বাবা হারানোর ১৮ বছর...

প্রতীকী ছবি

আমার বাবা কোনো বিখ্যাত ব্যক্তি ছিলেন না। খুব সাদামাটা জীবনযাপনে বিশ্বাসী ছিলেন। বাবার জন্ম ১৯৪৮ সালে। বাবা ছিলেন আমার দাদার দ্বিতীয় ছেলে। আমার বয়স যখন পাঁচ, তখন বাবা মারা যান। ট্রেন দুর্ঘটনায় তিনি মারা যান ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়া রেলস্টেশনের পাশে। আমি তখন ছোট। ২০০২ সালের ৪ জুলাই। আমাদের দুনিয়াটা তখনই ছোট হয়ে আসছিল। আমরা আট ভাইবোন। যখন বাবা মারা যান, তখন আমাদের সব ভাইবোনের দায়িত্ব এসে বর্তায় বড় ভাইয়ের ওপর। বাবার চলে যাওয়া এখনো আমার কাছে অস্বাভাবিক মনে হয়। ১৮ বছর আগে আমরা জানতে পারি বাবার লাশ রেললাইনের পার্শ্ববর্তী একটি নদীতে পাওয়া গেছে। রেল কর্তৃপক্ষ থেকে ধারণা করা হয়েছিল, ট্রেনের ধাক্কায় তিনি ছিটকে নদীতে পড়ে যান।

কিন্তু বেশ কয়েক দিন ধরে আমার কেন জানি মনে হচ্ছে, বাবাকে মেরে ফেলা হয়েছিল! কারণ, আখাউড়া স্টেশনে সর্বোচ্চ ‘চুরি-ডাকাতি’ হয়। বাবা বোধ হয় ডাকাতের দল বা মৌসুমি চোরের খপ্পরে পড়েছিলেন। হয়তো নিজের কাছে থাকা টাকাপয়সা বা মূল্যবান জিনিস দিতে চাচ্ছিলেন না; আর তখনই তাঁকে ‘হত্যা’ করা হয়। হত্যা করে নদীতে ফেলে দেওয়া হয়। কিন্তু তৎকালীন স্টেশনমাস্টার আমার পরিবারকে জানায়, ট্রেনের ধাক্কায় তিনি নদীতে পড়ে মারা যান। ১৮ বছর পর আমার এটা কোনোভাবেই বিশ্বাস হয় না, হচ্ছেও না। ১৮ বছর দীর্ঘ একটা পথ। হয়তো আর এ বিষয়ে কথা বলেও লাভ হবে না।

আমার বয়স এখন ২৪–এর দিকে। শহরে থাকছি। শহরে বের হলেই দেখি পিতা তাঁর সন্তানকে নিয়ে হাঁটছেন, স্কুলে নিয়ে যাচ্ছেন, একসঙ্গে শপিং করতে যাচ্ছেন। তখনই ভীষণ এক শূন্যতা অনুভব করি। চোখের কোণে জল এসে জানান দেয়, এটাই বাস্তবতা!
এ লেখা যখন কম্পিউটারের কি-বোর্ড চেপে লিখছি, তখন শ্রাবণের বৃষ্টির মতো চোখ থেকে পানি ঝরছে। বুকের ভেতর চিনচিনে ব্যথা অনুভূত হচ্ছে। এ ব্যথা অবিরাম বয়ে যাবে আমার মৃত্যুর আগপর্যন্ত। আমার অন্য ভাইবোনেরা বাবার স্নেহের পরশ পেলেও আমি মাত্র তাঁকে পাঁচ বছর সান্নিধ্যে পেয়েছিলাম। বাবা আখাউড়া রেলস্টেশনে যাওয়ার আগে আমাকে সঙ্গে করে নিয়ে খেতে বসেছিলেন মাটিতে বিছানা পেতে।

বিখ্যাত ঈশ্বরী পাটনী যেমন লিখেছিলেন, ‘আমার সন্তান যেন থাকে দুধে ভাতে’ ঠিক তেমনি বাবাও যাওয়ার বেলা আমাকে ‘দুধ-কলা’ দিয়ে ভাত খেতে দিয়েছিলেন। সেটাই ছিল তাঁর সঙ্গে আমার শেষ স্মৃতি, শেষ স্পর্শ। যে স্পর্শ আর হয়তো কখনো হৃদয়ে শিহরণ জাগাবে না!
ছায়াবিহীন দেড় যুগ…!

*লেখক: আজহার উদ্দিন শিমুল