করোনা–পরবর্তী শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে ভাবতে হবে

বিশ্বব্যাপী প্রায় দেড় শ কোটি শিশুর অনলাইনে ক্লাস করার পর্যাপ্ত সুযোগ নেই
ছবি: সংগৃহীত

সম্পূর্ণ নতুন এক ভাইরাস পুরো পৃথিবীকে সংক্রমিত করে চলছে। যার সঙ্গে এই শতাব্দীর মানুষের পূর্বপরিচয় ছিল না। বিশেষ করে, শিশু ও তরুণ প্রজন্মের কাছে এটা সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত। করোনাভাইরাসের কারণে সবকিছু নিস্তব্ধ, অচলাবস্থা। অফিস-আদালত, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান, শপিং মল, পর্যটনস্থানগুলো দীর্ঘদিন বন্ধ থাকলেও খুলে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু আজ অবধি চালু হয়নি শিক্ষা ব্যবস্থা। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় পাঠদান যেমন বন্ধ রয়েছে, ঠিক তেমনি শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের মধ্যে নিয়মিত যোগাযোগ বিঘ্ন সৃষ্টি হয়েছে। দীর্ঘ সময়ে অস্বাভাবিক বিরতিতে শিক্ষার্থীদের পড়াশোনা যেমন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, তেমনি শিক্ষার্থীরা মানসিক সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে।

এই করোনাভাইরাসে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে প্রাথমিক পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের ওপর। এ সময় তারা পড়াশোনার পাশাপাশি সামাজিকতা শিখে। এ ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে স্কুল-মাদ্রাসা। স্কুল বা মাদ্রাসা শিক্ষার্থীদের আনন্দের জায়গা। পড়াশোনার পাশাপাশি তারা খেলাধুলায় মেতে ওঠে, সহপাঠীদের সঙ্গে বন্ধুত্বসুলভ আচরণ করে, মনোভাব আদান-প্রদান করে ইত্যাদি। স্কুল বা মাদ্রাসা চলাকালে তাদের নির্দিষ্ট সময়ে স্কুলে যাওয়া আবার ফিরে আসা হয়। এসব কিছু যেন রুটিনমাফিক চলত। কিন্তু করোনায় সবকিছু থমকে গেছে। এ করোনাকালে শিশুরা অলস সময় পার করছে। অনেকেই মুঠোফোনের প্রতি আসক্ত হয়ে পড়েছে। বিভিন্ন ভিডিও, কার্টুন, গেমসের প্রতি ঝুঁকে পড়েছে শিক্ষার্থীরা। এতে পড়াশোনার আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছে অনেকে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় শুধু যে প্রাথমিক পর্যায়ের শিক্ষার্থীরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, এমন কিন্তু নয়। বরং বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের শিক্ষার্থীরা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের শিক্ষার্থীরা গৃহবন্দী। তাঁদের শিক্ষাব্যবস্থা বেহাল। এতে তাঁরা হতাশায় নিমজ্জিত হচ্ছে প্রতিনিয়ত। আমাদের দেশে বহু শিক্ষার্থী দরিদ্র ও মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলেমেয়ে। তারা এ করোনাকালে অনেক আর্থিক সমস্যার সম্মুখীন হয়েছে। তাদের মধ্যে অনেকেই টিউশনি বা পার্টটাইম চাকরি করে নিজেদের পড়াশোনার খরচ চালাত। কিন্তু করোনার কারণে এসব কিছু বন্ধ রয়েছে। ফলে তারা আরও বেশি মানসিক সমস্যায় ভুগছে। যদিও তাদের অনলাইন ক্লাস চালু রয়েছে।

অনলাইন ক্লাসের জন্য শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের জন্য প্রয়োজন ইন্টারনেট সেবা, কম্পিউটার বা ল্যাপটপ বা স্মার্টফোন। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে বেশির ভাগ শিক্ষকের এসব জিনিস থাকলেও গ্রামের প্রাথমিক থেকে উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের কাছে এগুলো নেই। তাই শিক্ষকদের পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের এসব কিছু থাকতে হবে। গ্রামাঞ্চলের অধিকাংশ দরিদ্র মানুষের কাছে স্মার্টফোন নেই, আবার কারও স্মার্টফোন আছে, কিন্তু ইন্টারনেট চালানোর সামর্থ্য নেই। যদিও সম্প্রতি টেলিটক সিম অপারেটর শিক্ষার্থীদের জন্য ইন্টারনেট সেবা ফ্রি করে দিয়েছে। কিন্তু এ ফ্রি ইন্টারনেট সেবা দেওয়ার ফলে সত্যিকারার্থে সফল হয়েছে কি না, প্রশ্ন থেকে যায়। কারণ, করোনার পরিস্থিতির জন্য অধিকাংশ শিক্ষার্থী নিজের বাড়িতে অবস্থান করছে। তাদের মধ্যে সিংহভাগ শিক্ষার্থী গ্রামে বসবাস করে। গ্রামে একদিকে যেমন বিদ্যুতের সমস্যা, অন্যদিকে নেটওয়ার্ক সিস্টেমের সমস্যা। যার ফলে সঠিক সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে তারা। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) থেকে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষার্থীদের ঋণ দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে সবচেয়ে বেশি শিক্ষার্থী রয়েছেন। যেখানে ২৩ লাখ ৫৩ জন পড়ালেখা করছেন। এতে কি জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীদের কথা ভাবা হয়েছে? তাঁরা অবহেলায় পড়ে যাচ্ছে না তো? এমন কিছু প্রশ্ন থেকে যায়।

এ ছাড়া এইচএসসি পরীক্ষা কবে হবে, এখন পর্যন্ত কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা যায়নি। শিক্ষার্থীদের আরও একটি ভয় সেশনজট ঘিরে। নির্দিষ্ট সময়ে পড়াশোনা শেষ করতে না পারলে ভোগান্তির শিকার হতে হয় শিক্ষার্থীদের। কারণ, সরকারি চাকরির প্রবেশের বয়সসীমা ৩০। তাই সেশনজট হলে ভোগান্তির শেষ থাকবে না শিক্ষার্থীদের। আর এসব সমস্যার সমাধান করতে করোনার সময় এবং এর পরবর্তী সময়ে শিক্ষাব্যবস্থার সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। করোনা–পরবর্তী সময়ে সিলেবাস কমিয়ে এনে, নতুবা সেমিস্টারভিত্তিক কোর্সের সময়সীমা কমিয়ে এনে সেশনজট থেকে মুক্তি লাভ করতে হবে। শিক্ষার্থীরা এগিয়ে যাবে বিশ্বায়নের সঙ্গে তাল মিলিয়ে। সর্বোপরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা না হলেও সব স্তরের শিক্ষার্থীদের কথা ভাবতে হবে; তাদের হতাশা, মানসিক চাপ দূর করতে হবে। করোনা–পরবর্তী শিক্ষাব্যবস্থার সঠিক পথ অবলম্বন করতে হবে।

  • মু, সায়েম আহমাদ, শিক্ষার্থী, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা কলেজ, ঢাকা