বিদেশে বাংলা ভাষা-সংস্কৃতি টিকিয়ে রাখা বাংলাদেশ সরকারের নৈতিক দায়বদ্ধতা

বাঙালি জাতীয়তাবাদ বাংলা ভাষা থেকে উৎসারিত হয়েছে। কাজেই বাঙালি জাতীয়তাবাদের অন্যতম ভিত্তি হলো বাংলা ভাষা। কিন্তু বাংলাদেশের জ্ঞানদীপ্ত অভিজাত শ্রেণি ক্রমেই বাংলা ভাষা থেকে সরে এসে ইংরেজি ভাষায় অনুরক্ত হয়ে উঠছে। আজ যারা বাংলাদেশের জ্ঞানদীপ্ত অভিজাত শ্রেণি, তারা ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের কাল থেকে পাকিস্তান আমল পর্যন্ত দেশমাতৃকার আলোকবর্তিকা হিসেবে পথ দেখিয়েছে। তারা ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ ও পাকিস্তানি সামরিক জান্তার শাসন ও শোষণের বিরুদ্ধে দেশের মানুষকে জাগিয়ে তুলেছে। তাদের নেতৃত্বে ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধ সংগঠিত হয়েছে। তাদের মধ্যে যেমন রয়েছে বুদ্ধিজীবী, সংস্কৃতিকর্মী, সাহিত্যিক সমাজ, তেমনি রয়েছে উকিল, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার ও শিক্ষক। কিন্তু এই জ্ঞানদীপ্ত অভিজাত শ্রেণি বাংলাদেশের স্বাধীনতা–উত্তরকালে পাশ্চাত্যায়নের প্রভাবে আপন দেশের সমাজ ও সংস্কৃতির উত্তরাধিকারের কথা ভুলে নিজেদের পরবর্তী প্রজন্মকে পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত করছে। নিজেদের জন্য ও নিজেদের সন্তানদের ভবিষ্যৎ শান্তির বাসভূমি হিসেবে পাশ্চাত্যের দেশগুলো বেছে নিচ্ছে। কোনো সমাজের অভিজাত শ্রেণি যে সমাজ ও সংস্কৃতিকে ধারণ করে, দেশের সমাজ ও সংস্কৃতির স্রোতও সেদিকে প্রবাহিত হয়। ফলে যা হওয়ার তা–ই হচ্ছে। নব্য ধনিকশ্রেণিও সেই স্রোতে গা ভাসিয়ে আভিজাত্যের প্রতীক পাশ্চাত্যের ভাষা ও সংস্কৃতিকে ধারণ করছে। দেশ ধাবিত হচ্ছে এক সাংস্কৃতিক শূন্যতায় ও তমসাচ্ছন্নতায়। আর এই সাংস্কৃতিক শূন্যতা পূরণের জন্য ইসলামি সংস্কৃতি পরিপূরক হিসেবে দাঁড়িয়েছে।

আর পাশ্চাত্যায়নের এই ধারায় বাংলা ভাষাভাষী অভিজাত শ্রেণি পাশ্চাত্যের বিভিন্ন দেশে অভিবাসন করছে। তারা পাশ্চাত্যের বিভিন্ন দেশ, যেমন: যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া ও কানাডায় স্থায়ী আবাস খুঁজে নিয়েছে, যাদের অধিকাংশই ইতস্তত বিক্ষিপ্তভাবে পাশ্চাত্য জনসমাজের মধ্যেই বসবাস করছে। ভারতের বাংলা ভাষাভাষীদের অনেকে জীবিকার প্রয়োজনে তাদের মূল রাজ্য ছেড়ে অনেকে ভিন ভাষাভাষী রাজ্যে আবাস গাড়ছে। ভারতের বাংলা ভাষাভাষীদের অনেকে কোণঠাসা হওয়ার ভীতি থেকে নিজেদের পরিচয় গোপন করে সেসব রাজ্যের ভাষা রপ্ত করে সেখানের অধিবাসী হয়ে যাচ্ছে। বাংলা ভাষাভাষীদের যারা বিদেশ–বিভুঁইয়ে অভিবাসন করছে, তাদের অনেকেই সমাজবদ্ধভাবে বসবাস করছে। সমাজবদ্ধভাবে বসবাস করছে এমন একটি বাংলা ভাষাভাষী সমাজ হলো যুক্তরাজ্যের লন্ডন বারো (টাওয়ার হ্যামলেটস এবং নিউহাম)। পাশ্চাত্য দেশের বিদেশি ভাষা-পরিস্থিতিতে বাংলা ভাষা মর্যাদা ও প্রায়োগিকতায় যেকোনো স্থানীয় ভাষার চেয়ে অগ্রহণযোগ্য। যেকোনো কারণে সেসব পাশ্চাত্য দেশে পারিবারিক পরিমণ্ডল ছাড়া দৈনন্দিন জীবনে বাংলা ভাষা ব্যবহারের তেমন কোনো সুযোগ নেই। এর ফলে অভিবাসীদের প্রথম প্রজন্মের মধ্যে বাংলা ভাষায় দখল থাকলেও দ্বিতীয় প্রজন্মের সবাই দ্বিভাষী হওয়ায় তাদের অধিকাংশই মাতৃভাষা বাংলার চেয়ে বিভাষায় বাচন, শ্রবণ, লিখন ও পঠনে দক্ষ হয়। বাংলা ভাষাভাষী এসব অভিবাসী প্রথম প্রজন্ম মাতৃভূমির প্রতি দরদ থেকে বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতিচর্চায় যতটুকু নিয়োজিত হয়, কিন্তু দ্বিতীয় প্রজন্মের অধিকাংশই নিজের শিকড় থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে হয়ে বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতি চর্চা থেকে সরে আসছে। ভাষা-সংসর্গতত্ত্ব অনুসারে নতুন প্রজন্মের কাছে এ ভাষা আর মাতৃভাষা নয়, কেবলই ঐতিহ্য ভাষা। প্রজন্মান্তের এ ভাষাই তাদের কাছে একসময় হবে বিভাষা।

বিভিন্ন দেশ ও অঞ্চলে অভিবাসিত হয়েও তারা বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির প্রতি মমত্ববোধ থেকে ঐতিহ্য ভাষা বাংলা ভাষা চর্চা করে যাচ্ছে। তারা সুযোগে পেলেই টেলিভিশনের মাধ্যমে দেশের খোঁজ রাখছে। যেখানে যথেষ্টসংখ্যক বাংলা ভাষাভাষী রয়েছে, সেখানে কমিউনিটি গড়ে তুলে শহীদ দিবস, পয়লা বৈশাখ ইত্যাদি অনুষ্ঠান পালন করছে। তারা প্রবাসে থেকেও বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির চর্চা করছে। কিন্তু বিদেশে অভিবাসিত দ্বিতীয় বা পরবর্তী প্রজন্ম প্রথম ভাষা হিসেবে অভিবাসিত দেশের ভাষাকে রপ্ত করছে এবং ব্যবহার করছে। তারা বাস্তব জীবনে অন্য একটি ভাষা-পরিস্থিতিতে অবস্থান করায় বাংলা ভাষা ব্যবহারের সুযোগ পাচ্ছে না। এভাবে প্রবাসে বিদেশি ভাষা-পরিস্থিতিতে বাংলা হয়ে দাঁড়িয়েছে ঐতিহ্য ভাষা। বাংলা ভাষাকে ঐতিহ্য ভাষা হিসেবে টিকিয়ে রাখতে শুধু বাঙালি কমিউনিটির প্রচেষ্টা ও সমর্থন যথেষ্ট নয়; তার জন্য প্রয়োজন বাঙালি জাতীয়তাবাদ থেকে উৎসারিত সরকারি পর্যায়ের প্রচেষ্টা ও সমর্থন। কিন্তু এই সমর্থন বা প্রচেষ্টার দায় কোনোমতেই বিদেশি সরকারের ওপর বর্তায় না, বরং তার দায়িত্ব বর্তায় বাংলা ভাষাভাষী দেশ ও জনগণের প্রতি। বাংলা ভাষাভাষী দেশ রয়েছে দুটো—বাংলাদেশ ও ভারত। কিন্তু ভারত যেহেতু যুক্তরাজ্যীয় ভাষা হিসেবে বাংলার চেয়ে হিন্দিকে প্রাধান্য দিয়ে যাচ্ছে, সেহেতু ভারত বিদেশে বাংলা ভাষা প্রচলন ও জনপ্রিয়করণের দায় নেবে না। কাজেই এই দায় বর্তায় বাংলা ভাষাভাষী রাষ্ট্র বাংলাদেশের ওপর। কিন্তু বাংলাদেশ সরকারের কোনো ভাষানীতি না থাকায় বাংলা প্রচলন ও জনপ্রিয়করণের ব্যাপারে সরকার উদাসীন। এ অবস্থায় দেশে প্রতিষ্ঠিত বর্তমান রাজনৈতিক শক্তির কাছে বিদেশে বাংলা ভাষার ঐতিহ্য রক্ষার দায়িত্ব নেওয়ার বিষয়ে আশা করা বাতুলতামাত্র। কিন্তু বিদেশে বাংলা অভিবাসিত বাংলা ভাষাভাষী সমাজে ঐতিহ্য ভাষা হিসেবে বাংলা ভাষাকে বাঁচিয়ে রাখার দায় বর্তায় ভাষা ও সংস্কৃতিসংক্রান্ত বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ওপর। এসব প্রতিষ্ঠানের মধ্যে রয়েছে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট, বাংলা একাডেমি ও বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি। বিদেশে এসব প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম পরিচালনার স্পৃহা রয়েছে। কিন্তু এখন যা প্রয়োজন, তা হলো রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে রাজনৈতিক ও নৈতিক সিদ্ধান্ত।

  • লেখক: অধ্যাপক ড. এ বি এম রেজাউল করিম ফকির, পরিচালক, আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়; ভূতপূর্ব অতিথি শিক্ষক, টোকিও বিদেশবিদ্যা বিশ্ববিদ্যালয়, ভূতপূর্ব গবেষণা ফেলো, জাপান রাষ্ট্রভাষা ইনস্টিটিউট