ধনতন্ত্রের দেশে সমাজতন্ত্রের হাওয়া

সমাজতন্ত্রের পক্ষে জনমত
ছবি: সংগৃহীত

আমেরিকানরা জাতি হিসেবে নিঃসন্দেহে দেশপ্রেমিক; তবে তার চেয়েও অধিক জাত্যাভিমানী। উল্লেখযোগ্যসংখ্যক মার্কিনির বদ্ধমূল বিশ্বাস, আমেরিকা হচ্ছে পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ দেশ। তাদের চিন্তা-ভাবনা, আচার-আচরণ বা মূল্যবোধের সঙ্গে যায় না, এমন সবকিছুকে তারা অপাঙক্তেয় বলে মনে করে। দেশটির আর্থসামাজিক কাঠামো গড়ে উঠেছে মূলত পুঁজিবাদী বা ধনতান্ত্রিক মূল্যবোধকে ঘিরে। আমেরিকান জনগণের জীবনাচরণ, জীবনদর্শন ও মননে পুঁজিবাদী ধ্যানধারণা সুস্পষ্টভাবে প্রতীয়মান।

পুঁজিবাদ আর আমেরিকা তাই এক অর্থে সমার্থক। তবে ব্যাপারটা এমনি এমনি বা দৈবক্রমে হয়নি। নিউইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনৈতিক তত্ত্বের অধ্যাপক বার্টেল ওলম্যান মনে করেন, এটি একটি সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা বা ছকের ফসল। তাঁর মতে, ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ থেকে শুরু করে বিংশ শতাব্দীর শুরু পর্যন্ত সমাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে সাঁড়াশি ও আক্রমণাত্মক প্রচারণার কারণে ধীরে ধীরে মার্কিন জনমত পুঁজিবাদের পক্ষে দাঁড়িয়েছে বা অন্যভাবে বললে সমাজতন্ত্র সম্পর্কে একটি নেতিবাচক ধারণা তৈরি হয়েছে। ব্যাপারটা এমন পর্যায়ে গিয়েছিল যে শব্দটা শোনামাত্রই লোকে বাঁকা চোখে তাকাতেন, যেন কেউ মহা অন্যায় করে ফেলেছেন। ১০ বার ভেবে তবেই হয়তো কেউ সমাজতন্ত্র নিয়ে কথা বলতেন।

স্বাভাবিক কারণেই প্রশ্ন জাগে, সমাজতন্ত্র সম্পর্কে সাধারণ আমেরিকানদের মনোভাবটা আসলে কী? বেশির ভাগ মার্কিনি মনে করেন, এটি একটি একদলীয়, স্বৈরাচারী শাসনব্যবস্থা, যেখানে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা সম্পূর্ণভাবে নিয়ন্ত্রিত। জনগণ যেহেতু সব ব্যাপারে সরকারের ওপরে নির্ভরশীল, ব্যক্তির সৃজনশীলতা, ব্যক্তি উদ্যোগ ও ব্যক্তিগত সাফল্যের সুযোগ একেবারেই সীমিত।

তবে সাম্প্রতিক সময়ে পরিচালিত বেশ কিছু জরিপের ফলাফল অনুযায়ী মার্কিনিদের সমাজতন্ত্র সম্পর্কে এই মনোভাব পরিবর্তনের আভাস পাওয়া যাচ্ছে। ২০২০ সালের শুরুতে গ্যালোপ কর্তৃক পরিচালিত এক জরিপে দেখা যায়, ৩৯ শতাংশ আমেরিকান সমাজতন্ত্র সম্পর্কে ইতিবাচক মনোভাব পোষণ করেন। পক্ষান্তরে ৫৭ শতাংশ আমেরিকানের ধারণা এখনো নেতিবাচক।

পিউ রিসার্চ পরিচালিত অন্য এক জরিপ অনুযায়ী, ৪২ শতাংশ আমেরিকান সমাজতন্ত্রের পক্ষে; অন্যদিকে ৫৫ শতাংশ বিপক্ষে মত দিয়েছেন। এনবিসি নিউজ ও ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের জরিপ অনুসারে: সমাজতন্ত্র নিয়ে শতকরা ১৯ জন ইতিবাচক; আর শতকরা ৫৩ জনের ধারণা নেতিবাচক। ব্যাপারটা নিঃসন্দেহে কৌতূহলোদ্দীপক। কেন এই মনোভাব বা দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন?

২০০৮ সালে বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক সংকটের পর থেকে পুঁজিবাদী ব্যবস্থার কার্যকারিতা নিয়ে শুরু হয় নানা রকমের আলোচনা, সমালোচনা ও গবেষণা। একের পর এক মহিরুহ বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের পতন! শুরুটা ১৫৮ বছরের পুরোনো বিনিয়োগ ব্যাংক লেহম্যান ব্রাদার্সকে দিয়ে। স্মরণকালের সবচেয়ে ভয়াবহ এই অর্থনৈতিক সংকট উত্তরণের লক্ষ্যে ‘বেলআউট প্যাকেজ’–এর জন্য মার্কিন করদাতাদের ব্যয় করতে হয় ৯ দশমিক ৭ ট্রিলিয়ন ডলার! তখন অনেকেই নড়েচড়ে বসেন। অনেকের মধ্যে এই উপলব্ধি হয়ে, বাজার ও ব্যক্তিখাতনির্ভর অর্থনীতি সব সমস্যা বা সংকটের সমাধান দিতে পারে না। বিশেষ করে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর স্বার্থ সংরক্ষণে রাষ্ট্র তথা সরকারের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। ক্রমবর্ধমান তীব্র অর্থনৈতিক বৈষম্য পুঁজিবাদী ব্যবস্থার ন্যায্যতার ব্যাপারে অনেক প্রশ্নের উদ্রেক করেছে।

বার্নি স্যান্ডার্সের মতো বর্ষীয়ান রাজনীতিবিদ, যিনি প্রকাশ্যে নিজেকে ‘গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রী’ হিসেবে পরিচয় দেন, মার্কিনিদের সমাজতন্ত্র সম্পর্কে দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন। এই প্রবীণ রাজনীতিবিদ এক বক্তৃতায় বলেছিলেন, ‘গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্র’ হচ্ছে সাম্যবাদ, যা কখনোই কারও জন্য হুমকিস্বরূপ নয়। তিনি মনে করেন, তাঁর এই রাজনৈতিক দর্শন সাবেক মার্কিন রাষ্ট্রপতি ফ্র্যাঙ্কলিন ডি রুজভেল্ট এবং মানবতাবাদী নেতা মার্টিন লুথার কিংয়ের (জুনিয়র) আদর্শের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ। তিনি এটিকে ‘অর্থনৈতিক মুক্তির’ মতবাদ হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন, যা জনগণের ন্যায্য মজুরি, স্বাস্থ্যসেবা, নিশ্চিন্ত অবসর ও দূষণমুক্ত পরিবেশের নিশ্চয়তা বিধান করে। প্রেসিডেন্ট হ্যারি ট্রুম্যানের ১৯৫২ সালের একটি বক্তৃতা উদ্ধৃত করে স্যান্ডার্স বলেন, সমাজতন্ত্র মানে সামাজিক নিরাপত্তা। সমাজতন্ত্র হচ্ছে কৃষকের উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিতকরণে সরকারি সহায়তা। সমাজতন্ত্র মানে ব্যাংকে রক্ষিত জনগণের আমানতের সুরক্ষার জন্য বিমার ব্যবস্থা করা। সমাজতন্ত্র মানে অবাধ ও স্বাধীন শ্রমের বিকাশ। সমাজতন্ত্র মানে জনগণকে সব ধরনের সহায়তা প্রদানে রাষ্ট্রের অঙ্গীকার।

২০১৬ সালে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের প্রাক্কালে বার্নি স্যান্ডার্সের নাটকীয় উত্থান মার্কিন জনগণের সমাজতন্ত্রের প্রতি পরিবর্তিত মনোভাবের প্রতিফলন। বিশেষ করে তরুণদের মধ্যে এই পরিবর্তন বেশ লক্ষণীয়। ওই সময় দলীয় মনোনয়নের জন্য যে প্রাইমারি ভোট অনুষ্ঠিত হয়, তাতে অধিকসংখ্যক তরুণ ভোটারকে আকৃষ্ট করতে পেরেছিলেন স্যান্ডার্স। গ্যালোপ পরিচালিত জরিপের ফলাফল অনুযায়ী ৪৯ শতাংশ ‘মিলেনিয়াল’ বা ‘নব-সহস্রাব্দ প্রজন্ম’ সমাজতন্ত্রের ব্যাপারে ইতিবাচক ধারণা পোষণ করেন। হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালিত অন্য এক জরিপে দেখা যায়, ১৮-২৯ বছর বয়সী আমেরিকানদের মধ্যে শতকরা ৫১ জন পুঁজিবাদ বা ধনতন্ত্রের সমর্থক নন। এই তরুণদের কাছে সমাজতন্ত্র কোনো লাল জুজু বা লাল ঝান্ডার প্রতীক নয়। তাঁরা মনে করেন, এটি সেই কার্যকরী ব্যবস্থা, যা ইতিমধ্যে স্ক্যান্ডিনেভিয়াসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে সফলভাবে বাস্তবায়িত হয়েছে। উদাহরণ হিসেবে তাঁরা ফিনল্যান্ড, কানাডা বা যুক্তরাজ্যের স্বাস্থ্যব্যবস্থার কথা বলেন।

বার্নি স্যান্ডার্স
ফাইল ছবি

আমেরিকার দুই প্রধান রাজনৈতিক দলের মধ্যে ডেমোক্র্যাটরা তুলনামূলক উদারনৈতিক হিসেবে পরিচিত। পক্ষান্তরে রিপাবলিকানরা পরিচিত রক্ষণশীল হিসেবে। গ্যালোপের জরিপ অনুযায়ী ৬৫ শতাংশ ডেমোক্র্যাট সমাজতন্ত্রের প্রতি ইতিবাচক। অন্যদিকে রিপাবলিকানদের মধ্যে ৯১ শতাংশই সমাজতন্ত্রের ঘোর বিরোধী। এর প্রতিফলন দেখা যায় আমেরিকার সাম্প্রতিক রাষ্ট্রপতি নির্বাচনী প্রচারণায়।

২০২০ সালে অনুষ্ঠিত যুক্তরাষ্ট্রের রক্ষণশীল রাজনৈতিক দলগুলোর সবচেয়ে বৃহৎ সম্মেলন পলিটিক্যাল অ্যাকশন কনফারেন্সের (সিপিএসি) মূল থিম ছিল ‘আমেরিকা বনাম সমাজতন্ত্র’। এই সম্মেলন থেকে বলা হয়, সমাজতন্ত্রের ভাইরাস আবার ছড়িয়ে পড়েছে এবং সবাইকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দিয়েছে। এটি বিদেশ থেকে আমদানি করা, যা আমেরিকাকে আক্রান্ত করেছে। এই ভাইরাস একজন থেকে আরেকজনের মধ্যে ছড়িয়ে পড়তে পারে এবং এর প্রভাব মারাত্মক ক্ষতিকর হতে পারে। ডোনাল্ড ট্রাম্পের অর্থনৈতিক উপদেষ্টা ল্যারি কুডলো এই সম্মেলনে বলেন, ‘বামপন্থী আদর্শ অর্থনীতির জন্য করোনাভাইরাসের চেয়ে আরও বড় হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। করোনাভাইরাস আমাদের অর্থনীতি ধ্বংস করতে পারবে না। আমেরিকার অর্থনীতিকে ধ্বংস করতে পারে যা, তা হচ্ছে আমাদের বন্ধুদের কাছ থেকে আসা তথাকথিত সমাজতন্ত্র।’
উটাহর রিপাবলিকান সিনেটর মাইক লি মন্তব্য করেন, ‘তারা সরকারকে আপনার স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারী, আপনার ব্যাংকার, আপনার আয়া, আপনাকে নজরদারি করার বিষয়ে কথা বলছে। এতে করে সরকার হবে একচ্ছত্র ক্ষমতার অধিকারী, ক্ষমতা সুরক্ষিত করতে চালাবে গুপ্তচরবৃত্তি আর জনগণকে বাধ্য করবে অমানুষিক পরিশ্রম করতে। এককথায় ডেমোক্রেটিক পার্টি সমাজতান্ত্রিক দল হয়ে উঠেছে। আমি মনে করি না যে আমরা এর জন্য প্রস্তুত এবং আমি জানি, আপনারাও নন।’

গত বছর অনুষ্ঠিত মার্কিন রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে রিপাবলিকানরা পরিকল্পিতভাবে সমাজতন্ত্রকে একটি বড় ইস্যু বানানোর চেষ্টা করেন এবং এর বিরুদ্ধে ক্রমাগত প্রচারণা অব্যাহত রাখেন। গ্রিন বেতে হাজার হাজার রিপাবলিকান সমর্থকদের সামনে ট্রাম্পের ক্যাম্পেইন ম্যানেজার ব্র্যাড পারস্ক্যাল বলেন, প্রেসিডেন্টকে লড়তে হবে একদল উন্মাদ সমাজতন্ত্রীর বিরুদ্ধে। তাঁদের সমর্থকদের কাছে প্রেরিত এক ই-মেইলে বলা হয়, ‘আমেরিকা স্বাধীনতা ও মুক্তির ওপরে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। সরকারি জবরদস্তি, আধিপত্য ও নিয়ন্ত্রণ আমাদের আদর্শ নয়। আমরা মুক্ত হয়ে জন্ম নিয়েছি, আমরা মুক্তই থাকব। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের পাশে দাঁড়ান এবং ডেমোক্র্যাটদের বলুন, আমেরিকা কখনোই সমাজতান্ত্রিক দেশ হবে না।’

ডেমোক্র্যাট প্রার্থী বর্তমান প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনকে নিয়ে ট্রাম্প বলেন, ‘সবাই জানেন বাইডেন কম্যুনিস্ট নন...তবে তিনি অবশ্যই র‌্যাডিক্যাল সমাজতান্ত্রিক ডেমোক্র্যাট এবং মানুষ তা জানে।’ রিপাবলিকানদের সমাজতন্ত্রবিরোধী প্রচারণা কিংবা জনমতের কারণেই হোক ডেমোক্র্যাটরা প্রকাশ্যে নিজেদের সমাজতন্ত্রী বলতে নারাজ ছিলেন। বাইডেন এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘আমি সমাজতন্ত্রীদের পরাজিত করে দলের মনোনয়ন পেয়েছি। আমাকে কি সমাজতন্ত্রী মনে হয়? আমার পুরো ক্যারিয়ার দেখুন। আমি সমাজতন্ত্রী নই।’

ক্ষমতা গ্রহণের পর জো বাইডেন ‘আমেরিকান রেসকিউ প্ল্যান’ শীর্ষক যে নাগরিক প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেন, তাতে সরকারি সহায়তা বাড়ানোর কথা বলা হয়েছে। এই প্যাকেজে বেকার ভাতা, গৃহহীনদের জন্য আবাসনসহায়তা ও দরিদ্রদের জন্য খাদ্য সাহায্য বৃদ্ধির প্রস্তাব করা হয়েছে। স্পস্টতই সমাজের দরিদ্র ও স্বল্প আয়ের জনগণকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে এ প্রণোদনা প্যাকেজে। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, এর ফলে অর্থনীতিতে দ্রুত গতিশীলতা আসবে এবং মার্কিন জনজীবনে শিগগিরই আর্থিক স্বাভাবিকত্ব ফিরে আসবে। এটা বলা বোধ হয় অত্যুক্তি হবে না যে বর্তমান মার্কিন প্রশাসনের দেশ পরিচালনায় সমাজতান্ত্রিক চিন্তা-চেতনার প্রতিফলন দেখা যাবে।
পক্ষ বা বিপক্ষ নয়। ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিয়ে, সোভিয়েত সমাজতান্ত্রিক মডেল এবং অর্থোডক্স পুঁজিবাদী অর্থনীতির ব্যর্থতা স্বীকার করে, সমতা ও ন্যায্যতার ভিত্তিতে রাষ্ট্র পরিচালনার নতুন ব্যবস্থা এখন সময়ের দাবি।
*লেখক: সাজ্জাদুল হাসান, একটি বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানে ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে কর্মরত।

**নাগরিক সংবাদে লেখা পাঠাতে পারেন [email protected]-এ