তুই আন্দোলনে যাস?

বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীদের জন্য নবনির্মিত বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব হল
ছবি: আশিকুজ্জামান

‘হ্যালো, মা’
‘তুই আন্দোলনে যাস?’
‘না, মানে...আজকেই শুধু...’

‘থাক! আর মানে মানে করতে হইব না। তুই যে আন্দোলনে যাস, আর এই কাঠফাটা রোদে রাস্তায় মইধ্যে বইসা স্লোগান দেস, সবই জানি।’
‘সে ঠিক আছে, কিন্তু তুমি জানলা কেমনে?’
‘কিচ্ছুক্ষণ আগে টিভিতে তোরে স্লোগান দিতে দেখছি।’

‘ওহ! সমস্যা নেই, মা। ওখানে সিনিয়র ভাইবোনেরা আছে। তারা আমাদের যথেষ্ট নিরাপদে রাখে।’

‘তোদের সিনিয়র যারা, তারা তো এখন হল দিলেও উঠতে পারবে না। তারপরও আন্দোলনে আসে?’

‘কী যে বলো তুমি! তারাই তো আন্দোলনের ডাক দিয়েছে। তাই আমরা সাহস পেয়েছি। তুমি টিভিতে দেখছ না? কত ছাত্রছাত্রী পিচঢালা রাস্তায় এই রোদের মধ্যে বসে আন্দোলন করছে।’

‘হুঁ’
‘এদের কেউই তো হলে উঠতে পারবে না। আর আন্দোলনকারী সবাই এটা জানে। তবু দেখো, হাজার হাজার শিক্ষার্থী আন্দোলনে আসছে। কষ্ট করছি আমরা আর তার সুফল ভোগ করবে পরবর্তী ব্যাচগুলো। এটাই তো নিয়ম।’
‘হুম্‌...। দেখ, কিছু হয় কি না।’

‘মা, দেখো। এবার ঠিকই আমাদের দাবি মেনে নেবে।’
‘সাবধানে থাকিস।’

হলের জন্য আন্দোলনের সময় শিক্ষার্থীরা
ছবি: সংগৃহীত

এমনই ছিল হল আন্দোলনের সময় আমাদের প্রায় প্রতিটি জবিয়ানের পারিবারিক কথোপকথনের চিত্র। নতুন প্রজন্ম কতটুকু বিশ্বাস করবে জানি না, তৃতীয় দিন আন্দোলন শেষ করে যখন বাসায় ফিরলাম, আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে পরিবর্তনটা লক্ষ করলাম নিজেই। মনে হয়েছিল, দীর্ঘদিন ধরে যত্ন করে কেউ আমার মুখ-গলা-হাতের চামড়ায় আগুনের আঁচে একটু একটু করে পুড়িয়ে যাচ্ছে। স্লোগান শেষে কণ্ঠেও যেন নেমে এসেছে রাজ্যের ক্লান্তি। ধীরে ধীরে কণ্ঠস্বর সংকীর্ণ হয়ে এল। এত কিছুর পরেও কোথায় যেন একটা অদম্য স্পৃহা কাজ করছিল। বিভাগের সিনিয়ররা সব সময় ছায়ার মতো পাশে থেকেছে। সাহস জুগিয়েছে। মিডিয়া কাভারেজ ছিল। এত কিছুর পর হলের ঘোষণা এল। আর তারই পরিণতিস্বরূপ আজকের জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের তোমাদের এই ‘বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব ছাত্রী হল’।

‘তোমাদের হল’ শব্দটা আমি সচেতনভাবেই ব্যবহার করেছি। কারণ, আন্দোলনকারী ব্যাচগুলোর মধ্যে আমরা ছিলাম সবচেয়ে জুনিয়র আর এখন সবচেয়ে সিনিয়র। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের সোনালি দিন ম্রিয়মাণ হয়ে আসছে। হলে আমাদের একটা রাতের জন্যও জায়গা হবে না জানি। তাতেও কোনো আক্ষেপ নেই আমাদের।

প্রিয় জুনিয়র,
মনে রেখো, আক্ষেপ তখন হবে, যদি কখনো মনের খেয়ালে হলটা একটু ঘুরে দেখতে যাই; আর তোমরা যদি বেখেয়ালে একটু বিনয়ের সঙ্গে বসতেও না বলো। তখন আমি হয়তো অতীতে ফিরে যাব। আন্দোলনের সেই দুর্গম পথের স্মৃতি সেদিন আমার চোখে দুফোঁটা জলকে যদি আমন্ত্রণ করে, তবে বুঝে নিয়ো সে দায়ভার একান্তই তোমাদের।
ইতি
প্রাক্তন হওয়ার পথে এক সিনিয়র।

শিক্ষার্থী, ১১তম ব্যাচ, বাংলা বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়