পাড়ি জমানো

ছবি: সংগৃহীত

১.
সবুজ দেশের এক অজপাড়াগাঁ। গাঁয়ের গায়ে লেপ্টানো সবুজ চাদর। চোখ জোড়া যেখানেই যায়, ভেসে ওঠে সবুজবীথি। রয়েছে সবুজ মাঠ। সেই সবুজ মাঠে তুলতুলে ঘাসের বিছানার একপাশে জুতা জোড়া খুলে আনমনা হয়ে বসে আছে মাসুদ। অপলক নয়নে তাকিয়ে আছে আকাশ পানে। জো নেই চোখের পল্লব ফেলার! আকাশটাও বেশ ঝকঝকা রঙের। ফকফকা বললেও বোধকরি ভুলটুল হবে না। মাসুদের একদৃষ্টে তাকানোর ভঙ্গিমায় মনে হচ্ছে, কী যেন খুঁজে বেড়াচ্ছে আকাশ মাঝে।

চোখ-মুখে ভাস্ববান শোক তারার ঘনঘটা। আঁখিযুগল খর্ব হয়ে আছে। দেখাচ্ছে প্রায় মোরগের চোখের মতন। অধরযুগল শুকিয়ে শুঁটকিপ্রায়। মাসুদের মুখাবয়ব জানান দিচ্ছে, সবে গোজার হচ্ছে—গ্রীষ্মকাল। অথচ প্রকৃতিকে এখনো আগলে রেখেছে হেমন্তের মনোমুগ্ধকর সব আয়োজন। হেমন্তের পাগল করা দখিনা হাওয়া সজোরে ধাক্কা খাচ্ছে মাসুদের মুখাবয়বে। মাসুদের এমন মনখারাপের দিনে খানিকটাও দোষী নয়, অমলিন নিসর্গ। অযথাই দোষারোপ করা যাবে না, এ মোহময় সবুজ অবনীকে। তাহলে হাসিখুশি লেপ্টে থাকা মাসুদের মুখাবয়বের কেন এমন হাল? কেন তার গা থেকে ভেসে আসছে মানব পোড়ার ঘ্রাণ? কেন এ মোহ লাগানো গাঁ-গ্রামকে দোষনীয় করে দিচ্ছে মাসুদের হৃদয়ে জ্বলন্ত অগ্নিশিখা?

২.
মাসুদ। মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলে, যেন এক—শান্তমূর্তি। মা-বাবা, ছোট্ট বোন আর মাসুদকে নিয়েই তাদের ঘরসংসার। বাবা বেশ নম্র, ভদ্র আর শান্ত গোছের লোক। আশপাশের সাতটি গাঁ-গ্রাম তলব করেও এমন মানুষ মেলানো দুষ্কর। বাবার ছোটখাটো ব্যবসা। স্বল্প আয় থেকে স্বল্প ব্যয়। এমন হালেই অতীত হচ্ছে মাসুদদের সুখময় আর স্বস্তিসম্পন্ন দিনাতিপাত। গুজরান হচ্ছিল মধুময় জীবন। কোনো এক রজনী! অমাবস্যা যামিনী। স্বাচ্ছন্দ্যের রঙিন মখমল চাদর ফুটো করে মাসুদদের সুখের কুটিরে নেমে এল—শোকের কালো-মলিন ছায়া। বাবা আক্রান্ত হলেন ভীষণ পেটব্যাথায়। করুণ চিৎকার, চেঁচামেচি। শেষমেশ ডাক্তার ডাকবার আগেই পাড়ি জমালেন...! মৃত্যুর চাদরে আবৃত হলেন মাসুদের বাবা। গগনতলে অসহায় করে রেখে গেলেন আপন স্ত্রী আর সন্তানদের। যোগ দিলেন মৃত্যুর মিছিলে। সাজলেন ওপারের পথিক। ওদিকে মাসুদ সবে কলেজে ভর্তি হয়েছে! ক্লাসে বসার সুযোগটাও হয়নি তার। জীবনের পরিপূর্ণ সংজ্ঞাটাই তার জানা হয়নি আজ অবধি। মাসুদের জানা নেই ‘সংসার’ কী! তার কাছে জগতের সবচেয়ে অপরিচিত সংজ্ঞা—‘জীবনের হাল ধরা’। সংজ্ঞাটা না-ই জানা থাক!
তবু তো নামতে হবে—জীবনযুদ্ধে। ধরতে হবে জীবনতরির হাল! বাঁচার সংজ্ঞা শেখাতে হবে নিজেকে, মা আর ছোট্ট বোনটাকে। অবতীর্ণ হতে হবে বেঁচে থাকার এই দুর্গম যুদ্ধে...

অলংকরণ: আরাফাত করিম

৩.
মাসুদকে বেশ হাসিখুশি দেখাচ্ছে আজ। মলিন চেহারা থেকে বোধ হয় মিটে গেছে শোকের কালো রেখা। চোখেমুখে লেগে আছে আহ্লাদের রঙিন চাদর। বিষাদের তীব্র-করুণ ছায়া কি তাহলে রূপ নিয়েছে ঝলমলে ফকফকা রোদে! তাহলে কি আবার আওড়ানো যাবে—মেঘের কোলে রোদ হেসেছে বাদল গেছে টুটি।
খুশি ভাগাভাগি করতে মাসুদ মামাতো ভাইকে সঙ্গে করে নিয়ে এসেছে। সঙ্গে আছে মামাতো ভাইয়ের মোটরসাইকেলটাও। দুজনের চেহারাই হাস্যোজ্জ্বল। যেন খুশির দ্যুতি ছড়াচ্ছে! মেঘলা আকাশ মাঝে সোনালি রোদের আভাস যেন! খুশির হেতুটা কী? মাসুদের সুখ-দুঃখের সাথি সেজে ভীষণ জানতে ইচ্ছা হয় আমার! আমি মনে করি; জানাটা অতি প্রয়োজন।

৪.
গত হওয়া দিনগুলোর কোনো এক ক্ষণে এক সুহৃদের সুনজর পড়েছিল মাসুদের ওপর। সুহৃদ ব্যক্তি আগে থেকেই সবজান্তা; মাসুদের করুণ অবস্থা সম্পর্কে। তাই জীবনযুদ্ধে জয়ী বানাতে দয়ার হাত বাড়িয়ে দিলেন মাসুদের দিকে। গাঁয়ের আরও পাঁচ-সাতটা ছেলের সঙ্গে মাসুদকেও সুযোগ করে দিলেন—ফায়ার সার্ভিসে যোগ দেওয়ার। আবেদনপত্রসহ অন্যান্য কাজকাম করে জয়েন করার অনুরোধ জানিয়েছিল মাসুদও। ভাগ্যের নির্মম পরিহাস! মাসুদ ছাড়া সবার চাকরি হয়ে গেল।

কী যেন সমস্যা আর গন্ডগোল পেকে গেল—মাসুদের কাগজপত্রে। বিষাদের চাদরটা যেন আরও গাঢ় হতে শুরু করেছিল মাসুদের। অতিরিক্ত দৌড়ঝাঁপ আর হা-হুতাশে যাপন হলো আরও কটা দিন। যাহোক শেষমেশ চাকরিটা হয়েছে বলে সংবাদ এল গতকাল। হয়তো মাসুদ আজ সেই খুশিতেই আত্মহারা! মামার দয়াপরবশ হয়ে মায়ের কাছে রেখে যাওয়া টাকা থেকে কিছু টাকা নিয়ে নিল সে। মামাতো ভাইকে সঙ্গে করে রওনা দিল মোটরসাইকেলে চড়ে। আহ্, শোকের ওপর শোক আড়ালে তার কী হাসে!
মাসুদ আর তার মামাতো ভাই, দুজনের ভাগ্যেই ছিল এক নির্মম দুর্ঘটনার সম্মুখীন হওয়া। অ্যাকসিডেন্ট করল দুজনেই। মামাতো ভাইয়ের হালচাল কিছুটা ভালো হলেও মাসুদের অবস্থা বেগতিক! উপস্থিত লোকেরা ধরাধরি করে হাসপাতাল নিল দুজনকে। আহমাদ যখন লাইফ সাপোর্টের রুমে তখন রাতদুপুর। ১২টা বাজতে ৩ মিনিট বাকি। ঘড়ির কাঁটা ঘোরার মধ্য দিয়ে ১২টা বাজবে বটে! তবে মাসুদের জন্য নয়! ১২টা বাজার আগেই বেজে উঠল—মাসুদের মৃত্যুঘণ্টা। সে এখন এপারের কেউ না! সে ওপারের যাত্রী! মা আর ছোট্ট বোনটাকে রেখে হয়তো ভাব জমাচ্ছে বাবার সঙ্গে! সে মুক্ত এ সংসার থেকে। সংসারের সব ঝামেলা থেকে! সে এখন ভিন্ন পথের পথিক...

পরিশিষ্ট
মাসুদ সেদিন খোলা আকাশের শামিয়ানার নিচে বসে কী চিন্তায় লিপ্ত ছিল? কেন তার চেহারায় ভেসে উঠেছিল দুশ্চিন্তার স্পষ্ট ছাপ? সে কি বাবার চলে যাওয়ার কষ্ট ভোলার তাগিদে বসেছিল সেখানটায়? নাকি সে জানত সে-ও পথিক সাজবে বাবার পথের, তাই দুঃখ করছিল মা আর ছোট্ট সে বোনটির জন্য?
আকাশে ঘুরে বেড়ানো মেঘপুঞ্জে কী খুঁজে বেড়াচ্ছিল সে?
সে কি মেঘেদের মেলায় খুঁজে বেড়াচ্ছিল—বাবার অবয়বখানা? শেষতক কী করে গেল সে?
নাহ্, আমার জানা নেই সে কী করতে পেরেছিল!
তবে আমি এতটুকুই জানি; সে তার দুঃখিনী মা আর হতভাগিনী বোনের জন্য কিছুই করতে পারেনি!

তার পাড়ি জমাবার পর, কী অবস্থা হয়েছিল দুঃখিনী মায়ের? বেঁচেছিল কি তার দুঃখবিলাসী বোনটি? নাকি মা আর বোনটিও চলে গিয়েছিল আহমাদের খোঁজে?
মৃত্যুর সন্ধানে? টাকাগুলো নিয়ে মাসুদ কেন যাচ্ছিল কোনো এক রেস্তোরাঁয়? তার কি ইচ্ছা ছিল সবাইকে মিষ্টিমুখ করানোর? তাই যদি হয়! তবে কেন তাদের হৃদয়ে ঢেলে দিল—আকাশভরা বিষাদ?

লেখক: মুহাম্মাদ আব্দুল কাদির, শিক্ষার্থী, এম সাইফুর রহমান কলেজ, কোম্পানীগঞ্জ, সিলেট