পাঠকের কথা বলে যাবে প্রথম আলো

প্রথম ছবিটি মগবাজার এলাকার বেসরকারি আদ্ দ্বীন হাসপাতাল ও কলেজের গলির জলাবদ্ধতার। ছবিটি ১২ নভেম্বর প্রকাশ হয় নাগরিক সংবাদে। এই ছবি প্রকাশের পরই ১৪ নভেম্বর ওই সড়কের এ চিত্র দেখা গেল

‘নাগরিক সংবাদ কি বন্ধ হয়ে গেল? বন্ধ করলেন কেন?’ গত ২১ আগস্ট প্রথম আলো অনলাইনে নাগরিক সংবাদে কনটেন্ট তোলা না হওয়ায় এমন প্রশ্ন আসতে থাকে। নতুন সিএমএস (কনটেন্ট ম্যানেজমেন্ট সলিউশন) চালু হওয়ায় কদিন পর অবশ্য নাগরিকে কনটেন্ট তোলা আবার শুরু হয়। পাঠকের এমন প্রশ্ন বা প্রতিক্রিয়া আমাদের উৎসাহিত করেছে।

দেশ–বিদেশের পাঠকের কথা তুলে ধরতেই প্রথম আলো চালু করেছে ‘দূর পরবাস’ ও ‘নাগরিক সংবাদ’-এর মতো বিভাগগুলো। আমাদের রিজার্ভ ফুলে-ফেঁপে ওঠার অন্যতম কারিগরদের প্রবাস জীবনযাপন, তাঁদের সুখ-দুঃখ, আনন্দের কথা তুলে ধরতে ‘দূর পরবাস’ আর দেশের পাঠক তথা যাপিত জীবনে নাগরিক বিভিন্ন সমস্যার কথাতুলে ধরতে ‘নাগরিক সংবাদ’ চালু করা হয়। আর ইউজার জেনারেটেড কনটেন্টের (User-generated content–UGC) ধারণাকে প্রথম আলো আরও এগিয়ে নিয়ে যায় করোনাকালেও। এবার আমরা করোনা জীবনে ঘরবন্দী মানুষের কথা তুলে ধরি ‘করোনাকালের জীবনগাথা’য়।

এ বছরের ১১ এপ্রিল প্রথম আলোর ছাপা পত্রিকার ‘করোনাকালের জীবনগাথা’ ছাপানো শুরু হয়। আমরা ছাপা পত্রিকা ও অনলাইন সংস্করণ মিলে তিন শতাধিক দেশি-বিদেশি পাঠকের কথা তুলে ধরেছি। পাঠকের কথা তুলে ধরার নিরন্তর প্রচেষ্টায় ‘আস্থা রাখি আলোয়’ আমরা এবার শুরু করেছি।

নাগরিক সংবাদ

শিমু আক্তার

২০১৯ সালে জুনে নাগরিক সংবাদ শুরু হয়। এরপরই থেকে নিয়মিত পাঠকের লেখা প্রকাশ হয়েছে। প্রতিদিন পাওয়া ৪০-৫০টি কনটেন্টের মধ্য আমরা হয়তো পাঁ–সাতটি প্রকাশ করি। আরও করতে পারলে ভালো লাগত। দিনকে দিন পাঠকের বেশি বেশি কনটেন্ট আমরা প্রকাশ করব, এটুকু বলতে পারি। ২০১৯ সালের ১২ নভেম্বর রাজধানীর মগবাজার এলাকার আদ্ দ্বীন হাসপাতাল ও মেডিকেল কলেজের গলির কয়েকদিন ধরে জমে থাকা পানি ও এর জন্য নাগরিকদের কষ্ট ও দুর্ভোগের কথা তুলে ধরে কয়েকটি ছবি পাঠান মনজুর রহমান নামের পাঠক। এর একটি ছবি ওই দিন বিকেলে নাগরিক ছবি বিভাগে ক্যাপশনসহ প্রকাশিত হয়। এর দুদিনের মাথায় ১৪ নভেম্বর সকালে এলাকার মানুষ দেখেন, গলির ময়লা-দুর্গন্ধময় পানি সরে গেছে। ফলোআপ হিসেবে ১৪ নভেম্বর ‘নাগরিক সংবাদে ছবি প্রকাশের পরই সড়ক সংস্কার’ শিরোনামে খবরও প্রকাশ হয়। কে বা কারা পানি সরানোর কাজ করেছে, তা জানা না গেলেও একজন সচেতন নাগরিকের ছবি প্রকাশের পরই পথচলা মানুষের কষ্ট লাঘব হয়েছে।

গত ৯ জুন সাতক্ষীরার শ্যামনগরের শিক্ষার্থী শিমু আক্তারের এসএসসি পাস ও আর্থিক কারণে পড়া চালিয়ে যাওয়া নিয়ে সমস্যার কথা তুলে ধরে ‘অদম্য শিমুর জিপিএ-৫ পাওয়ার গল্প’ প্রকাশিত হয়। আবদুল আলিম নামের পাঠকের পাঠানো লেখাটি প্রকাশের পর উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) আ ন ম আবুজর গিফারী আটুলিয়া ইউনিয়নের যোগেন্দ্রনগর গ্রামে শিমু আক্তারের বাড়ি যান। লেখাপড়ার খোঁজ নিয়ে শিমুর বাবাকে তিনি বলেন, মেয়েকে বিয়ে দেবেন না। ইউএনও হিসেবে আমি শিমুর পড়ার দায়িত্ব নিলাম। শিমুকে পাঁচ হাজার টাকার প্রাইজ বন্ড উপহার হিসেবে দেন তিনি।

দিনাজপুরের নবাবগঞ্জ উপজেলার নবাবগঞ্জ-ভাদুরিয়া সড়ক সংস্কার ও নির্মাণাধীন সড়কে নিম্নমানের সামগ্রী ব্যবহারসহ কয়েকটি অভিযোগ নাগরিকেরা জমা দেন জেলার দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) অফিসে। অভিযোগ পেয়েই দুদকের একটি দল ঘটনাস্থলে যান। তাঁরা দেখেন কথা সত্যি। কাজ যথাযথভাবে করার জন্য সংশ্লিস্টদের নির্দেশও দেন কর্মকর্তারা। গত বছরের ২২ ডিসেম্বরের এ ঘটনার কথা তুলে ধরে আতিকুল ইসলাম চৌধুরীর পাঠানো লেখা ‘অভিযোগ পেয়ে রাস্তা খুঁড়ল দুদক, পেল সত্যতা’ শিরোনামে প্রকাশিত হয়। খবরটি দুদক তাদের ভেরিফাইড ফেসবুক পেজে শেয়ার দেন। সেখানে আসে পাঠকের ইতিবাচক মন্তব্য।
এ তিনটি ছোট ঘটনার মতো আরও অনেক ঘটনার ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া ও নাগরিক সমস্যার সমাধান হয়েছে খবর ও ছবি প্রকাশের পর।

দূর পরবাস

বিশ্বে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা প্রবাসীদের কথা ও জীবনের গল্প প্রথম আলো তুলে ধরে ‘দূর পরবাস’ বিভাগে। অভিবাসীবাসীদের সমস্যা, জীবনের গল্প, শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের এমফিল-পিএইচডি ও পড়াশোনার গল্প, না ফেরার দেশে যাওয়া স্বজনদের একবার শেষ দেখা দেখতে না পারার আকুতি, দেশে ফেলে যাওয়া স্মৃতি, একাকী জীবন, করোনায় যোগাযোগ বন্ধ হওয়ায় দেশে ফিরতে না পারার কষ্টসহ প্রবাসজীবনের আনন্দ, দুঃখ–বেদনার কথা তুলে ধরে দূর পরবাস। করোনার প্রবাস থেকে দেশের মানুষের পাশে দাঁড়ানো কিংবা বিদেশের মাটিতে বাংলাদেশিদের সাফল্যের কথাও তুলে ধরা হয় এখানে। আবার দেশ নিয়ে নিজেদের মজার স্মৃতিকথা ওঠে আসে পাঠকের কলমে। এ ছাড়া সমসাময়িক নানা ইস্যুতে সরব থাকেন প্রবাসীরা। যেমন, করোনায় চিকিৎসকদের নিয়ে যুক্তরাজ্যের আলী জাহানের লেখা ‘সাদা অ্যাপ্রোনকে সম্মান দিন’, আমেরিকান জর্জ ফ্লয়েডের মৃত্যুকে কেন্দ্র করে দেশটির প্রবাসী ফারহানা আহমেদ লিসার ‘জীবনের মূল্য ২০ ডলার মাত্র’, অষ্ট্রেলিয়ার কৃষি বিজ্ঞানী মোয়াজ্জেম খানের, ‘কোভিড-পরবর্তী বিশ্বে সম্ভাবনা বাংলাদেশের, ধরতে পারবে কি’, কানাডার নূর আলমের , ‘বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে করোনার জিনরহস্য উন্মোচন, সরকারিগুলো কী করছে’ প্রভৃতি।

করোনাকালের জীবনগাথা

এ বছরের ২৩ মে অনলাইনে ছাপানো বুয়েটের প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী অনিন্দ্য কিশোর চৌধুরীর লেখা, ‘বেলা আড়াইটা’ সবচেয়ে বেশি পাঠকপ্রিয়তা পেয়েছে। তাঁর লেখার শেষটা ছিল এমন— ‘আবারও একদিন বেলা আড়াইটা বাজবে। সারা দেশ থাকবে টিভির সামনে। কোনো বাংলাদেশের খেলার জন্য নয়, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ব্রিফিং শুরু হবে এ জন্য। নিঃশ্বাস আটকে থাকবে সবার। মীরজাদী সেব্রিনা খান ফ্লোরা শুরু করবেন প্রেস ব্রিফিং। তিনি বলবেন, ‘টানা ১৪ দিন দেশে কোনো করোনাভাইরাসের রোগী শনাক্ত হয়নি।’ বলা মাত্রই তিনি সুখের, বিজয়ীর অশ্রুতে ভেঙে পড়বেন, মাক্সটি খুলে ফেলবেন। আরে সেকি, ম্যাডাম কাঁদছে কেন! আশপাশে থাকা কর্মকর্তারা বিব্রত হয়ে যাবে, টিস্যু বক্স খোঁজার হিড়িক পড়ে যাবে। স্বামী তাঁর স্ত্রীকে জড়িয়ে ধরবে, মা তাঁর সন্তানকে কোলে তুলে নিয়ে চুমু খাবে, বৃদ্ধ বাবার চোখ চশমার ভেতরে ঝাপসা হয়ে উঠবে। মাহমুদুল্লাহ্ রিয়াদের ছক্কার সময়ের মতোই ঘর থেকে হর্ষধ্বনি ভেসে আসবে। চোখের পলকেই রাস্তা দিয়ে বিজয় মিছিল যাওয়া শুরু করবে, বুভুজেলা বাজবে। সম্মুখযোদ্ধাদের বীরত্বকে স্যালুট জানাতে গগনবিদারি শব্দে উড়ে যাবে যুদ্ধবিমান। আচ্ছা, আমি বেঁচে থাকব তো সেদিন?’

এ ছাড়া সুইডেনের ইয়াভলা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী নাসিফ রহমানের লেখা, ‘প্রায় প্রতিদিন দেখি মায়ের ব্রিফিং’। তাঁর মা অধ্যাপক নাসিমা সুলতানা বাংলাদেশের স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (প্রশাসন)। তিনি করোনা বিষয়ে ব্রিফ করতেন। কুমিল্লা সরকারি কলেজের সহকারী অধ্যাপক হালিমা আক্তারের ‘করোনায় ঘরবন্দী চাকরিজীবী মায়ের আত্মোপলব্দি’, রাজধানীর গৃহীনি ফারাহ যীবার ‘করোনাকালের ছুটি না অস্বস্তি’, গৃহিণী মাসুমা সিদ্দিকার, ‘স্কুলে যেতে যেতে মা-ছেলে কত গল্প করতাম’, যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী মো. আজাদুল ইসলাম সুমনের ‘টিউশনিতে চলা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীরা কেমন আছেন’ লেখাগুলো পাঠকপ্রিয়তা পেয়েছে।

এমন অনেক ঘটনা আমাদের কাছে লিখে পাঠান পাঠকেরা। আমরা তা তুলে ধরি মাত্র। এ যাত্রা অব্যাহত থাকবে অনাগত দিনেও।

*নাগরিকের জন্য [email protected] এবং দূর পরবাসের জন্য [email protected]–এ লেখা পাঠাবেন নিসংকোচে।

রাশেদুল আলম: প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ সহ সম্পাদক।