পাহাড় সমুদ্রের গল্প

মহাসড়কটি এক লেইন থেকে দুই লেনে পরিবর্তিত হয়ে চারগুণ বড় হওয়ার বহু আগেই এর দুপাশের দৃশ্যগুলো পাল্টে গিয়েছিল। উঁচু উঁচু নলীর মুখ চিরে ধোঁয়া ওঠা ইটের ভাটাগুলো প্রথমে গায়েব হলো। পুবের সবুজে ঘেরা উঁচু পাহাড়গুলো তখনো বেশ গর্বের সঙ্গে নিজের অস্তিত্ব জানান দিত। দুই স্ট্রোকের বেবিট্যাক্সি বা শুভপুর বাসস্ট্যান্ডের মুড়ির টিন নামধারী ৪ নম্বর বাসে বাড়ি যাওয়ার পথে পাহাড়গুলোর একটির শিরে সিমেন্ট বাঁধায় চক রঙে রাঙা খোদাই করা বাণী ‘চির উন্নত মম শির’ লেখাটি আমার শিশুমনে গেঁথে যায়! আরও বহু পরে কৈশোরের শেষে বুঝতে পারি, এটি শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ এক কবির অমর কবিতার ক্ষুদ্র এক পঙ্‌ক্তিমাত্র।

কবিতার প্রতি কোনো অনুরাগ তখনো গড়ে ওঠেনি, বিদ্যালয়ের পাঠ্যবইয়ে জ্ঞান উন্মেষের জন্য ছাপিয়ে দেওয়া কবিতাগুলো দুরূহ মনে হতো। পরীক্ষায় মুখস্থ প্রশ্নের মুখস্থ উত্তর দিতে পারলেই খুশি। কবিতা তখনো মনকে ছুঁতে পারেনি। আরও অনেক পরে অনুভবে আসে কবিতারও বুঝি অনেক শক্তি, কোন কোন কবিতা একটা মানুষকে আমূল বদলে দিতে পারে। তারপরও ‘চির উন্নত মম শির’ বাক্যটি আমাকে মন্ত্রমুগ্ধ করে রাখে সেই শিশুকালেই। মিলিটারি একাডেমি পার হওয়ার আগেই চোখযুগল স্থির হয়ে যেত আকাশের কাছাকাছি পুবের পাহাড়চূড়ার দিকে। আমার যানের দানবীয় শব্দের গতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে যেন পাহাড়গুলোও ছুটতে চাইত। একসময় তাল হারিয়ে পেছনে অদৃশ্য হতো চেনা অতীতের মতো।

রাস্তার দুপাশে দিগন্তবিস্তৃত সবুজ জমিগুলো তখনো দানবীয় কারখানা হয়ে ওঠেনি। সবেমাত্র ইটের সীমানা ঘিরে তৈরি হচ্ছিল বৃহৎ শিল্প হয়ে ওঠার জন্য। আমার মন কখনো এত গভীর চিন্তার সুযোগ পেত না, কাল জমিগুলোর কী হবে? তবে রাস্তার ধারে গড়ে ওঠা ইটের সীমানাপ্রাচীরগুলোর ওপর লিখে দেওয়া স্লোগানগুলো কৌতূহলের ঢেউ তুলে দিত ছোট্ট মনে। আরও পরে বুঝতে পারি, স্লোগানগুলো বিভিন্ন মতাদর্শের রাজনৈতিক দলের মৃদু প্রচার। তখনো স্বৈরচার বাংলার মসনদ দখল করে আছে। উঠতি বয়সী তরুণদের অনেকের চোখে স্বৈরাচার উৎখাতের নেশা। মাঝেমধ্যে মিছিল, সাজানো নির্বাচন, কারফিউ। জমিগুলোর শিল্পে বেড়ে ওঠার মতো আমিও বেড়ে উঠছি। তখন আমার শরীরে কৈশোরের চিহ্ন আর আমার দেশটি মোটে প্রাপ্তবয়স্ক।
সময়ের গাড়ি আপন গতিতে এগিয়ে গেছে, স্বৈরাচার টেকেনি, তত্ত্বাবধায়ক টেকেনি, টেকেনি অনেক রাজনীতি, কূটনীতি, আস্তিক আর নাস্তিকের মতাদর্শ। এমনকি টেকেনি আমার শৈশব আর কৈশোরও! সময়ের অঙ্কে এই নিদানকালে আজ আমি মধ্যবয়স্ক। সীমানা দেওয়া কৃষিজমিগুলো আজ ছোট, মাঝারি আর বৃহৎ শিল্প। সীমানাদেয়াল আরও দৃঢ় মজবুত হয়ে উৎপাদনমুখী হয়ে উঠেছে। রাতদিন সেখানে ঘুরছে উৎপাদনের চাকা, উৎপাদন হচ্ছে মানুষের রুজি আর রুটি।

দুই লেনের রাস্তা ধরে এখন এক ঘণ্টার পথ ১০ মিনিটের হয়েছে। সবুজ পাহাড়গুলো এখন বড় বড় কারখানা আর স্থাপত্যের ভিড়ে কিঞ্চিৎ দেখা যায়। তারপরও ক্যাডেট কলেজ পার হলেই আমি ওই সবুজ পাহাড়গুলোকে খুঁজি, যেন একান্ত কোনো স্বজন। জমি ফুঁড়ে গজিয়ে ওঠা দালানকোঠার ভিড়ে আমি ওই উঁচু পাহাড়টাকে খুঁজি, সেই পাহাড়ের গায়ে খুঁজি সেই অমর পঙ্‌ক্তি।

অনেক দিন আগের কথা, এই পাহাড়গুলোর পথ ধরে একদিন এক বিশাল পাহাড়ের নিচে এসে দাঁড়ালাম। কী বিশাল যে মনে হচ্ছিল সেই পাহাড়কে, মনে হচ্ছিল তার শির বুঝি মেঘের খুব কাছাকাছি। স্থানীয় লোকজন এই পাহাড়কে ডাকে সীতার পাহাড়। নিচ থেকে খাড়া সিঁড়ি বেয়ে একদম ওপরে উঠে গেছে এক রাস্তা, মনে হচ্ছিল এই রাস্তাটা যেন কোনো মেঘের সঙ্গে মিশে গেছে। আমার মতো দু-একজনকে দেখলাম মেঘের পথ ধরে উঠতে শুরু করেছে। আমার শহুরে মনে ভয়ের ছায়া, আবার অবাধ্য কৌতূহলে এগিয়ে দিল মেঘের রাজ্য জয় করতে। আমিও উঠতে শুরু করলাম শত সহস্র সিঁড়ি ভেঙে একেবারে ওপরে, মেঘের দেশে। ভয়, কষ্ট, ক্লান্তি আর উৎকণ্ঠা জয় করে চূড়ায় উঠে দেখলাম মেঘ এখনো বহুদূরে!

পাহাড়ের শিরে স্থবির হয়ে আছে এক মন্দির, কোনো এক পুরোহিত তাতে পূজার আয়োজন করছে। সঙ্গীরা বলল, এখানে অনেক বড় পূজা হয়, শত সহস্র পুণ্যার্থী আসেন পূজা দিতে। তখন আর এত নিরিবিলি থাকে না জায়গাটা। পাহাড় হয়ে যায় লোকে লোকারণ্য। কথাগুলো শোনার পর নিজেকেও যেন পুণ্যার্থী মনে হলো! আমার স্রষ্টাও আছেন আরও ওপরে কোথাও। অনেক মায়ায় হয়তো দেখছেন আমাকেও।

মহাসড়কের পশ্চিম দিকের কথা না বললে কাহিনি পূর্ণ হবে না। ওই দিকে বিশাল সমুদ্র নীলিমায় মিশে আছে। পাড়ে নোঙর করা দানবীয় সব জাহাজ। কোনোটির অর্ধেক নেই, কোনোটির শুধু কিছু অংশ অবশিষ্ট আছে, আবার কিছু আছে একেবারে ঝকঝকে নতুনের মতন। জাহাজগুলোর সবার পরিণতি একই, খুবলে খুবলে এগুলোর ধাতব মাংস কাটা হবে। মানুষের চাহিদার ব্যাপকতা এই বিশাল দানব জাহাজগুলোর পরিণতি দেখলে কিছুটা অনুমান করা যায়! বিশাল দানবকে অংশে অংশে কেটে নিঃশেষ করে দেওয়া হয়। পুরো বিষয়টা এক মহাযজ্ঞ, এক বৃহৎ শিল্প!

এসব কার্যকলাপ উপেক্ষা করে সমুদ্রপানে চোখ ফেরালে মনে হবে অন্য প্রান্তে সাগর যেখানে শেষ, সেখানে আকাশ মিশে আছে। কৈশোরের শেষ বেলায় একদিন সেই আকাশ ধরতে সমুদ্রে সাম্পান নিয়ে অনেক ভাসি। দার বাইতে বাইতে ক্লান্ত মাঝি, কোথায় আকাশ? যেদিকে চোখ যায় শুধু নোনাজল। আকাশ তখনো অনেক দূরে থেকে হাসছে। আকাশের এই খেয়ালিপনা সব জায়গায়। রাতে মনে হয় আকাশ যেন গ্রহ, চন্দ্র, নক্ষত্র আর অনন্ত আঁধার কোলে নিয়ে বসে আছে! আর বিজ্ঞান বলছে, এরা সবাই লক্ষ-কোটি যোজন যোজন দূরে ঘুরছে আর আকাশ বলে কিছুই নেই। আকাশ এক কল্পনা, বায়ুমণ্ডলে সূর্যের আলোর খেলা।

আমরা কী বোকাটাই না ছিলাম। এমন বোকা, যারা বিজ্ঞান বোঝে না, ধর্ম বোঝে না, অর্থ আর অনর্থ বোঝে না। কিন্তু সমাজ আমাদের বোকা থাকতে দিল না। সমাজ কাউকে বোকা থাকতে দেবে না। সমাজ শেখাবে অর্থনীতি, রাজনীতি, বিজ্ঞান, ধর্ম, দর্শন, কালোটাকা, সাদাটাকা আরও কত কী! এত কিছু শেখার পরও এই নিদানকালে নিজেকে মনে হয় অসহায়। এখন এই জীবাণু-দিনে আমাদের বুকজুড়ে সমুদ্রের গর্জন। ফুসফুসের কোষগুলোর অক্সিজেনের জন্য করুণ কান্না। এক জীবাণু পুরো শরীরকে সমুদ্র বানিয়ে ফেলে। বুকের ওপর চাপা দিয়ে রাখে এক বিশাল পাহাড়।
*লেখক: মুহম্মদ কামরুল হাসান সিদ্দিকী, চট্টগ্রাম