পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ বাবা

প্রতীকী ছবি

আফিফের গায়ে ভীষণ জ্বর। একটু পরপর সে কেঁপে কেঁপে উঠছে। মা রহিমা বেগম ছেলের মাথায় পানি দিচ্ছেন আর বলছেন, ‘তোর কিচ্ছু অইব না বাপ। খানিক পর এমনিতেই সাইরে যাইব। চোখ বুজে থাক। আমি তোর মাথায় জল ঢেলে দিতাছি।’

আফিফ বলল, ‘মা, আমার সারা গায়ে কে যে আগুন লাগিয়ে দিচ্ছে। আমি পুড়ে যাচ্ছি। একটু একটু করে। তোমার কিছু করা লাগবে না। শুধু মাথায় একটু হাত বুলিয়ে দাও।’

বাইরে প্রচুর বৃষ্টি। আলতাফ হোসেন বারান্দায় দাঁড়িয়ে আফিফের সব কথা শুনছেন। ছেলের এ অবস্থা সহ্য করতে পারছেন না। রাতও অনেক হয়েছে। শহরের সব ফার্মেসি হয়তো বন্ধ হয়ে গেছে।

বৃষ্টিও কমছে না। যেতেও পারছেন না। বারান্দায় দাঁড়িয়ে একটা সিগারেট ধরালেন। বারবার বাতাসে নিভে যাচ্ছে। সিগারেটও ধরছে না। অনেক কষ্ট করে দু–একটা টান দিয়ে ফেলে দিলেন।

রহিমা চেঁচিয়ে বললেন, ‘ও গো, এট্টু যাইয়ে দেহো না। মেইন রোডের পাশে বড় একটা ফার্মেসি আছে। শুনছি সব সময় খোলা থাহে। হয়তো ডাক্তার–টাক্তার এখনো আছে। দ্যাহো না। পোলাডা কেমন জানি করতাছে।’

পুরো আকাশ অন্ধকার। ঝুম বৃষ্টি। আশপাশে কোনো লোকজন নেই। প্রচণ্ড বাতাস। ভয়ংকর গর্জন করছে আকাশ। আলতাফ হোসেনের হাত থেকে ছাতা উড়ে যাওয়ার উপক্রম। স্থির হয়ে তিনি দাঁড়িয়ে থাকতে পারছেন না। যেন বাতাস তাকে উড়িয়ে নিয়ে যেতে চাইছে।

রাস্তার ওপাশে একটা ফার্মেসি এখনো খোলা। এপাশ থেকে দেখা যাচ্ছে। হয়তো হঠাৎ বৃষ্টির কারণে বন্ধ করে যেতে পারেনি।

দূরপাল্লার দু–একটা গাড়ি এখনো চলছে। ঢাকা শহরের রাস্তায় সব সময় যানজট থাকে। ড্রাইভাররা একটু রিস্ক নিয়ে চোখের পলকে শাঁ শাঁ শব্দ তুলে চলে যাচ্ছে।
আলতাফ হোসেন দু–একবার তাকিয়ে দেখলেন। কোনো গাড়ি নেই। দ্রুতগতিতে রাস্তা পার হচ্ছেন। হঠাৎ পেছন থেকে এক ঘাতক ট্রাক এসে...
আফিফ বাবার লাশের পাশে বসে আছে। তার চোখে পানি নেই। বৃষ্টি এসে সব ধুয়ে–মুছে নিয়ে গেছে। আফিফের চোখে বারবার ভেসে উঠছে তার বাবার স্মৃতি...
এই তো সেদিনের কথা। জানুয়ারি মাস। স্কুলে নতুন বই দিয়েছে। কী যে আনন্দ আফিফের চোখমুখে। একটু পরপর বইয়ের মধ্যে মুখ গুঁজে ঘ্রাণ নিচ্ছে। আহা, কী যে মিষ্টি ঘ্রাণ! মনে হচ্ছে, বইগুলো পানি দিয়ে মিশিয়ে খেয়ে ফেলি।

বই নিয়ে বাসায় এল। রাতে আলতাফ হোসেন সব কটা বই দেখতে লাগলেন। দু–একটা পৃষ্ঠা উল্টেপাল্টে দেখে বললেন,
‘বাহ, কী সুন্দর, তাই না?’
আফিফ মাথা নেড়ে বলল, ‘হুম। অনেক সুন্দর।’
‘খুব ভালো করে পড়বা, কেমন?’
রাতে আফিফের বাবা পুরোনো ক্যালেন্ডারের পাতা ছিঁড়ে বইয়ের মলাট লাগিয়ে দিতেন।

আফিফ বাবার গা ঘেঁষে বসে বসে দেখত। একটা বইয়ের মলাট শেষ হলে দৌড়ে গিয়ে আফিফের বিছানার বালিশের নিচে চাপ দিয়ে রেখে আবারও বাবার পাশে এসে বসত সে। বাবার হাতের সুন্দর কাজ দেখত!আফিফের কাছে তখন মনে হতো, পৃথিবীর সুন্দর হস্তশিল্পী তার বাবা!

আফিফ চিৎকার করে কাঁদতে চাইছে। কিন্তু কাঁদতে পারছে না। বাবাকে খুব মনে পড়ছে। কাঁদতে তার আজ ভীষণ কষ্ট হচ্ছে...
* মনজুর সা’দ, কসবা, শেরপুর