‘দস্যু বনহুর’-এর রোমেনা আফাজের মৃত্যুবার্ষিকীতে বিনম্র শ্রদ্ধা

কথাসাহিত্যিক রোমেনা আফাজ
ছবি : সংগৃহীত

‘দস্যু বনহুরের ভয়ে দেশবাসী প্রকম্পমান। পথে-ঘাটে-মাঠে শুধু ওই এক কথা—দস্যু বনহুর-দস্যু বনহুর! কখন যে কোথায় কার ওপর হানা দিয়ে বসবে কে জানে!

‘ধনীরা তো সব সময় আশঙ্কা নিয়ে দিন কাটাচ্ছে। তাদের ভয়ই বেশি। দস্যু বনহুরের জন্য কারও মনে শান্তি নেই। দস্যু বনহুর যে কে, কেমন তার আসল রূপ, তা কেউ জানে না। কোথা থেকে আসে সে, কোথায় চলে যায়, তাও কেউ বুঝতে পারে না। গভীর রাতে জমকালো একটা অশ্বপৃষ্ঠে দেখা যায় তাকে। গোটা শরীরে তার কালো পোশাক। মাথায় কালো কাপড়ের পাগড়ি। মুখে একটা কালো রুমাল জড়ানো। কোমরের বেল্টে গুলিভরা রিভলবার। বিশেষত অন্ধকার রাতেই বনহুর হানা দেয়। শহরে-বন্দরে, গ্রামে, পথে-ঘাটে-মাঠে সব জায়গায় হয় তার আবির্ভাব।’

লেখার অংশটুকু ‘দস্যু বনহুর’ সিরিজের জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক রোমেনা আফাজের ‘দস্যু বনহুর’ উপন্যাস থেকে। সেই প্রখ্যাত গোয়েন্দা ও রহস্য সিরিজের লেখক রোমেনা আফাজের মৃত্যুবার্ষিকী আজ ১২ জুন। তাঁকে জানাই বিনম্র শ্রদ্ধা।

রোমেনা আফাজ ১৯২৬ সালে ২৭ ডিসেম্বর বগুড়ার শেরপুরে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাড়ি ছিল বগুড়ার জলেশ্বরীতলায়, যা বর্তমানে স্মৃতি জাদুঘর। বাবা কাজেম উদ্দীন আহম্মদ এবং মা বেগম আছিয়া খাতুন। বগুড়ার ফুলকোট গ্রামের ডাক্তার মো. আফাজ উল্লাহ সরকারের সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়।

কথাসাহিত্যিক রোমেনা আফাজের প্রকাশিত বই
ছবি : সংগৃহীত

লেখালেখি শুরু করেন খুব অল্প বয়সে। তখন সবে নয় বছর। লিখে ফেলেন ‘চাষী’ নামে একটি ছড়া, যা সেই সময়ে কলকাতা থেকে প্রকাশিত হতো মাসিক মোহাম্মাদী পত্রিকায়। সেই লেখালেখি শুরুর পর থেকে আর থেমে থাকেননি। লিখে ফেলেন ছোটগল্প, কবিতা, কিশোর উপন্যাস, জনপ্রিয় গোয়েন্দা ও রহস্য সিরিজ মিলে ২৫০টি ওপর বই। তুমুল জনপ্রিয়তা পায় রহস্য সিরিজ ‘দস্যু বনহুর’। ‘দস্যু বনহুর’ চরিত্রের জন্যই বিখ্যাত হয়ে ওঠেন তিনি। তাঁর উল্লেখযোগ্য সাহিত্যকর্মগুলো হলো—উপন্যাস: ‘দেশের মেয়ে’ (১৯৬২), ‘সোনালী সন্ধ্যা’ (১৯৬৪), ‘হারানো মানিক’ (১৯৬৮), ‘কাগজের নৌকা’ (১৯৬৫), ‘কুন্তিবাঈ’ (১৯৬৬), ‘জানি তুমি আসবে’ (১৯৬৬), ‘শেষ মিলন’ (১৯৬৬), ‘প্রিয়ার কণ্ঠস্বর’ (১৯৬৭), ‘আলেয়ার আলো’ (১৯৬৭), ‘সাগর সৈকত’ (১৯৬৭), ‘অভিশপ্ত’ (১৯৬৮), ‘লেখকের স্বপ্ন’ (১৯৬৮), ‘নিয়তির চক্র’ (১৯৬৮), ‘আলোক রশ্মি’ (১৯৬৯), ‘ভোরের সূর্য’ (১৯৬৯), ‘রুপালি পর্দা’ (১৯৭০), ‘নীল আকাশ’ (১৯৭১), ‘উত্তাল তরঙ্গ’ (১৯৭৬), ‘মায়ার সংসার’, ‘কুমারী বধূ’, ‘ঘূর্ণি হাওয়া’, ‘অভিশপ্ত জীবন’, ‘হূসনা’, ‘পরশমণি’, ‘বাসররাতের স্বপ্ন’, ‘মাটির মানুষ’, ‘অনির্বাণ’, ‘পদ্মকন্যা’, ‘স্বপ্ন সাধনা’, ‘মা ও মাটি’, ‘পারুল’, ‘প্রায়শ্চিত্ত’, ‘মা ও মেয়ে’, ‘স্মৃতিরেখা’, ‘স্বয়ংবরা’, ‘আত্মাহুতি’, ‘বিবর্তিত বসুন্ধরা’, ‘দুলালী’, ‘পাহাড়ী মেয়ে’, ‘লাইট পোষ্ট’, ‘বিদগ্ধা জননী’, ‘দুটি চোখ’, ‘ঝরা পাতা’, ‘খেয়াঘাট’, ‘ধূসর পৃথিবী’, ‘বড় ভাবি’, ‘বাশসী’, ‘ভুলের শেষে’, ‘পরিণতি’, ‘অভিসারিকা’, ‘সূর্যাস্ত’, ‘মধুর পরিচয়’, ‘হীরক খণ্ড’, ‘ফাঁসির মঞ্চে’, ‘বিষাক্ত তীর’, ‘প্রতিচ্ছবি’, ‘মধু’, ‘মিলন’, ‘বধূ’। কিশোর উপন্যাস: ‘মান্দি গড়ের বাড়ি’, ‘দস্যুরানী সিরিজ’ (১২টি), ‘দস্যু বনহুর’ সিরিজ (১৩২টি)।

রোমেনা আফাজের লেখা উপন্যাস অবলম্বনে নির্মিত হয় ৬টি চলচ্চিত্র। সেই চলচ্চিত্রগুলো বেশ জনপ্রিয়। চলচ্চিত্রগুলো হলো ‘কাগজের নৌকা’, ‘মোমের আলো’, ‘মায়ার সংসার’, ‘মধুমিতা’, ‘মাটির মানুষ’ ও ‘দস্যু বনহুর’।

রোমেনা আফাজ শুধু লেখালেখিতেই মগ্ন থাকেনি, ছিলেন একজন সক্রিয় সমাজসেবক। সমাজসেবামূলক কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। তার মধ্যে জাতীয় মহিলা সংস্থা, বগুড়ার সাবেক চেয়ারম্যান; ঠেঙ্গামারা মহিলা সবুজ সংঘ, বগুড়ার আজীবন উপদেষ্টা ও প্রতিষ্ঠাতা পৃষ্ঠপোষক; বাংলাদেশ মহিলা জাতীয় ক্রীড়া সংস্থা, বগুড়ার সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান; উদীচী সাংস্কৃতিক গোষ্ঠী, বগুড়ার সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান; বাংলাদেশ রেডক্রস সমিতি, বগুড়ার সাবেক সদস্য; শিশু একাডেমি, বগুড়ার সাবেক উপদেষ্টা; বাংলাদেশ রাইটার্স ফোরাম, বগুড়ার সাবেক উপদেষ্টা ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।

আমরা এই দিনে এই জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক, সমাজসেবক মানুষটিকে কতটুকু মনে রেখেছি। ১৯৬৬ সালে লন্ডনের অ্যাওয়ার হোম পত্রিকা রোমেনা আফাজের ডিটেকটিভ উপন্যাসের রিভিউ করতে গিয়ে লন্ডনের প্রখ্যাত লেখিকা আগাথা ক্রিস্টি সঙ্গে তুলনা করে—‘Begum Romena Afaz is a young rising Pakistani authorize. There is a number of books to her credit the one which is already published is one of the series of detective novels. It is called RAKTE-ANKA MAPÕ (Blood drawn map)It seems that she will soon be recognized as one of the most successful novel writers of Pakistan. She may, One day, be known as Agatha Christee of East Pakistan.’ মন্তব্য করে।

বাংলা সাহিত্যের অসামান্য অবদানের জন্য রোমেনা আফাজকে ২০১০ সালে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ বেসামরিক পুরস্কার স্বাধীনতা পুরস্কার প্রদান করা হয়। এ ছাড়া পেয়েছেন অসংখ্য পুরস্কার ও সম্মাননা। নারী বিকাশ সংস্থা, বগুড়া বেগম রোকেয়া স্বর্ণপদক-২০০০; বাংলাদেশ রাইটার্স ফোরাম, বগুড়া একুশে পদক (সাহিত্য) (২০০৩); গণ–উন্নয়ন গ্রন্থাগার (সিডিএল) নারী ফোরাম থেকে নারী মুক্তি আন্দোলনের অগ্রদূত সম্মাননা পদক, ২০০৬ (মরণোত্তর) উল্লেখযোগ্য।

বাংলা সাহিত্যের জনপ্রিয় গোয়েন্দা লেখকের সন্তান নয়জন। এর মধ্যে সাত ছেলে ও দুই মেয়ে। তাঁর হলেন অধ্যাপক মতিউর রহমান, মোখলেছুর রহমান (কানাডাপ্রবাসী), মাহবুবুর রহমান (আমেরিকাপ্রবাসী), মাজেদুর রহমান তাজু, মাহফুজ-উর রহমান দুলু (কানাডাপ্রবাসী), মোস্তাফিজুর রহমান নিলু, মোন্তেজুর রহমান আঞ্জু এবং দুই মেয়ে হেলেনা বেগম হেনা, সেলিনা বেগম স্বপ্না।

২০০৩ সালের ১২ জুন রোমেনা আফাজ বগুড়ায় মৃত্যুবরণ করেন।