বাংলাদেশের ফুটবলপ্রীতি ও রাতজাগা বাঙালি

ইতালির তুরিনে খেলা শুরুর আগে জুভেন্টাস ও এসি মিলানের টেডি বিয়ার হাতে মাস্ক পরা এক নারী
ছবি: রয়টার্স

খেলায় নান্দনিকতা দর্শককে আনন্দ দান করে। আর সেটা যদি ইউরোপের শৈল্পিক ফুটবল কিংবা ব্রাজিল-আর্জেন্টিনার মধ্যকার খেলা হয়, তাহলে তো কথাই নেই। দর্শকের উত্তেজনা অনেক গুণ বেড়ে যায়।

সদ্য সমাপ্ত কোপা আমেরিকার ফাইনালে আর্জেন্টিনা-ব্রাজিল দ্বৈরথে সে রকমই কিছু ইঙ্গিত বহন করে। রূপকথার ফাইনালে ব্রাজিলকে হারিয়ে জয় আর্জেন্টিনার।

আবেগপ্রবণ বাঙালি আবেগের বশবর্তী হয়ে প্রিয় দলকে সমর্থন করে। তবে বাঙালির আর্জেন্টিনা কিংবা ব্রাজিলপ্রীতি দেখে আমি মুগ্ধ না হয়ে পারি না। সেখানে যে শুধু আবেগ আছে, তা নয়। সুন্দর বা শিল্পিত খেলার প্রতি একটা মোহ জন্মে। তাই প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম ধরে তারা ফুটবল খেলা উপভোগ করে আসছে। এর ব্যত্যয়ে আমি নই। আমিও রাত জেগে ফুটবল খেলা দেখি। কোনো একটা প্রিয় দলকে সমর্থন দিয়ে যাই।

কোপা আমেরিকার ফাইনালে গতকাল লড়েছিল মেসির আর্জেন্টিনা ও নেইমারের ব্রাজিল
ছবি: রয়টার্স

তবে সে সমর্থন ক্ষণস্থায়ী। নিজ দেশের খেলা হলে প্রগাঢ় ভালোবাসা জন্মাত। কিন্তু আমাদের দেশের ফুটবল খেলায় উল্লেখ করার মতো অর্জন নেই কিংবা ফুটবল খেলার বড় টুর্নামেন্টও আয়োজন করা হয় না। তারপরও মাঝেমধ্যে নিজ দেশের ফুটবল খেলা নিয়ে মেতে উঠি। ইচ্ছা হয় দেশের লাল-সবুজ পতাকা গ্যালারিতে উঁচিয়ে ধরি! ফুটবলপ্রেমী সবাই মিলে উৎসাহ নিয়ে খেলা দেখি। বাংলাদেশ বাংলাদেশ বলে গ্যালারি মাতিয়ে রাখি। কিন্তু প্রত্যাশা অনুযায়ী আমাদের ফুটবল এখনো কাঙ্ক্ষিত স্থান লাভ করতে পারেনি। কয়েক দশক আগে ভালো মানের ফুটবল খেলা উপহার দিলেও বাংলাদেশের ফুটবলে আজ মলিনতার ছাপ।

ফুটবল খেলার মতো অন্য কোনো খেলা আজও বাঙালির মনে জায়গা করে নিতে পারেনি। তাই এখনো গ্রামবাংলায় ফুটবল টুর্নামেন্ট অনুষ্ঠিত হলে আশপাশে কয়েক গ্রামের লোকজন মিলে খেলা উপভোগ করে। টুর্নামেন্টে ছেলে-বুড়োদের উপস্থিতি খেলাকে আরও প্রাণবন্ত করে তোলে। অতীতে আমাদের ফুটবল খেলার বিচরণ দেশের বাইরেও ছিল। যেমন ছিল ঘরোয়া টুর্নামেন্টের আয়োজন, তেমনি ছিল ফুটবল খেলার ঐতিহ্য। খেলার ব্যাপ্তি গ্রামেগঞ্জে সর্বত্র ছিল। ফলে ফুটবলপ্রেমী বাঙালিদের মনে ঠাঁই করে নিয়েছিল ক্লাবের ফুটবল। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আমরা ফুটবল অঙ্গনে পিছিয়ে পড়ছি। বিশ্বের বহু দেশ ফুটবলকে সুন্দর রূপায়ণ দিতে পারলেও আমরা সেটা পারিনি। আমরা ক্রিকেট–দুনিয়ায় পাঁচবারের বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন দলকে হারাতে পারি। ক্রিকেট–বিশ্বে সাকিবের মতো বিশ্বসেরা অলরাউন্ডার কিংবা মাশরাফির মতো অসাধারণ নেতৃত্ব গুণাবলিসম্পন্ন একজন অধিনায়ক তৈরি করতে পারি! সে অপার সম্ভাবনাময় ক্রিকেটখেলুড়ে দল একদিনে তৈরি হয়নি। বহু চেষ্টায় তা অর্জিত হয়েছে। আমরা ক্রিকেটে পারি, ফুটবলে পিছিয়ে পড়ি।

এর বহুবিধ কারণ রয়েছে। বর্তমান প্রজন্ম খেলাধুলার মানদণ্ডকে প্রাধান্য না দিয়ে ছেলেমেয়েদের লেখাপড়ার প্রতি আগ্রহী করে তোলে। ফলে পেশাদারি ফুটবল খেলা এ দেশে অনেকটা চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। যার ফলে আমাদের ফুটবলে দেখা দেয় যোগ্য নেতৃত্বের অভাব এবং ভবিষ্যৎ অনিশ্চয়তা। দেশে ক্লাব পর্যায়ে একসময় ভালো খেলোয়াড় থাকলেও বর্তমান অবস্থা তেমনটি নয়। বর্তমানে ক্লাবগুলোতে মূল স্ট্রাইকারের ভূমিকায় বিদেশি খেলোয়াড়দের প্রাধান্য দেওয়া হয়। ফলে দেশের ভালো খেলোয়াড়দের সুযোগ নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। উদীয়মান খেলোযাড়েরা খেলা থেকে ছিটকে পড়ছেন। নিরন্তর চেষ্টা থাকলেও তা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়।

বাংলাদেশের ফুটবলে রয়েছে ঐতিহ্য। আমাদের স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় ‘স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল’ ভারতের বিভিন্ন স্থানে প্রদর্শনী ফুটবল খেলে জনমত গঠনে সহায়তা করেছে। এর মাধ্যমে বিশ্বে স্বাধীনতার দাবি যৌক্তিক রূপ লাভ করে। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভ করার পর ১৯৭২ সালের ১৫ জুলাই বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন (বাফুফে) প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৭৩ সালের ২৬ জুলাই প্রথম আন্তর্জাতিক ম্যাচ থাইল্যান্ডের বিপক্ষে অংশগ্রহণ করে। ম্যাচটি ২-২ গোলে ড্র হয়েছিল। ফিফা বিশ্বকাপ বাছাইপর্বে ১৯৮৫ সালে প্রথমবার অংশগ্রহণ করে। দক্ষিণ এশীয় গেমসে ১৯৯৫ সালে ভারতের কাছে হেরে প্রথমবারের মতো রৌপ্য পদক অর্জন করে। ২০০৩ সালে সাফ চ্যাম্পিয়নশিপে মালদ্বীপকে হারিয়ে বাংলাদেশ জয়লাভ করে।

ফুটবল মাঠে লাল-সবুজ উৎসব। অনূর্ধ্ব-১৬ সাফ চ্যাম্পিয়নশিপে কাল ভারতকে হারিয়ে দেওয়ার পর বাংলাদেশের কিশোরদের জয়োৎসব
প্রথশ আলো ফাইল ছবি

২০১৫ সালে বঙ্গবন্ধু গোল্ডকাপের ফাইনালে মালয়েশিয়ার বিপক্ষে খেলে। সে ম্যাচে ৩-২ গোলের ব্যবধানে বাংলাদেশ শিরোপা থেকে বঞ্চিত হয়। আন্তর্জাতিক ফুটবল অঙ্গনে উল্লেখ করার মতো তেমন কোনো সফলতা পায়নি। কয়েক দশক আগেও যেখানে বাঙালিরা ক্লাবের ফুটবলে ভালো খেলা উপহার দিয়েছে, সে ধারাবাহিকতা আজ নেই। ফিফা বিশ্ব র‍্যাঙ্কিংয়ে ১৯৯৬ সালে ১১০তম স্থানে অবস্থান করে। পরবর্তী সময়ে ২০১৮ সালে সর্বনিম্ন র‌্যাঙ্কিং ১৯৭তম। বৈশ্বিক ফুটবলের সঙ্গে তুলনা করলে আমাদের দেশের র‌্যাঙ্কিং–ব্যবস্থা অনেক নিচে, বর্তমানে ১৮৪তম। র‌্যাঙ্কিংয়ের অবস্থান থেকে বোঝা যায়, বাংলাদেশের ফুটবল ভালো অবস্থানে নেই। যেটুকু ছিল, সেটুকুও হারিয়ে গেছে।

আগেকার মতো গ্রামের মধ্যেও ফুটবল খেলার আমেজ চোখে পড়ে না। আমরা যাঁরা গ্রামে বেড়ে উঠেছি, জমির মাঠেও ফুটবল টুর্নামেন্টের আয়োজন করেছি। বর্তমানে গ্রামগুলোতেও আগের মতো তেমন ফুটবল প্রীতি ম্যাচ আয়োজন করা হয় না। বিশ্বকাপ ফুটবল শুরুর আবহে শহরাঞ্চলে দু–একটা খেলার আয়োজন করা হলেও পরবর্তী সময়ে ধারাবাহিকতা বজায় থাকে না। এর অন্যতম কারণ মাঠের স্বল্পতা। অথচ গ্রামগঞ্জে এখনো ফুটবলের জনপ্রিয়তার কমতি নেই।

কিরগিজস্তানের অনূর্ধ্ব-২৩ দলের বিপক্ষে গতকাল নেপালে ১-০ গোলের জয় পেয়েছেন বাংলাদেশের ফুটবল দল
ছবি : প্রথম আলো

বর্তমানে করোনা মহামারির কারণে ফুটবল খেলা বিভিন্নভাবে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। অনেক দিন মাঠে ফুটবল গড়ায়নি। ক্লাবগুলো ইচ্ছা করলেই খেলার আয়োজন করতে পারছে না। করোনার কারণে নতুনভাবে সংকটে পতিত হচ্ছে। সব মিলিয়ে ফুটবল খেলার অবস্থান তেমন ভালো যাচ্ছে না। বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগ ফুটবল গত মৌসুমে কয়েক রাউন্ড খেলা চালিয়ে যাওয়ার পর করোনার কারণে বন্ধ করে দিতে হয়। এ বছরও প্রথম পর্ব শেষে বন্ধ হয়ে যায়। যদিও আবার করোনার মধ্যে খেলা শুরু হয়। সবকিছু বিবেচনায় আমাদের ফুটবলকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। খেলাধুলার জগতে উন্নতির জন্য সংশ্লিষ্ট সবাইকে আন্তরিকভাবে কাজ করতে হবে। এ ক্ষেত্রে এমন দক্ষ লোক প্রয়োজন, যাঁরা আমাদের ফুটবলকে সফলতার স্বপ্ন দেখাতে পারবেন। এর জন্য বাফুফেকে সঠিকভাবে কাজ করতে হবে। খেলোয়াড়, কোচ কিংবা ক্লাবেরও বিশেষ দায়িত্ব রয়েছে। তবে বহুমুখী ফুটবল টুর্নামেন্টের মাধ্যমে গ্রামগঞ্জ থেকে ভালো খেলোয়াড় বের করে নিয়ে আসতে হবে।

আমাদের আশা, আমাদের দেশের ফুটবল আস্তে আস্তে অনন্য প্রত্যাশায় এগিয়ে যাবে। আমরা রাত জেগে খেলা উপভোগ করব, যে খেলা ঘিরে আমাদের আবেগ জড়িয়ে থাকবে। সে খেলায় স্বতঃস্ফূর্ত ভালোবাসার স্থান হবে বাংলাদেশ, শুধুই বাংলাদেশ!

*লেখক: ব্যাংক কর্মকর্তা ও লেখক