বিজয়ী বাংলায় বাঙালির ভ্রাতৃত্ববন্ধন অটুট থাকুক

প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশে জন্ম আমাদের। তাই সংগত কারণে ‘বাঙালি’ই আমাদের সবচেয়ে বড় পরিচয়। তাই  আমরা সারা বছর বিভিন্ন উৎসবে মুখর হতে ইচ্ছুক বাঙালিত্ব নিয়ে। বিশেষ করে জাতীয় দিবসগুলোতে বাঙালির চিরচেনা গৌরবগাথা আত্মায়, পোশাকে আর চলনেবলনে পরিলক্ষিত হয়। জাতীয় দিবসগুলোতে বিভিন্ন সামাজিক, জাতীয় কর্মশালা থাকে। আমরা মনে করার, মগজে ধারণ, লালন ও স্মরণ করার চেষ্টা করি প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশ ৩০ লাখ শহীদের, দুই লাখের বেশি নারীর ইজ্জতের প্রতিদান। এটি আমাদের কখনোই ভুলে গেলে চলবে না।

১৯৭১ সালের আগে থেকেই নিষ্পেষিত পূর্ববাংলা স্বাধীনতার জন্য লড়াই করে আসছিল, যার গোড়াপত্তন ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে প্রকট রূপ ধারণ করে। বাঙালি তখন কোনো দল, ধর্ম আর গোত্র দেখে একত্রিত হয়নি। জাতীয়তা বাংলাদেশি, বাঙালি হয়েই একটি পূর্ণাঙ্গ সার্বভৌম ভূখণ্ড পেতে যুদ্ধ করেছিল ১৯৭১ সালে। মানুষ মানুষকে বাঁচাতে ধর্ম তখন কোনো বাধার সৃষ্টি করেনি। বরং জীবন বাঁচানো, দেশ স্বাধীন করাই ছিল বাঙালির মুখ্য উদ্দেশ্য। সবাই এক সঙ্গে লড়তে একজন বীর বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে একত্রিত হয়ে স্বাধীন, পাকিস্তানমুক্ত স্বদেশ গঠনের স্বপ্ন দেখেছিল। দীর্ঘ নয় মাসের মুক্তিযুদ্ধে বাঙালি প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছিল বাঙালির ভেতরকার সম্প্রীতির সম্পর্ক কতটা মজবুত ছিল।

সবার আগে আমরা মানুষ হিসেবে নিজেদের প্রকাশ করতে পেরেছি বিধায় সব ধর্মের প্রার্থনার ঘরগুলো মানুষের চিকিৎসা, থাকার জন্য তখন ব্যবস্থা করা হয়েছিল। তবে আজ কেন আমরা তা পারি না? একটু উচ্চ উদার চিন্তা করলে কেবল মানুষ হিসেবে ভাবলেই ধর্মের কারণে হিংসা বিভেদ কখনোই এতগুলো প্রাণ যাওয়ার কথা নয়।

যুগে যুগে ধর্মের বাণীতেও অন্তর্ভুক্ত আছে মানুষের ভালো কাজ, বিবেক–বিবেচনা। সব মিলিয়ে দেশ ও দশের কল্যাণে যিনি এগিয়ে আসেন, তিনিই সেরা মানুষ। কারণ, তাঁকে দিয়ে কখনো প্রকৃতি বা মানুষের কোনো ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা নেই। আজ সমাজ বা রাষ্ট্র কুলষিত পথে চলছে। একটি নির্দিষ্ট বিষয়কে অহেতুক পুঁজি করে দলে দলে বিভক্ত হয়ে ভিন্ন মতাদর্শ প্রচারে ব্যস্ত সুযোগসন্ধানী কিছু মানুষ। অথচ, বিবেকের দরজা সামান্য একটু খুললেই সব সমস্যার সমাধান হতে বাধ্য।

আমাদের মাতৃভাষা বাংলা। সবাই আমরা এই ভাষায় মনের কথা বলি। ভাষা ব্যবহার, পোশাকের ব্যবহারে একতা থাকলে কেন আমরা মতাদর্শে একত্রে থাকতে পারি না? আমাদের মনমানসিকতার ইতিবাচক পরিবর্তন দরকার। এক জায়গায় থাকতে হলে মানুষের ভালোমন্দ বুঝতে হবে, হিতাহিত জ্ঞান থাকতে হবে। দেশটাকে ভালো মানুষ তৈরির কারখানা করতে হবে। উজ্জ্বল দীপ্তিময় আদর্শিক জীবনযাপনে যে যাঁর ধর্মীয় ঐতিহ্য, ভাবগাম্ভীর্যের মধ্যে নিজেদের তৈরি করতে হবে। জন্ম থেকে কেউ বিভাজিত মনোভাব নিয়ে আসে না। সমাজ, রাষ্ট্রের চিরায়িত রূপ, চালচলনে মানুষ নিজেকে ওই ধাঁচে তৈরি করে। অথচ জীবনের প্রথম থেকেই সুশিক্ষা পেলে কখনোই মানুষ হিংসুটে, বিদ্বেষী হয়ে ওঠে না। একজন বোধশক্তিসম্পন্ন মানুষ হিসেবে আমরা সব জানি। কিন্তু মেনে নেওয়া ও মানিয়ে নেওয়ার প্রচেষ্টা আমাদের খুব একটা নেই বলেই এখনো অনাচার, অবিচার, জুলুমবাজি, জবরদখল চলছে সবখানেই কমবেশি। বাঙালি ভীষণ রকম আবেগপ্রবণ একটি জাতি। মুহূর্তেই সিদ্ধান্ত নিয়ে কোনো কাজ করা ঠিক নয়।

অদূর ভবিষ্যতে এর কী কী প্রভাব ইতিবাচক, নেতিবাচক দিক জনজীবনে হুমকি বা সুফল আনতে পারে, তা ভাবার আশুপ্রয়োজন আছে বৈকি। কোন কোন বিষয় প্রভাবক হিসেবে কাজ করছে, তা–ও ভাবা প্রয়োজন। লক্ষ্য ঠিক রেখে দেশের উন্নয়নে আমাদের অবদান রেখে যেতে হবে। এটি আমাদের নৈতিক দায়িত্ব ও কর্তব্যও বটে।

এখন চলছে বিজয়ের মাস। বাঙালির ঘরে ঘরে বিজয়ের আনন্দ। ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবসে বাংলাদেশ পৃথিবীর উন্নত রাষ্ট্র হয়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর শপথে অবিচল। এ জন্য দরকার সব ধর্মের মানুষের দেশের উন্নয়নে সমান অংশগ্রহণ। পরস্পর হাতে হাত রেখে এগিয়ে নিয়ে যাব প্রিয় মাতৃভূমিকে। আমাদের মধ্যে ভ্রাতৃত্বের বন্ধন যতই সুদৃঢ় হবে, ততই আন্তর্জাতিক চক্রান্ত ও দেশীয় অভ্যন্তরীণ কোন্দল হ্রাস পাবে। দেশ–বিদেশে বাংলাদেশের সুনাম অক্ষুণ্ন থাকুক, বাঙালির মনে বিজয়ের আনন্দ উজ্জ্বল উদীপ্ত তারুণ্যে উদীয়মান থাকুক। বাংলাদেশের ৩০ লাখ শহীদের আত্মত্যাগের অর্জন সমুন্নত থাকুক লাল–সবুজের পতাকা।
‘দেশ উন্নয়নে রাখব মোরা অবদান,
সম্প্রীতি, ভ্রাতৃত্বই একমাত্র সমাধান।’

*লেখক: পারভীন আকতার, শিক্ষক, কবি। রাঙ্গুনিয়া, চট্টগ্রাম।