চৌধুরী পরিবারের বীরত্বগাথা

বীর বিক্রম মেজর জেনারেল (অব.) আমীন আহম্মেদ চৌধুরীর পরিবার
ছবি : মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর সৌজন্য

বীর বিক্রম মেজর জেনারেল (অব.) আমীন আহম্মেদ চৌধুরীর পরিবারের সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল। মুক্তিযুদ্ধে আমীন আহম্মেদ চৌধুরীর পরিবার বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখেন। এই পরিবারের সাত সদস্য মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হয়েছিলেন। পরিবারের প্রধান ছিলেন হোসেন উদ্দিন আহম্মেদ চৌধুরী। একজন অমায়িক ও খানদানি মানুষ। আমি সচরাচর অভিজাত ও খানদান শব্দ দুটি ব্যবহার করি না। কারণ, আমরা সবাই যদি সমান সুযোগ পেতাম, তাহলে সবাই আমাদের প্রতিভার প্রতিফলন দেখতে পারতাম। তারপরও এই পরিবারের বেলায় একটু ব্যতিক্রম করতে চাই। হোসেন উদ্দিন আহম্মেদ চৌধুরী সাহেব আসলেই একজন খানদান মানুষ ছিলেন।

আমি ছিলাম একাত্তরে একজন টগবগে তরুণ কূটনীতিক। সেই সময়ে আমার চোখের সামনে ঘটে গেছে নানান ঘটনা। হোসেন উদ্দিন আহম্মেদ চৌধুরীকে যখন ১৯৭১-এ হত্যা করা হয়, তখন তাঁর বয়স হবে ৮৬-র মতো। আমি জন্মের পর থেকেই তাঁকে সাদা চুল ও সাদা দাড়ির মানুষ হিসেবে দেখেছি। এই মানুষটিকেও পাকিস্তানি বাহিনী হত্যা করে, যা নৃশংসতার চরম একটি উদাহরণ।

মুক্তিযুদ্ধে আমীন আহম্মেদ চৌধুরী সম্মুখযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন। তাঁর বড় ভাই আজিজ আহম্মেদ চৌধুরী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছিলেন। এই দায়িত্ব তিনি অনেক বছর সম্মানের সঙ্গে পালন করেন। ৪০ বছর ধরে ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান থাকা সত্ত্বেও মানুষের কাছে যাচ্ছেন, হেসে হেসে কথা বলছেন এবং কোনো রকম দুর্নীতি তাঁকে স্পর্শ করেছে বলে আমরা শুনিনি। কিছুদিন আগেও গোলাপ ভাই (আজিজ আহম্মেদ চৌধুরী) ফেনী জেলা পরিষদের নির্বাচিত চেয়ারম্যান ছিলেন। জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান থাকাকালীন বছরখানেক আগে তিনি মারা গেছেন।

চৌধুরী পরিবারের আরেক সন্তান আমীর আহম্মেদ চৌধুরী রতন ভাই করে গেছেন সেই একই কাজ ভিন্ন এক পরিবেশে। রতন ভাইয়ের বাড়ি যে ফেনী জেলার ফুলগাজী উপজেলার এক গ্রামে, এই কথা ময়মনসিংহের কয়জন জানে, সেটা আমি জানি না। কিন্তু তিনি যে ময়মনসিংহ গিয়ে স্থায়ী হয়ে গেলেন, তারপর মুকুল ফৌজ সংগঠন গড়ে ছোট ছেলেমেয়েদের শরীর-মন বিকাশে যে ভূমিকা রাখলেন, সেই কথা ময়মনসিংহবাসীর চেয়ে ভালো আর কে জানে। তিনি বিভিন্ন পদে থেকে মুকুল নিকেতন বিদ্যালয়কে যেভাবে এগিয়ে নিয়ে গেলেন, সেটা আমাদের ফেনী জেলাকেও গৌরবান্বিত করেছে।

আজিজ আহম্মেদ চৌধুরী যেমন ফেনীর রাজনীতিকে এগিয়ে নিয়ে গেছেন, উন্নয়নে ভূমিকা রেখেছেন, আমীর আহম্মেদ চৌধুরীও ময়মনসিংহ জেলার ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া, শরীর-মনকে তেমনিভাবে এগিয়ে নিয়ে গেছেন ও উন্নয়নে ভূমিকা রেখেছেন।
এরপর আসি আমীন আহম্মেদ চৌধুরীর কথায়, যিনি সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছেন। এই যে পরিবারের তিনজন সদস্যের কথা বললাম, যাঁরা নিজের জীবন বিলিয়েছেন সমাজ ও দেশের স্বার্থে, যাঁরা অনুসরণ করলেন দাদা হোসেন উদ্দিন আহম্মেদ চৌধুরীর পদাঙ্ক এবং স্বমহিমায় অবদান রাখলেন নিজ নিজ ক্ষেত্রে, এ ধরনের কয়টা পরিবার আছে আমাদের বাংলাদেশে?

  • লেখক: মহিউদ্দিন আহমদ, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সাবেক সচিব, মুক্তিযোদ্ধা কূটনীতিক; কলামিস্ট। ১৯৭১ সালে লন্ডনে পাকিস্তান হাইকমিশনের দ্বিতীয় সচিব ছিলেন। পাকিস্তানের পক্ষ ত্যাগ করে তিনি ট্রাফালগার স্কয়ারে বিশাল জনসমাবেশে প্রকাশ্যে ঘোষণা দিয়ে মুক্তিযুদ্ধ ও মুজিবনগর সরকারের পক্ষ অবলম্বন করেছিলেন।