চীনের উইঘুর নির্যাতন ও পশ্চিমাদের মানবপ্রেম

চীনের পশ্চিমাঞ্চলীয় প্রদেশ শিনজিয়াংয়ে উইঘুর মুসলিমদের বসবাস
ফাইল ছবি

চীনের পশ্চিমাঞ্চলীয় প্রদেশ শিনজিয়াংয়ে উইঘুর মুসলিমদের বসবাস। যদিও কাগজে-কলমে এটি স্বায়ত্তশাসিত, কিন্তু বাস্তবে এর নিয়ন্ত্রণ চীনের হাতে। ১৯৪৯ সালে চীনের কমিউনিস্ট সরকার শিনজিয়াংয়ের নিয়ন্ত্রণ নেয়। কিন্তু উইঘুর জাতি তাদের কর্তৃত্ব মনেপ্রাণে মেনে নেয়নি। বিভিন্ন সময়ে তাদের ক্ষোভের প্রকাশ ঘটেছে। ২০০৯ ও ২০১৪ সালের দাঙ্গায় ৯৬ ও ২০০ জন লোক নিহত হয়। ২০১৪ সালে ওই ঘটনার পরে প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং শিনজিয়াং সফর করে উইঘুরদের দমন করার নির্দেশ দেন। এরপরই ওই অঞ্চলে চীনা শাসকগোষ্ঠীর নিপীড়নমূলক নজরদারি বেড়ে যায়। তৈরি করে একাধিক ডিটেনশন ক্যাম্প।

আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনগুলোর তথ্যানুসারে সেখানে ১০ লাখের বেশি উইঘুরকে আটক রেখেছে চীন সরকার, যাদের বেশির ভাগই মুসলিম। বিচ্ছিন্নতাবাদ ও উগ্রবাদ দমনের নামে চালানো হয় নির্দয় নির্যাতন, ধর্ষণ, জোরপূর্বক ধর্মান্তরিত করা, গর্ভপাত করাসহ অকথ্য নির্যাতন। হেন পাশবিক নির্যাতন অনেক আগে থেকে চললেও দু-একটি খবর ছাড়া তেমন কিছু জানা যায়নি—সি চিন পিং প্রশাসনের কঠোরতার কারণে। গত মাসে বিবিসির প্রতিবেদনে উঠে আসে লোমহর্ষক নির্যাতনের তথ্য।

আন্তর্জাতিক মহলে অনেকবার সমালোচনার মুখে পড়েছে দেশটি। কিন্তু এই অভিযোগ সম্পূর্ণ অস্বীকার করেছে বেইজিং। উইঘুর মুসলিমদের ওপর অত্যাচার নিয়ে আন্তর্জাতিক মহলে জল্পনাকল্পনা চলছিল কয়েক বছর ধরে। কিন্তু সম্প্রতি পশ্চিমা বিশ্বে উইঘুর বিষয়কে কেন্দ্র করে চীনের বিরুদ্ধে সমালোচনার ঝড় উঠেছে। ইতিমধ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, কানাডা কয়েকটি পদক্ষেপও নিয়েছে। চীন-ব্রিটেন কূটনৈতিক সম্পর্ক বেশ শীতল হয়েছে এই বিষয়কে কেন্দ্র করে। হ্যাঁ, অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ওঠা নিঃসন্দেহে ভালো। এবং বিশ্বের যেকোনো প্রান্ত থেকেই ধর্ম-বর্ণনির্বিশেষে প্রতিবাদ হতে পারে; হওয়া উচিত।

কিন্তু প্রশ্ন হলো, পশ্চিমাদের এই প্রতিবাদ আদৌ কি মানবপ্রেম? লোকদেখানো, রাজনৈতিক, নাকি এর পেছনে লুকানো আছে অন্য কোনো উদ্দেশ্য? চীনের বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ উঠেছে যৌথভাবে। কিন্তু যাদের গলায় এই মানবাধিকারের সুর, তারা কি খুব মানবদরদি? তাদের ইতিহাসের দিকে তাকালে তাদের ধূর্ততার মুখোশ উন্মোচিত হবে। সিরিয়ায় কারা অশান্তির আগুন জ্বালিয়েছে? প্রাচীন সভ্যতায় সমৃদ্ধ একটি দেশকে তারা আজ বাসের অযোগ্য করে তুলেছে। কত নিষ্পাপ শিশুর সফেদ-কোমল চেহারা আজ রক্তে রঞ্জিত! ফিলিস্তিনে কাদের মদদে ইসরায়েল হামলা চালাচ্ছে? ১৯১৭ সালে বেলফোর ঘোষণার মধ্য দিয়ে জেরুজালেম দখল করার বৈধতা দিয়েছিল ব্রিটেন। ইরাক যুদ্ধে কি মানবাধিকার লঙ্ঘন করা হয়নি? ইরাকের আবু গারিব কারাগারে মার্কিন সেনাদের পাশবিক নির্যাতনের কথা বিশ্ববাসী কি ভুলে যাবে? ইরাকের বিরুদ্ধে যে অভিযোগ এনে দেশটির মাটিকে রণক্ষেত্র বানানো হয়েছিল, সে অভিযোগ কিন্তু মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছে। সেখানে কি মানবাধিকারের লঙ্ঘন হয়নি? কারা কিউবার দক্ষিণ-পূর্ব পাশে ক্যারিবীয় সাগরে গুয়ানতানামো বে কারাগারে (মর্ত্যের নরক) বিনা বিচারে মানুষদের নির্যাতন করেছে? অথচ বছরের পর বছর অমানবিক নির্যাতনের পরে দেখা গেল তারা বেশির ভাগই নির্দোষ; সেটা কি মানবাধিকারের লঙ্ঘন নয়? এই পাশবিক নির্যাতনে অংশ নেওয়া মার্কিন সেনাদের কি আজ পর্যন্ত বিচার হয়েছে? অথচ, বারাক ওবামার আমলে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোয় যুদ্ধ বাধানোর জন্য যার অবদান সবচেয়ে বেশি ছিল—জো বাইডেন সেই লয়েড অস্টিনকে প্রতিরক্ষামন্ত্রী বানিয়েছেন। ইতিমধ্যে বাইডেনের নির্দেশে তিনি পুরোনো যুদ্ধংদেহী কার্যক্রম শুরু করেছেন সিরিয়ার পূর্বাঞ্চলে ইরানপন্থী মিলিশিয়াদের স্থাপনায় হামলা চালিয়ে, যে হামলায় অন্তত ২২ জন নিহত হয়েছে। এমন হামলায় বহু বেসামরিক লোকজন নিহত ও আহত হয়। তখন মানবাধিকারের প্রশ্ন কোথায় যায়?

উইঘুর সম্প্রদায়ের মানুষ। ছবিটি ২০১৩ সালে স্থানীয় এক বাজার থেকে তোলা
ছবি: বিবিসির সৌজন্যে

চীনের বিরুদ্ধে তারা যে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ এনেছে, সেটা নিছক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত; কূটনৈতিকভাবে চীনকে চাপে রাখার জন্য। ট্রাম্পের আমলে শুরু হওয়া বাণিজ্যযুদ্ধকে কেন্দ্র করে যে বিরোধ সৃষ্টি হয়েছিল, তা কিন্তু শেষ হয়নি। তাই উইঘুর ইস্যুকে কেন্দ্র করে আন্তর্জাতিকভাবে চীনের ভাবমূর্তি যৎসামান্য ক্ষুণ্ন করা গেলেও মার্কিন জোট সফলতা পাবে। ইরাক যুদ্ধে মার্কিনদের পাশে ছিল ব্রিটেন।

উইঘুর মুসলিমদের প্রতি চীন সরকার কঠোর নীতি অনুসরণ করছে বলে অভিযোগ আছে
ছবি: রয়টার্স

চীনকে রুখতেও আমেরিকার পাশে আছে ব্রিটেন। ব্রিটিশ পার্লামেন্টে উইঘুর নির্যাতনকে ‘গণহত্যা’ বলা যাবে কি না, সে বিষয়ে কথা হয়েছে। কয়েকজন আইনজীবী ট্রাইব্যুনাল গঠনেরও সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। জাস্টিন ট্রুডোর উপস্থিতিতে কানাডার পার্লামেন্টেও উইঘুর বিষয়ে আলোচনা হয়েছে, যেখানে চীনের তীব্র সমালোচনা করেছে কানাডা। ইরাক, সিরিয়া যুদ্ধে আমেরিকা যুদ্ধাপরাধ করেছে—তা নিয়ে তো কানাডা কোনো কথা বলেনি! কোনো অপরাধের দায়ে সমানভাবে অভিযোগ করতে হবে। একপক্ষের বিরুদ্ধে সবাই সোচ্চার আর অন্য পক্ষের ব্যাপারে সবাই নীরব থাকবে—তা তো গণতন্ত্রের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হবে। চীনের বিরুদ্ধে এ অভিযোগ দীর্ঘদিনের।

বিচ্ছিন্নতাবাদ দমনের নামে উইঘুরদের ওপরে নৃশংস নির্যাতন অচিরেই বন্ধ করুক। সঙ্গে পশ্চিমা বিশ্বও মধ্যপ্রাচ্যসহ পৃথিবীর আনাচকানাচে যুদ্ধের দামামা বাজানো থেকে বিরত থাকুক। কোনো ক্রমে কোনো স্থানেই মানবাধিকার লঙ্ঘিত না হোক। নিজেরা মানবাধিকার লঙ্ঘন করে অন্যজনকে অভিযুক্ত করলে সেটা আর যা–ই হোক, মানবপ্রেমের মধ্যে পড়ে না।

*লেখক: সাইফুল ইসলাম হাফিজ, শিক্ষার্থী, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়