টিএসসি এক স্মৃতিগাথা

টিএসসিতে প্রতিবছর জানুয়ারির শেষ শনিবার ইংরেজি বিভাগের অ্যালামনাইয়ের অনুষ্ঠান হয়। সেই অনুষ্ঠানের ইংরেজির অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলামের সঙ্গে লেখকসহ শিক্ষার্থীরাছবি: সংরক্ষিত

ঢাকা শহরের যেকোনো প্রান্ত থেকে রিকশাওয়ালাকে টিএসসি যাওয়ার কথা বললে দ্বিতীয়বার বোঝাতে হয় না জায়গাটা কোথায়। যেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাপিয়ে কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্যারালাল টিএসসি নামটি পরিচিত। ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্রের একটি স্বকীয়তা তৈরি হয়েছে, যার সামনে শান্তির পায়রা নামে ম্যুরাল স্থাপন করে মাহাত্ম্য বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। টিএসসি বাস্তবতার সঙ্গে অনুভূতি মিশিয়ে এক আবেগপ্রবণ অবস্থার সৃষ্টি করেছে। আবার আধুনিক স্থাপত্যর সঙ্গে সেটা সংগতিপূর্ণ বলেও অনেকের অভিমত।

প্রয়োজনের তুলনায় টিএসসির পরিসর ছোট হলেও খোলামেলায় এর বিশেষত্ব আছে। মূল ভবনের সামনে বাইরের অংশে গাড়ি পার্কিংয়ের জন্য রয়েছে খোলা চত্বর; ভেতরে ঢুকলে ছাদের আচ্ছাদনের চেয়ে সবুজ খোলা চত্বর যেকারও নজর কেড়ে নেবে। পূর্ব প্রান্তে দেয়ালের গা ঘেঁষে রয়েছে সুনসান নীরবতায় এক সমাধি সৌধ; দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের স্মৃতি বয়ে চলেছে। পশ্চিমে অডিটোরিয়াম; এখানেই বিশ্ববিদ্যালয়জীবনের প্রথম সংবর্ধনা আমাদের দেওয়া হয় কলা অনুষদের পক্ষ থেকে। ২৩ বছর আগের স্মৃতি এখনো টনটনে; মনে পড়ে রজনীগন্ধার স্টিক নিয়ে অচেনা অডিটোরিয়ামে ঢুকে মঞ্চে তাকাতেই ধাক্কা খেলাম। অভিনেতা আসাদুজ্জামান নূর বসে; জানতাম না তো উনি এখানকার শিক্ষক!

পরে জেনেছিলাম, উনি ‘বাকের’ ভাইয়ের ভাই আহাদুজ্জামান, জার্নালিজম ডিপার্টমেন্টের চেয়ার। একই রকম চুল আর মুখের দাঁড়ি নবীন চোখকে বিভ্রান্ত করেছিল। রোদ-হাওয়া খাওয়া অডিটোরিয়ামের খোলা উত্তর-দক্ষিণের দক্ষিণ, পানিবিহীন সুইমিংপুলে অতীত গৌরবের সাক্ষ্য দেয়। আছে আরও একটি ক্ষুদ্র সুইমিংপুল। দক্ষিণের প্রান্তজুড়ে আছে নাটকের মহড়াকক্ষ, ক্যাফেটেরিয়া আর বিশ্ববিদ্যালয় অতিথিশালা।

টিএসসির সঙ্গে রয়েছে আমাদের দীর্ঘ স্মৃতি; অনেক রাত কেটেছে এই টিএসসিতে; এর তিনতলায় রয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় রোভার স্কাউটের প্রধান কার্যালয়, যেটাকে আমরা বলি রোভার ডেন। স্কাউটিংয়ে ভিজিল বলে একটা প্রোগ্রাম আছে, যার অর্থই রাত্র জাগরণ; যারা নতুন, তাদের শপথ পর্ব হয় বেশ কিছু আনুষ্ঠানিকতার মধ্য দিয়ে। ভিজিলে রাত জেগে তালিম দেওয়া হয় বিভিন্ন প্রায়োগিক বিষয়ে—দেশ জাতির সেবা ব্রতে নিয়োজিত করার জন্য। কাজেই নতুন-পুরোনো সবাই রাত জাগা উদ্‌যাপন করে। অমর একুশে ফেব্রুয়ারির সারা রাত শহীদ মিনারের অনুষ্ঠানে থাকার প্রস্তুতি চলে এখান থেকেই। এখনো টিএসসি আমাদের সঙ্গে আনুষ্ঠানিকতায় জড়িয়ে আছে; প্রতিবছর জানুয়ারির শেষ শনিবার ইংরেজি বিভাগের অ্যালামনাই অনুষ্ঠিত হয়; যার আরেক রূপ মিলন মেলা।

সংস্কৃতি-ঐতিহ্য জাতিকে সমৃদ্ধ করে। কালের আবর্তনে পরিবর্তন-পরিমার্জন অবশ্যম্ভাবী। তাই বলে ইতিহাস ঐতিহ্য-সংস্কৃতিকে ধুলায় মিশিয়ে কোনো গৌরব আনা সম্ভব নয়। আইরিশ লেখক অস্কার ওয়াইল্ডের উপন্যাস ‘দ্য পিকচার অব ডোরিয়ান গ্রে’র সেই হাহাকার—‘নাও আ ডেজ পিউপিল নো দ্য প্রাইস অব এভরি থিং অ্যান্ড দ্য ভ্যালু অব নাথিং’। আমাদের পথ আমাদেরকেই গড়তে হবে; সেটা বুদ্ধি, বিবেচনা আর প্রজ্ঞা দিয়ে।


*লেখক: জিল্লুর রহমান, সহযোগী অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান, ইংরেজি বিভাগ, ইউনিভার্সিটি অব ডেভেলপমেন্ট অলটারনেটিভ। প্রাক্তন শিক্ষার্থী, ইংরেজি বিভাগ, সেশন: ৯৬-৯৭, ঢাবি