বঙ্গবন্ধু: বাংলার জোছনা ও রোদ্দুর-৩০

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান

সত্তরের নির্বাচনে নিরঙ্কুশ বিজয়ের পরও শাসকগোষ্ঠী বঙ্গবন্ধুকে ক্ষমতা দেয় না। শুরু করে অন্ধকারের রাজনীতি। ৩ মার্চ জেনারেল ইয়াহিয়া জাতীয় পরিষদের অধিবেশন ডাকেন। আবার ১ মার্চ অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ করে দেয়। প্রতিবাদে পূর্ব বাংলায় তীব্র আন্দোলন হয়। ২ মার্চ ঢাকায় ও ৩ মার্চ সারা দেশে পালিত হয় হরতাল।
৩ মার্চ পল্টন ময়দানে বিশাল জনসভায় বঙ্গবন্ধু ডাক দেন সর্বাত্মক অসহযোগের। এরই ধারাবাহিকতায় একাত্তরের ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে প্রায় ১০ লাখ মানুষের সামনে বঙ্গবন্ধুকে এক মহাকাব্যিক ভাষণ দেন। দুপুর গড়াতে না গড়াতেই উত্তাল জনতার মিছিলে মিছিলে ভরে গেল ঢাকার রেসকোর্স ময়দান। সব কালে সব দেশে কিছু মানুষ থাকে দেশদ্রোহী। বঙ্গবন্ধুও সেটা জানতেন। ওই কিছু মানুষ ছাড়া সবাই স্বাধীনতার ঘোষণা শোনার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে। বেলা প্রায় ৩টায় বঙ্গবন্ধু মঞ্চে এসে দাঁড়ালেন। তখন শুরু হয় লাখ লাখ মানুষের করতালি ও মুহুর্মুহু স্লোগান—
বীর বাঙালি অস্ত্র ধরো
বাংলাদেশ স্বাধীন করো।
শেখ মুজিবের পথ ধরো—বাংলাদেশ স্বাধীন করো।

এসব স্লোগানে মুখর হয়ে ওঠে সেদিন ফাগুনের আকাশ–বাতাস। একটু এদিক-সেদিক হলেই সহস্র মানুষের মৃত্যু অনিবার্য হয়ে উঠতে পারত। সম্মোহিত লাখো মানুষ তাকিয়ে আছে বঙ্গবন্ধুর দিকে। তিনি সূচনা করলেন, ‘ভায়েরা আমার, আজ দুঃখ ভারাক্রান্ত মন নিয়ে আপনাদের সামনে হাজির হয়েছি। আপনারা সবই জানেন এবং বোঝেন। আমরা আমাদের জীবন দিয়ে চেষ্টা করেছি। কিন্তু দুঃখের বিষয়, আজ ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা, রাজশাহী, রংপুরে আমার ভাইয়ের রক্তে রাজপথ রঞ্জিত হয়েছে। আজ বাংলার মানুষ মুক্তি চায়। বাংলার মানুষ বাঁচতে চায়। বাংলার মানুষ আজ তাদের অধিকার চায়।...’

বঙ্গবন্ধু বললেন, ‘কী পেলাম আমরা? আমার পয়সা দিয়ে অস্ত্র কিনেছি। বহিঃশত্রুর আক্রমণ থেকে দেশকে রক্ষা করার জন্য। আজ সেই অস্ত্র ব্যবহার হচ্ছে আমার দেশের গরিব-দুঃখী নিরস্ত্র মানুষের বিরুদ্ধে। তার বুকের উপর হচ্ছে গুলি। আমরা পাকিস্তানের সংখ্যাগুরু। আমরা বাঙালিরা যখনই ক্ষমতায় যাবার চেষ্টা করেছি, যখনই এ দেশের মালিক হবার চেষ্টা করেছি, তখনই তারা আমাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছেন। তারা আমাদের ভাই। আমি বলেছি তাদের কাছে এ কথা। যে আপনারা কেন আপনার ভাইয়ের বুকে গুলি মারবেন? আপনাদের রাখা হয়েছে যদি বহিঃশত্রু আক্রমণ করে তা থেকে দেশটাকে রক্ষা করার জন্য।

ভাইয়েরা আমার, ২৫ তারিখে অ্যাসেম্বলি কল করেছে। রক্তের দাগ শুকায় নাই। আমি ১০ তারিখে বলে দিয়েছি যে ওই শহীদের রক্তের উপর পাড়া দিয়ে আরটিসিতে মুজিবুর রহমান যোগদান করতে পারে না। অ্যাসেম্বলি কল করেছে। আমার দাবি মানতে হবে। প্রথম, সামরিক আইন মার্শাল ল উইথড্র করতে হবে। সমস্ত সামরিক বাহিনীর লোকদের ব্যারাকে ফেরত নিতে হবে। যেভাবে হত্যা করা হয়েছে, তার তদন্ত করতে হবে। আর জনগণের প্রতিনিধির কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে। তারপর বিবেচনা করে দেখব, আমরা অ্যাসেম্বলিতে বসতে পারব কি পারব না। এর পূর্বে অ্যাসেম্বলিতে বসতে আমরা পারি না। জনগণ সে অধিকার আমাকে দেয় নাই।

ভায়েরা আমার, তোমাদের আমার উপর বিশ্বাস আছে? আমি প্রধানমন্ত্রিত্ব চাই না। আমরা এ দেশের মানুষের অধিকার চাই। আমি পরিষ্কার অক্ষরে বলে দিবার চাই যে, আজ থেকে এই বাংলাদেশে কোর্ট-কাচারি, আদালত-ফৌজদারি, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ থাকবে। গরিবের যাতে কষ্ট না হয়, যাতে আমার মানুষ কষ্ট না করে, সে জন্য সমস্ত অন্যান্য যে জিনিসগুলো আছে, সেগুলির হরতাল কাল থেকে চলবে না। রিকশা, গরুর গাড়ি চলবে। রেল চলবে, লঞ্চ চলবে। শুধু সেক্রেটারিয়েট, সুপ্রিম কোর্ট, হাইকোর্ট, জজকোর্ট, সেমি গভর্নমেন্ট দপ্তরগুলো, ওয়াপদা কোনো কিছু চলবে না। ২৮ তারিখে কর্মচারীরা বেতন নিয়ে আসবেন। এর পরে যদি বেতন দেওয়া না হয়, আর যদি একটা গুলি চলে, আর যদি আমার লোকদের হত্যা করা হয়, তোমাদের কাছে আমার অনুরোধ রইল, প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলো। তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করতে হবে। এবং জীবনের তরে রাস্তাঘাট যা যা আছে সবকিছু, আমি যদি হুকুম দিবার নাও পারি, তোমরা বন্ধ করে দেবে। আমরা ভাতে মারব। আমরা পানিতে মারব। তোমরা আমার ভাই। তোমরা ব্যারাকে থাকো। কেউ তোমাদের কিছু বলবে না। কিন্তু আর আমার বুকের উপর গুলি চালাবার চেষ্টা করো না। ভালো হবে না। সাত কোটি মানুষকে দাবায়ে রাখতে পারবা না। আমরা যখন মরতে শিখেছি, তখন কেউ আমাদের দাবাতে পারবে না। আর যে সমস্ত লোক শহীদ হয়েছে, আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছে, আমরা আওয়ামী লীগের থেকে আওয়ামী লীগ অফিসে রিলিফ কমিটি করা হয়েছে। যদ্দুর পারি তাদের সাহায্য করতে চেষ্টা করব। যারা পারেন আমার রিলিফ কমিটিতে সামান্য টাকাপয়সা পৌঁছিয়ে দেবেন। আর এই সাত দিন হরতালে। যে সমস্ত শ্রমিক ভাইরা যোগদান করেছেন, সান্ধ্য আইনের জন্য যোগদান করতে পারেন নাই, প্রত্যেকটা শিল্পের মালিক তাদের বেতন পৌঁছায়ে দেবেন। মনে রাখবেন, সরকারি কর্মচারীদের বলি, আমি যা বলি তা মানতে হবে। কাউকে যেন সেক্রেটারিয়েটে, হাইকোর্টে, জজকোর্টে দেখা না যায়। দ্বিতীয় কথা, যে পর্যন্ত আমার এই দেশের মুক্তি না হবে, খাজনা-ট্যাক্স বন্ধ করে দেওয়া হলো। কেউ দেবে না।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান
প্রতিকৃতি: মাসুক হেলাল

শোনেন, মনে রাখবেন, একটা অনুরোধ আপনাদের কাছে, শত্রুবাহিনী ঢুকেছে ছদ্মবেশে, নিজেদের মধ্যে আত্মকলহ সৃষ্টি করবে। লুটপাট করবে। এই বাংলায় হিন্দু-মুসলমান বাঙালি-অবাঙালি যারা আছে, তারা আমাদের ভাই। তাদের রক্ষার দায়িত্ব আপনাদের উপরে। আমাদের যেন বদনাম না হয়। মনে রাখবেন, দ্বিতীয় কথা হলো এই যে, যদি আবার কোনো রকমের কোনো আঘাত আসে, আমি যদি হুকুম দেবার নাও পারি, আমার সহকর্মীরা হুকুম দেবার না পারে, মনে রাখবেন, আরেকটা কথা অনুরোধ করছি, রেলওয়ে চলবে সত্য কথা। কিন্তু সামরিক বাহিনীর লোকদের কোনো জায়গা থেকে আরেক জায়গায় নেবার চেষ্টা করবেন না। তাহলে দুর্ঘটনা ঘটলে আমি দায়ী হব না।

মনে রাখবেন রেডিও–টেলিভিশনের কর্মচারীরা, যদি রেডিওতে আমাদের কথা না শোনে, তাহলে কোনো বাঙালি রেডিও স্টেশনে যাবেন না। যদি টেলিভিশন আমাদের নিউজ না দেয়, কোনো বাঙালি টেলিভিশনে যাবেন না। দুই ঘণ্টার মতো ব্যাংক খোলা থাকবে। যাতে মানুষ তাদের মায়নাপত্র নিবার পারে। কিন্তু পূর্ব বাংলা থেকে পশ্চিম পাকিস্তানে এক পয়সাও চালান হতে পারবে না। টেলিফোন টেলিগ্রাম আমাদের এই পূর্ববাংলায় চলবে এবং বিদেশের সঙ্গে নিউজ পাঠাতে চালাবেন। কিন্তু যদি এ দেশের মানুষকে খতম করার চেষ্টা করা হয়, বাঙালিরা বুঝে–শুনে কাজ করবেন।

ভাইয়েরা, এখনই শুনলাম আমার বক্তৃতা রিলে করা বন্ধ করে দিয়েছে। আপনারা পেয়ার চালায়ে দেন, কারও হুকুম মানতে পারবেন না। তবে আমি অনুরোধ করছি। আপনারা আমাদের ভাই। আপনারা দেশকে একেবারে জাহান্নামে ধ্বংস করে দিয়েন না। জীবনে আর কোনো দিন আপনাদের মুখ দেখাদেখি হবে না। যদি আমরা শান্তিপূর্ণভাবে আমাদের ফয়সালা করতে পারি, তাহলে অন্ততপক্ষে ভাই ভাই হিসাবে বাস করার সম্ভাবনা আছে। সেই জন্য আপনাদের অনুরোধ করছি, আমার এই দেশে আপনারা মিলিটারি শাসন চালাবার চেষ্টা করবেন না। দ্বিতীয় কথা, প্রত্যেক গ্রামে, প্রত্যেক মহল্লায়, প্রত্যেক ইউনিয়নে, প্রত্যেক সাবডিভিশনে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে সংগ্রাম পরিষদ গড়ে তোলো। এবং তোমাদের যা কিছু আছে, তাই নিয়ে প্রস্তুত থাকো। মনে রাখবা রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরও দেব। এই দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব ইনশা আল্লাহ। এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।
ভাইয়েরা আমার আপনারা ঠান্ডা হবেন না। ঠান্ডা হয়ে গেলে জালেম আত্মা আরম্ভ করবে আক্রমণ। আপনারা হুঁশিয়ার থাকবেন এবং প্রস্তুত থাকবেন। পজিশন চলবে। কিন্তু মনে রাখবেন, ডিসিপ্লিন সোলজার ছাড়া, ডিসিপ্লিন ছাড়া কোনো জাতি জিততে পারে না। আপনারা আমার উপরে বিশ্বাস নিশ্চয়ই রাখেন। জীবনে আমার রক্তের বিনিময়েও আপনাদের সঙ্গে বেইমানি করি নাই।
শেষ...

আরও পড়ুন