করোনাকালে ঈদের অভিজ্ঞতা

বাংলাদেশে ঈদের দিনে কোলাকুলি
প্রতীকী ছবি

গরু ডাকে হাম্বা হাম্বা ছাগল ডাকে ব্যা,
মহিষ বলে কী হয়েছে এত চেঁচাও ক্যা?
মনের দুঃখে বলে গরু কী আর কব ভাই,
কাল সকালে হতে হবে কুরবানির জবাই!
কেঁদে ছাগল জানায় আমারও কেস তা–ই,
তুমিও ভাই পার পাবে না বাঁচার উপায় নাই!
কথা শুনে মৃদু হাসে মহিষ ভায়া তখন,
ভালো করে বুঝিয়ে দেয় জ্ঞানী গুরুর মতন।

পবিত্র ঈদুল আজহা এখন মুসলমান সম্প্রদায়ের ঘরের দুয়ারে।

গত কয়েক বছরের ঈদ আমার কাছে একই রকম। নিজের আত্মতুষ্টি দিয়ে ঈদ কখনো পূর্ণতা পায় না। হাজারো পথশিশু, শহরের বিশাল বড় বড় অট্টালিকার মাঝের রাস্তায় ফুটপাত বা ওভারব্রিজে না খেয়ে থাকা মানুষগুলো যখন ঈদের দিনে পুরোনো ছেঁড়া পোশাকে নিজের শরীর ঢাকে, আমার কয়েক হাজার টাকার পাঞ্জাবিতে তখন রক্তের দাগ দেখতে পাই। সেই অসহায় মানুষদের খাবারগুলো দেখে নিজেকে ক্ষমা করতে পারি না, তারা আমার ফেলে দেওয়া ডাস্টবিনের খাওয়া তুলে নিজের সন্তানের জন্য নিয়ে যাচ্ছে।

এমনভাবে ঈদের আনন্দ আমি ভোগ করতে চাই না। করোনা মহামারিতে সবচেয়ে কষ্টের দিন পার করছে একই লাল রক্তের কত না অসহায় ভাইবোন। তাদের নিয়ে ঈদ–আনন্দ ভাগ করে নিতে পারা আমার কাছে সৌভাগ্যের, তাহলেই আমার ঈদের আনন্দ বয়ে আনবে।

এ ছাড়া এ ঈদে আমরা জনসমাগম এড়িয়ে চলে নিজেদের এবং প্রিয়জনকে সুরক্ষিত করার মাধ্যমে পালন করতে পারি। এ ছাড়া নিজ নিজ অবস্থানে থেকে হতদরিদ্র, এতিম, দুস্থ, নিঃস্ব ও শত শত ছিন্নমূল মানুষের দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়ে তাদের মুখে হাসি ফোটাতে পারি। সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে পরিবারের মানুষের সঙ্গে পালন হোক এবারের ঈদ।

এদিকে গত বছরের ঈদুল ফিতরের মতো এবার আমাদের মধ্যে করোনাভাইরাসের প্রকোপের তীব্রতা বিরাজমান। তাই গত বছরের চেয়ে ভিন্ন কোনো পরিকল্পনা নেই। সেই একই স্লোগান ‘Stay Home, Stay Safe’। অবশ্য ঈদে ঘর থেকে বাইরে না যেতে পারাটাই বরং মানসিক প্রশান্তি দেয় না। মানসিক শান্তি মাঝেমধ্যে সবকিছুকে ছাপিয়ে যায়।

শৈশবের স্মৃতির ঝাঁপি হাতড়ালে একটা রংচঙে ঈদ ভেসে ওঠে। মেহেদিরাঙা হাত, নতুন জামা-জুতা আর সালামিতে পাওয়া কড়কড়ে নোটগুলো, ঘুরে বেড়ানোর ঈদগুলো রূপকথার মতো সুন্দর ছিল। বড় হলে সবকিছু কেমন পানসে হয়ে যায়, ঈদের আহ্লাদেরাও ছুটি নেয়। এখন ঈদ মানে গোটা দিন গল্পের বই পড়ে কাটিয়ে দেওয়া।

করোনাকালে ঈদের আলাদা কোনো বিশেষত্ব নেই। করোনা ছাড়া ঈদ যেমন ছিল, এখনো তেমনই আছে। মানুষ দিব্যি শপিং করে বেড়াচ্ছে, ঘুরে বেড়াচ্ছে। অন্যান্য বছরের মতোই বাঁকা চাঁদ নিয়ে ঈদ আসবে। বন্ধুর বাড়ি, আত্মীয়ের বাড়ি নিমন্ত্রণ রক্ষায় কোনো ব্যাঘাত ঘটছে না। স্বাস্থ্যবিধি মানছে কজন?

একজন শিক্ষার্থী হিসেবে আমার করোনার কারণে ঈদ করতে কোনো অসুবিধে হচ্ছে না, অসুবিধে হচ্ছে শিক্ষাজীবন নিয়ে, একটা অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ নিয়ে। শিক্ষার্থী পরিচয়টাই এখন রসিকতা মনে হয়।

কঠোর বিধিনিষেধ থাকলেও আশপাশের প্রতিবেশী ও বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে ঘোরাঘুরি হবেই, যা ঈদের আনন্দকে কিছুটা হলেও বাড়িয়ে তুলবে। তবে ব্যতিক্রমী ব্যাপারটা হচ্ছে, আগে যেমন ঈদের ছুটির জন্য সাধারণ স্কুল-কলেজ, ভার্সিটি বন্ধের কারণে একটা অন্য রকম আমেজ থাকত, যা ঈদের আনন্দকে কয়েক গুণ বাড়িয়ে দিত, বর্তমানে কঠোর বিধিনিষেধে সেই আমেজটা থাকবে না।

যদিও পরিবারের সঙ্গে অনেক সময় কাটাতে পারছি, কিন্তু আগের মতো আনন্দটা আর খুঁজে পাচ্ছি না। আশপাশে চোখ দিতেই দেখি হাজারো নিম্নবিত্ত, খেটে খাওয়া অসহায় মানুষ, অনাথ পথশিশু। তাদের থাকছে না পরনের কাপড়, পারছে না দুবেলা খেতে। চারদিকে এসব দেখে চোখ, মুখ আরও ভার হয়ে যায়। এভাবে তো আর ঈদ খুশিতে কাটানো যায় না। যেখানে মানসিক শান্তিটাই নেই, সেখানে ঈদের খুশি কোথায়!
গত বছরের মতো এবার পরিস্থিতি সংকটাপন্ন। পরিবারের সবার সঙ্গে হাসিমুখে ঈদের দিনটি কাটাতে চাই।
*লেখক: মো. হামিদুল ইসলাম, সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, সরকারি তিতুমীর কলেজ, ঢাকা।