শুধু সরকারি নয়, বেসরকারিভাবে ও ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানগুলোর এগিয়ে আসা প্রয়োজন।

পরিশেষে তাই বলতে চাই, বিধাতা হয়তো ছোট্ট প্রিয়ন্তীর জন্যই এখনো বাঁচিয়ে রেখেছেন দাদি রুপালি বর্মনকে, তাই প্রিয়ন্তী তার পূর্ণ মৌলিক মানবিক অধিকার নিয়ে এই পৃথিবীতে বেঁচে থাকুক, এটাই আমাদের কামনা...।

*নাগরিক সংবাদে লেখা পাঠাতে পারেন [email protected]