পর্যটন শিল্প: বিশ্ব অর্থনীতিতে মুখ্য ভূমিকা আর বাংলাদেশে কেবলই পরিকল্পনা

ছবি: আব্দুল্লাহ আল কাউসার মিলন

বঙ্গবন্ধুকে বর্ণনা করতে গিয়ে কিউবার বিপ্লবী নেতা ফিদেল ক্যাস্ত্রো বলেন, ‘আমি হিমালয় দেখিনি, কিন্তু শেখ মুজিবকে দেখেছি। ব্যক্তিত্ব ও সাহসিকতায় তিনি হিমালয়ের মতো’। একইভাবে বাংলাদেশ ভ্রমণে এসে বিশ্ববিখ্যাত পর্যটক ইবনে বতুতা আবিষ্কার করেছিলেন বাংলার মাটি, ফসল ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্য। তাঁর লিখিত ‘রিহালা’ গ্রন্থে এদেশের প্রকৃতি বর্ণনা করতে গিয়ে তিনি বারংবার বাংলাদেশ ভ্রমণের প্রয়াস ব্যক্ত করেন। তবে বর্তমানে যদি বিদেশি পর্যটকের সংখ্যা কিংবা এদেশ সম্পর্কে তাঁদের উপলব্ধি জানতে চাওয়া হয়, তাহলে নিতান্তই তদানিন্তন বাংলার সৌন্দর্য নিয়ে আফসোস চলে আসে। যেমনটি ঘটেছিল ২০১৬ সালে পর্যটন বর্ষে। ১০ লাখ বিদেশি পর্যটক আনার ঘোষণা দিয়েও তেমন কোনো সুফল না পাওয়া, যা ব্যর্থতার পাল্লাকেই ক্রমশ ভারী করে দিচ্ছে।

ওয়ার্ল্ড ট্রাভেল অ্যান্ড ট্যুরিজম কাউন্সিলের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশের জিডিপিতে পর্যটন ও ভ্রমণ খাতের অবদান ২ দশমিক ২ শতাংশ। কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে এ খাতের অবদান ১ দশমিক ৮ শতাংশ। ২০১৮ সালে পরোক্ষ কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে মোট কর্মসংস্থানের ৩ দশমিক ৮ শতাংশ এসেছে পর্যটন খাত থেকে। ২০১৯ সালে বিভিন্ন উদ্দেশ্যে বিদেশে গিয়েছেন সাড়ে ছয় লাখ বাংলাদেশি। বিপরীতে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসাব মতে, ২০১৯ সালে এদেশে বিদেশি পর্যটক এসেছেন মাত্র ২ লাখ ৬৭ হাজার ৭০৭ জন। কিন্তু প্রতিবছর ১০০ কোটির বেশি পর্যটক সারা বিশ্ব ভ্রমণ করেন। বিদেশে গিয়ে বাংলাদেশিরা কমপক্ষে সাড়ে ছয় হাজার কোটি টাকা খরচ করে আসছেন। এর বিপরীতে বাংলাদেশে আসছে মাত্র ১ হাজার ৩০০ কোটি টাকা। বাংলাদেশের মোট রপ্তানি আয়ে পর্যটন খাতের অবদান শূন্য দশমিক ৪৭ শতাংশ। যেখানে আমাদের গ্লোবাল ইন্ডিকেটর পণ্য রয়েছে ৯টি, কিন্তু যথাযথ ব্যবস্থার অনুপস্থিতিতে আমরা সেগুলো রপ্তানি করতে পারছি না। এসব প্রোডাক্টকে সামনে রেখে বিশ্ব দরবারে বাংলাদেশের নতুন করে পরিচিত হওয়ার সুযোগ ধীরে ধীরে ক্ষীণ হয়ে যাচ্ছে।

ভারতে বিদেশি পর্যটক বাড়ানো নিয়ে এক গবেষণায় দেখা যায়, উন্নতি করতে হলে আমলাতন্ত্রের হাত থেকে এ খাতকে বের করে আনতে হবে। কারণ, পর্যটন নিয়ে আলাদা আগ্রহ ও জানাশোনা থাকতে হয়। এটা প্রথাগত আমলাদের দিয়ে চালানো সম্ভব নয়। ভারতের পর্যটন মন্ত্রণালয় এখন চলছে মূলত গবেষক এবং এ খাতের বিশেষজ্ঞদের নিয়ে। বাংলাদেশেও এখন সেটা করতে হবে। পর্যটন মন্ত্রণালয়, করপোরেশন, বোর্ড—সব প্রতিষ্ঠান চলছে আমলাদের দিয়ে। এখানে পর্যটন খাতের বিশেষজ্ঞদের কোনো প্রতিনিধিত্ব নেই। বাংলাদেশে এত দিনেও একক পর্যটন আইন, ন্যাশনাল ট্যুরিজম ডেটাবেইস, ট্যুরিজম স্যাটেলাইট অ্যাকাউন্ট, কোয়ালিটি ট্যুরিজম সার্ভিস, প্রোডাক্ট ডেভেলপমেন্ট ও গবেষণা সেল তৈরি হয়নি। সারা পৃথিবীতে পর্যটন চলে পর্যটনের নিয়মে আর এদেশে পর্যটন চলে আমলাদের ইচ্ছায়। ফলে এতে না আছে ব্যবস্থাপনা, না আছে কোনো শৃঙ্খলা। পর্যটনের উন্নয়নে কিছু করতে গেলে দেখা যায় ১৯টি মন্ত্রণালয়ের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সম্পৃক্ততা আছে। এতে মহাপরিকল্পনা তৈরি করতে গিয়ে নানা বাধার সম্মুখীন হতে হয়।

মহাপরিকল্পনার আশায় স্বল্প মেয়াদের পরিকল্পনাও যথাযথভাবে বাস্তবায়িত হচ্ছে না। করোনা বিপর্যয় থেকে পর্যটন রক্ষার্থে এ খাতে সরকার–ঘোষিত প্রণোদনা প্যাকেজের ১৪ হাজার কোটি টাকা ক্ষতিগ্রস্ত কেউ পাননি। পর্যটনসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সংগঠন সরকারের কাছে সহায়তার দাবি জানিয়ে এলেও বাস্তবে কেউ সহজ শর্তে ঋণ নিতে পারছে না বলে অভিযোগ টোয়াবের। এমতাবস্থায় ছোট ছোট ট্যুর অপারেটরের টিকে থাকাও অসম্ভব হয়ে পড়েছে।

সরকারের এ খাত থেকে বিপুল অর্থ উপার্জনের সম্ভাবনা থাকলেও বরাবরই উপেক্ষিত থেকেছে। পর্যটনশিল্প বিকাশের পথে আমাদের পর্বতসম সমস্যা নিয়ে এগিয়ে যেতে হচ্ছে। আমাদের দেশের যোগাযোগব্যবস্থা যেমন খুব একটা সুবিধাজনক হয়ে ওঠেনি, তেমনি যাতায়াত খরচও তুলনামূলক বেশি হওয়ায় আমরা পর্যটক আকর্ষণে ব্যর্থ হচ্ছি। এখানকার হোটেল, মোটেল, রিসোর্টগুলোর খরচ বিশ্বের অন্যান্য পর্যটনবান্ধব দেশের তুলনায় অনেক বেশি হওয়ায় পর্যটকেরা আগ্রহ হারাচ্ছেন। দেশের পর্যটক আকর্ষণকারী স্থানগুলোতে নিরাপত্তার যথেষ্ট ঘাটতি রয়েছে। দিনে দুপুরে চুরি, ছিনতাইয়ের মতো ঘটনাও ঘটে থাকে। ফলে বিদেশি পর্যটকেরা নিরাপত্তার অভাবে ক্রমেই আকর্ষণ হারিয়ে ফেলছেন। সুন্দরবন নিয়ে উদাসীনতা নতুন কিছু নয়। নিজেদের সামান্য স্বার্থের আশায় ধ্বংস করে দেওয়া হচ্ছে এর জীববৈচিত্র্যকে। এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, সুন্দরবনের কল্যাণেই সিডর, আইলা, ফণির মতো ঘূর্ণিঝড়গুলোর শক্তিমত্তা এক–তৃতীয়াংশ হ্রাস পেয়েছে। এদেশের পর্যটনশিল্পের বিকাশে রাজনৈতিক অস্থিরতাও নেতিবাচক প্রভাব ফেলে থাকে।

আম্পান ও ইয়াস থেকে প্রমাণ হয়েছে সুন্দরবন উপকূলীয় অঞ্চলের লাখ লাখ জীবন বাঁচাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে

সম্প্রতি বিশ্বের দুটি বৃহৎ পর্যটনবিষয়ক স্টেজে বাংলাদেশ নেতৃত্ব দানের সুযোগ পেয়েছে। বিশ্ব পর্যটন সংস্থার কমিশন ফর সাউথ এশিয়ায় ২০২১-২৩ মেয়াদে ভাইস চেয়ার নির্বাচিত হয়েছে বাংলাদেশ। এ ছাড়া আটটি মুসলিম দেশের জোট ডি-৮ এর সভাপতি এখন ঢাকা। সম্প্রতি পর্যটনবান্ধব দেশের তালিকায় পাঁচ ধাপ এগিয়েছে বাংলাদেশ। বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামের ২০২০ সালের ট্রাভেল অ্যান্ড ট্যুরিজম কম্পিটিটিভ প্রতিবেদনে ভ্রমণ ও পর্যটনে সেরা দেশগুলোর তালিকায় পাঁচ ধাপ এগিয়ে বাংলাদেশের অবস্থান এখন ১২০ নম্বরে। সার্কভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে ৩৪ নম্বরে পার্শ্ববর্তী ভারত, শ্রীলঙ্কার অবস্থান ৭৭, নেপাল ১০২ ও পাকিস্তান ১২১। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি আমাদের বাংলাদেশে পর্যটনশিল্প বিকাশের সমূহ সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও স্বাধীনতার ৫০ বছরে আমরা খুব একটা সামনের দিকে এগিয়ে যেতে পারিনি।

তুলনামূলকভাবে বাংলাদেশ স্বল্প আয়তনের দেশ হলেও বিদ্যমান পর্যটন খাতে যে বৈচিত্র রয়েছে, তাতে সহজেই পর্যটকদের আকর্ষণ করা যেতে পারে। দেশের পর্যটন শিল্পের প্রচার ও উন্নয়নের স্বার্থে সরকারি সংস্থাগুলোর সঙ্গে বেসরকারি ট্যুর অপারেটর, হোটেল ও এভিয়েশন–সংশ্লিষ্ট সবাইকে নিয়ে গবেষণালব্ধ পরিকল্পনা সামনে রেখে বাংলাদেশ সরকারকে নেতৃত্ব দিতে হবে। যেন সেবাভিত্তিক অর্থনীতিতে পর্যটন হয়ে উঠতে পারে এক নির্ভরযোগ্য সমাধান।

লেখক: ফজলে শাহীদ মনন, শিক্ষার্থী, ট্যুরিজম অ্যান্ড হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্ট ডিপার্টমেন্ট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়