বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যে সম্পর্ক আসলে কেমন

শুকনা মৌসুমে তিস্তা নদীর করুণ দশা
ফাইল ছবি

সম্প্রতি বাংলাদেশ সফরে এসে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি যে বক্তব্য দিয়েছেন এবং সফর শেষে দেশটির স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ যে মন্তব্য করেছেন, এতে কি বোঝার উপায় আছে দুই দেশের সম্পর্কের বর্তমান অবস্থা?

কিছুদিন আগে আনন্দবাজার পত্রিকায় দেওয়া সাক্ষাৎকারে অমিত শাহ বললেন, ‘বাংলাদেশের গরিব মানুষ খেতে পায় না, তাই তারা ভারতে যায়।’ এর জবাবে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বললেন, ‘এটা তাঁর জ্ঞানের দৈন্য।’ আসলেই কি জ্ঞানের দৈন্য? নাকি কার কতটুকু জ্ঞান, তা বোঝার জন্য যে জ্ঞান থাকা দরকার, তা না থাকার দৈন্য। এর আগেও অমিত শাহ বাংলাদেশ নিয়ে আপত্তিকর বক্তব্য দিয়েছেন। জাতীয় নাগরিক নিবন্ধন (এনআরসি) ও ভারতের নাগরিকত্ব আইন (সিএএ) নিয়ে ভারতীয় বাঙালিদের হুমকি-ধমকি দিয়েছেন।

সর্বশেষ পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভা নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশের নির্যাতিত এক নারীকে নিয়ে বিজেপি যে গান বানাল, তার কৈফিয়ত কি আমরা চাইতে পেরেছি, পারিনি। সীমান্তে মানুষ হত্যা, পানির ন্যায্য হিস্যা, বাণিজ্য–বৈষম্য নিয়েও কিছু বলতে পারিনি।

আশার কথা হচ্ছে, দুই দেশের জনগণ আর তাঁদের মধ্যকার চিরন্তন মেলবন্ধন। এই মেলবন্ধনের মধ্যে কৃত্রিমতা নেই। আছে হাজার বছরের সৌহার্দ্য-সম্প্রীতির মিলনরেখা। সেদিন তিস্তা ব্যারেজ নিয়ে বলতে গিয়ে ভারতের কোচবিহারের একজন বললেন, ‘বাংলাদেশকে মারতে গিয়ে ভারতের লোকও আমরা মরে যাচ্ছি।’

এটাই আসল কথা। অথচ তিস্তার পানি নিয়ে দিস্তায় দিস্তায় কাগজ ফুরোলেও তিস্তায় পানি গড়ায়নি। এ নিয়ে কথা বলতে গেলেই কিছু লোক তাঁকে ভারতবিরোধিতার ট্যাগ লাগিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেন। এই দেশের একশ্রেণির মানুষ তাতে বাতাস দেন। অথচ দুই দেশেরই জনগণের কোনো ইস্যু নিয়ে তাঁদের কখনো সরব হতে দেখা যায় না। ভারতের সঙ্গে ৫৪টি অভিন্ন নদীর পানির ন্যায্য হিস্যা বা বাঁধবিরোধিতা করা মানে কিন্তু ভারতবিরোধিতা নয়।

বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধে ভারত যে সহযোগিতা করেছে, এ জন্য চিরকাল কৃতজ্ঞতার বন্ধনে আবদ্ধ রাখতে চাই। কিন্তু যে স্বাধীনতার জন্য আমাদের ২৩ বছর সংগ্রাম করতে হয়েছে, ৩০ লাখ তাজা প্রাণ ও ৩ লাখ মা-বোনের ইজ্জত দিতে হয়েছে, সেই স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বে আপনারা শিকল পরাবেন? আধিপত্য বিস্তার করে গোলামির জিঞ্জির বেঁধে রাখবেন? তা হতে পারে না, ইতিহাসেও তা হয়নি। মজলুম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ ভাসানী বলেছিলেন, ‘পিণ্ডির জিঞ্জির ছিন্ন করেছি দিল্লির দাসত্ব মানি না, মানব না।’ ভারতের শাসকগোষ্ঠীর জন্য শুধু এটুকুই বলতে চাই, বাঙালি কোনো দিন কারও বশ্যতা স্বীকার করেনি, কারও গোলামি করেনি। বাঙালি কারও চোখরাঙানিকে ভয় পায় না। বাংলার মানুষ শান্তি ও সৌহার্দ্যের সম্প্রীতি চায়।

১৯৬৫ সালে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের পর থেকে এখন পর্যন্ত ভারত যেভাবে বাংলাদেশের ওপর পানি আগ্রাসন চালিয়েছে, বাংলাদেশকে মরুভূমি করার নীলনকশা বাস্তবায়নের পথে হেঁটেছে, তাতে শুধু বাংলাদেশের মানুষই ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি, বরং ভারতের জনসাধারণও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আন্তর্জাতিক আইনকানুন, কনভেনশনের তোয়াক্কা না করে একের পর এক বাঁধ নির্মাণ দুই দেশের ভূপ্রকৃতি ও প্রাণিবৈচিত্র্যের ওপর বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করছে। পানির ওপর প্রাণের হক বিনষ্ট করে দুই দেশের সাধারণ মানুষের জীবনকে, পরিবেশ ও প্রতিবেশ বিপর্যয়ের মুখে ঠেলে দিচ্ছে। তাই বর্তমান বাস্তবতায় অনুধাবন করতে হবে, একা এক রাষ্ট্র, এক জাতি ভালো থাকা যায় না। সবাইকে নিয়েই ভালো থাকতে হয়। প্রভুত্ব নয়, ভ্রাতৃত্ব প্রসারিত করে এগিয়ে যেতে হবে। জয় হোক বাংলাদেশ-ভারতের মেহনতি মানুষের।

লেখক: সভাপতি, মওলানা ভাসানী কৃষক সমিতি ও সদস্যসচিব, ভাসানী পরিষদ