দক্ষিণ এশিয়ায় চীনের উত্থান ঠেকাতে মরিয়া যুক্তরাষ্ট্র

বিশ্বের অন্যতম পরাশক্তি হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র অঞ্চলভিত্তিক কর্তৃত্ব কায়েমের জন্য বিদেশনীতি প্রবর্তন করে। মধ্যপ্রাচ্যে, আফ্রিকায়, ইউরোপে, এশিয়ায় বিশেষ করে মধ্য এশিয়ায় তাদের অঞ্চলভিত্তিক ভিন্ন ভিন্ন বিদেশনীতি রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র আকর্ষণীয় ও চোখজুড়ানো কয়েকটি অ্যাজেন্ডা নিয়ে প্রতিটি অঞ্চলে যাত্রা শুরু করলেও তাদের কৌশল অল্প দিনের মধ্যেই সবার কাছে পরিষ্কার হয়ে যায়।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সাধারণত গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা, সমান অধিকার ও বিশ্ব সন্ত্রাস মোকাবিলার কথা বলে প্রতিটি অঞ্চলে তাদের যাত্রা শুরু করে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে দক্ষিণ এশিয়ার গুরুত্বপূর্ণ দুটি রাষ্ট্র ভারত ও পাকিস্তানের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র তাদের সম্পর্ক নিরূপণ করে নেয়। কৌশলগত কারণে পাকিস্তানের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক রাখলেও ভারতের সঙ্গে সুসম্পর্ক হয়নি যুক্তরাষ্ট্রের। চীন-ভারত যুদ্ধে যদিও যুক্তরাষ্ট্র ভারতকে সমর্থন দিয়েছিল কিন্তু ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র ভারতের তীব্র সমালোচনা করে পাকিস্তানের পক্ষ নেয়৷ ১৯৬৪ সালে ভারত পারমাণবিক অস্ত্রের পরীক্ষা চালায় এতে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা একজোট হয়ে ভারতের ওপর অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপ করে। প্রেসিডেন্ট নিক্সন ও তাঁর প্রশাসনেরও ভারতের প্রতি তীব্র বিদ্বেষ ছিল। সমাজতান্ত্রিক দেশের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের আক্রোশ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে বেশ ভালোভাবে প্রতিয়মান হয়। একবিংশ শতাব্দীতে এসে অতীতের সব ধরনের হিসাব ভুলে গিয়ে বা তাদের অতীত আচরণের জন্য ক্ষমা চেয়ে হলেও দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের নতুন করে সিদ্ধান্ত নিতে হচ্ছে।

সারা বিশ্বে বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম চক্ষুশূল চীনের অর্থনৈতিক অবস্থা উত্তরোত্তর ভালো হচ্ছে। চীনা প্রেসিডেন্ট সি চিন পিংয়ের ডাকে ২০১৭ সালের ১৪-১৫ মে বেইজিংয়ে অনুষ্ঠিত হয় বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ (বিআরআই) ফোরামের প্রথম শীর্ষ সম্মেলন। বিআরআইয়ে থাকবে সবচেয়ে বেশি রাষ্ট্র, সবচেয়ে বড় অর্থায়ন ও সবচেয়ে বেশি জনসমষ্টি। বলা হচ্ছে, এটিই হতে যাচ্ছে আধুনিক ইতিহাসের সবচেয়ে বড় অর্থনৈতিক, কূটনৈতিক ও ভূরাজনৈতিক প্রকল্প। ৬৮টি দেশ, ৬০ শতাংশ বিশ্ব জনসংখ্যা এবং ৪০ শতাংশ উৎ​পাদন নিয়ে এই নয়া উদ্যোগ রচনা করছে এশীয় আদলের নতুন বিশ্বায়ন। নিজ দেশের গণ্ডি পেরিয়ে বিশ্ব রাজনীতিতে নতুন করে পদচিহ্ন আঁকতে যাচ্ছে চীন। সারা বিশ্বে বিনিয়োগ, অবকাঠামো নির্মাণ ও প্রযুক্তি পণ্য রপ্তানিতে চীনের নয়া উত্থানকে হুমকি হিসেবে দেখছে যুক্তরাষ্ট্র। অন্যদিকে দক্ষিণ এশিয়ায় চীনের অবস্থান দিন দিন শক্তিশালী হচ্ছে। এই অঞ্চলের ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্র বিষয়কে তারা গুরুত্ব দিচ্ছে এবং সেসব বিষয় নিয়ে তারা তাদের বক্তব্য জানাচ্ছে।

কোন দেশের ক্ষুদ্রতম কোনো সমস্যা বা অর্জন নিয়ে অন্য কোনো রাষ্ট্র যদি আগ্রহ দেখায়, তার কূটনৈতিক ব্যাখ্যা এ রকম দাঁড়ায় যে ওই রাষ্ট্রের সঙ্গে তারা সম্পর্ক জোরদার করতে চায়। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোকে চীনের বলয় থেকে মুক্ত করতে যুক্তরাষ্ট্র তাদের অতীতের নীতি পরিবর্তন করে শত্রুদের বন্ধুতে পরিণত করতে আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে লম্বা সময় ভারতের সঙ্গে খুবই খারাপ সম্পর্ক ছিল যুক্তরাষ্ট্রের। এখন দক্ষিণ এশিয়ায় চীনের উত্থান ঠেকাতে নব্য উদীয়মান অর্থনীতির দেশ ও বিশ্ব বাণিজ্যে নতুন এক শক্তি ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক ভালো করার জন্য প্রয়োজনীয় সব ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ করছে যুক্তরাষ্ট্র। ২০১০ সালে মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা যখন ভারত সফর করেন, তখন তিনি প্রতিরক্ষা খাতসহ বাণিজ্যে ১০ বিলিয়ন ডলারের চুক্তি করেন। আরও সাম্প্রতিক সময়ে ট্রাম্প প্রশাসন ২০১৮ সালে দুই দেশের মধ্যকার ২+২ মিনিসটেরিয়াল ডায়ালগের সূচনা করেন। এর জেরে নয়াদিল্লি ও ওয়াশিংটন কমিউনিকেশনস কম্প্যাটিবিলিটি অ্যান্ড সিকিউরিটি অ্যাগ্রিমেন্ট (সিওএমসিএএসএ) সই করে। দক্ষিণ এশিয়ার ভৌগোলিক দিক দিয়ে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দেশ বাংলাদেশ। বাংলাদেশের জন্মলগ্ন থেকেই এই দেশের তীব্র বিরোধিতা করে আসছে যুক্তরাষ্ট্র। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানকে সামরিক সহায়তাসহ বাংলাদেশের বিরুদ্ধে সব ধরনের সাহায্য–সহোযোগিতায় যুক্তরাষ্ট্রের নাম ছিল অগ্রগামী। বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি অনুযায়ী কারও সঙ্গে শত্রুতা না রেখে সবার সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখার নিমিত্তে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্কের কোনো উন্নতি বা অবনতি রাখেনি।

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ও চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং
ছবি: রয়টার্স

সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের পরিস্থিতি দেখে এটা স্পষ্ট বোঝা যায়, তারা বাংলাদেশকে তাদের সঙ্গে খুব ঘনিষ্ঠভাবে দেখতে চায়। দক্ষিণ এশিয়ায় চীনের উত্থান এবং কর্তৃত্বরোধে সব ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ করছে যুক্তরাষ্ট্র। এ অঞ্চলে প্রতিটি রাষ্ট্রকে তারা বিভিন্ন কৌশলে কাছে টানছে৷ দক্ষিণ চীন সাগর ও ভারত মহাসাগরে নিজের অবস্থান পাকাপোক্ত করতে প্রয়োজনীয় রসদ সংগ্রহে কালক্ষেপণ করছে না যুক্তরাষ্ট্র। এই অঞ্চলে চীনের উত্থান ঠেকাতে ভারত, বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কাসহ অন্যান্য দেশকে কৌশলে নিজেদের আয়ত্তে আনতে মরিয়া হয়ে কাজ করছে দেশটি। বিভিন্ন দেশে কূটনীতিক তৎপরতা, জাতীয় স্বার্থ বিবেচনায় বিভিন্ন রকম চুক্তি কোনোটাই বাদ দিচ্ছে না তারা। মোট কথা, চীনের উত্থান রুখতে দক্ষিণ এশিয়ার পারমাণবিক শক্তিধর দুই রাষ্ট্র ভারত ও পাকিস্তানকে কীভাবে একহাতে রেখে অন্যান্য দেশকেও আয়ত্তে আনা যায়, তার জন্য সব রকমের কৌশল গ্রহণ করেছে যুক্তরাষ্ট্র। যদিও পাকিস্তানের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক আগের মতো নেই কিন্তু তারা শক্ত কোনো বক্তব্যের মাধ্যমে তাদের থেকে নিজেদের গুটিয়েও নেয়নি। তাদের টার্গেট একটাই, যেকোনো মূল্যে চীনের এই নয়া উত্থান রোধ করা, এ জন্য মরিয়া হয়ে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে কাজ করছে যুক্তরাষ্ট্র।

শিক্ষার্থী, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।