পরিবেশে দানব

সম্প্রতি পরিবেশ অধিদপ্তরের অভিযানে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে ঢাকার সাভারের আশুলিয়ার বেশ কিছু অবৈধ ইটভাটা। আয়ের উৎস ধূলিস্মাৎ হওয়ায় ভাটাশ্রমিকেরা পড়েছেন মহা চিন্তায়। ছবিটি ২৮ ফেব্রুয়ারি দুপুরে তোলা
ছবি: মো. রিফাত মেহেদী

বুড়িগঙ্গার জল গুমোট কালো। দুর্গন্ধে নাক-মুখ বন্ধ। তেমনভাবে শ্বাস নেওয়াটাও যেন দায় হয়ে উঠেছে। অক্সিজেন নেই বুড়িগঙ্গার জলে। নাইট্রোজেনের উপস্থিতিতে বিষাক্ত বুড়িগঙ্গা। এ যেন অস্তিত্বের সংকটে ধুঁকছে ঢাকার প্রাণ। কতটা বিষাক্ত এবং মারাত্মক দূষণে বাঁচা–মরার লড়াইয়ে মুমূর্ষু এ নদী, কাছ থেকে চোখে না দেখলে হয়তো বোঝা দায় হয়ে উঠবে।

যাত্রীবাহী লঞ্চ চলছে ঢাকার পথে। মেঘনার মোহনায় তখনো, বুড়িগঙ্গা অনেক দূর। কিন্তু কালো জলরাশি জানান দিচ্ছে মেঘনাই যেন বুড়িগঙ্গা! বুড়িগঙ্গার চারপাশে গড়ে ওঠা অসংখ্য শিল্পকারখানাকে বুড়িগঙ্গার পরিবেশ বিনষ্টের প্রধান কারণও বলা যেতে পারে৷ সুস্থ কোনো মানুষের পক্ষে বুড়িগঙ্গার তীরে কিংবা বুড়িগঙ্গার জল ছুঁয়ে নিশ্বাস নেওয়াটা বড় অসম্ভবের। যদি একজন সুস্থ মানুষের জন্য এটি কঠিন একটি বিষয় হয়, তবে যে মানুষটি ফুসফুসজনিত রোগে ভুগছে, তার অবস্থাটা কী হবে, একটু ভাবতে পারেন!

কথাগুলো যখন লিখছি, আমি তখন লঞ্চে করে ঢাকার পথে। সবচেয়ে আরাম যাতায়াতের জন্য লঞ্চ দারুণ একটি মাধ্যম। অথচ লঞ্চে গন্তব্যে ফেরাটা যেন অসুস্থকর একটি ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে।

পরিবেশদূষণে বুড়িগঙ্গা এক ভয়াল চিত্র বটে৷ তবে শুধু বুড়িগঙ্গাই নয়, পরিবেশ বিনষ্টের আরেক মারাত্মক চিত্র চোখে পড়ে রাজধানী ঢাকা থেকে সাভারের পথে রাস্তার দুই ধারে। চোখজুড়ে কেবলই ইটভাটা। দুই পাশের পরিবেশে তাকালে ধূসর মরুভূমি। চোখ ধরে রাখার উপায় নেই। যেন চোখ নষ্ট হয়ে যাওয়ার উপক্রম।

বুড়িগঙ্গার পানি কালো কুচকুচে। সঙ্গে দুর্গন্ধ তো আছেই
ফাইল ছবি

শুষ্ক মৌসুমে এমনিতেই পরিবেশ বালুময় থাকে। বৃষ্টির দেখা নেই, মাঠ-খেত ফেটে চৌচির। রাস্তার ধুলাবালুতে দোকানপাট, মানুষের শরীর, সবটাই আচ্ছন্ন হয়ে যায়। ঠান্ডা, হাঁচি-কাশি, সর্দির মতো অনেক রোগের উদ্ভব হয় এখান থেকেই। আর যখন ইটভাটার এ ধুলাবালু আশপাশের পরিবেশে ছড়িয়ে পড়ে, তখন পুরো পরিবেশই হয়ে পড়ে ধুলাময়।

প্রান্তিক জনপদেও এ চিত্র চোখে পড়ে। লক্ষ্মীপুরের বিভিন্ন স্থান ঘুরে দেখা যায়, যত্রতত্র গড়ে উঠেছে ইটভাটা। অনুমোদন ছাড়াই অসংখ্য ইটভাটা পরিবেশ দূষিত করছে। পাশাপাশি ইটভাটার ট্রলি দাপিয়ে বেড়াচ্ছে প্রান্তিকের সড়কগুলোতে। এসব ট্রলির কোনোটিরই অনুমোদন নেই। ট্রলিগুলো যেভাবে প্রান্তিকের পাকা সড়কগুলো নষ্ট করছে, ঠিক তেমনভাবেই দূষিত করছে চারপাশের পরিবেশ। আর এতে সাধারণ মানুষ, পথচারীরা চলাফেরা করতে ভীষণ দুর্ভোগের মধ্যে পড়ছে।

দেশজুড়ে সর্বত্রই গণমাধ্যম সূত্রে পরিবেশদূষণের নানা চিত্র উঠে আসে। নদী দখল, দূষণের নেপথ্যে স্থানীয় প্রভাবশালী চক্রের হাত রয়েছে। মোটকথা, পরিবেশদূষণে সবখানেই পরিবেশখেকো দানবদের প্রভাব বিস্তার চোখে পড়ে।

মাঝেমধ্যে উচ্ছেদ, জরিমানাসহ কিছু খবর চোখে পড়লেও, তা প্রয়োজনের তুলনায় খুব নগণ্য পদক্ষেপ। পরিবেশ রক্ষায় নিয়োজিত পরিবেশ অধিদপ্তর, নদী কমিশন, আইন প্রয়োগকারী বিভিন্ন সংস্থার চরম উদাসীনতায় দেশের পরিবেশে মারাত্মক বিপর্যয় ঘটার সম্ভাবনা রয়েছে। আর এর বেশির ভাগ প্রভাব পড়ছে দেশের উপকূলীয় অঞ্চলে। ঘূর্ণিঝড়সহ নানান দুর্যোগের কবলে পড়ে বাংলাদেশের উপকূল। বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তন এবং আগত হুমকি বিবেচনা করলে আমাদের রক্ষা নেই। তাই সরকারের উচিত, পরিবেশদূষণ প্রতিরোধে আরও সক্রিয় হওয়া। নাহলে মারাত্মক পরিবেশ বিপর্যয়ের মুখে পড়বে পুরো দেশ।