একজন হুমায়ূন আহমেদ ও ‘বাদশাহ নামদার’

শিল্পীর তুলিতে প্রিয় ফিনিক ফোটা জ্যোৎস্নায় হুমায়ূন আহমেদ।
অলংকরণ: আরাফাত করিম

বিচিত্র বিষয়ে আগ্রহ ছিল হুমায়ূন আহমেদের। গল্প, উপন্যাস ও ছোটগল্প লিখে যেমন পাঠকের হৃদয় জয় করেছেন, তেমনিভাবে সৃজনশীলতার স্বাক্ষর রেখে গেছেন নাটক ও চলচ্চিত্রে। হুমায়ূন আহমেদ রচিত প্রথম উপন্যাস ‘নন্দিত নরকে’, ১৯৭২ সালে প্রকাশিত হয়। তাঁর টেলিভিশন নাটকগুলো ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করে। হুমায়ূন আহমেদ রচিত অন্যতম উপন্যাসগুলো হলো ‘মধ্যাহ্ন’, ‘জোছনা ও জননীর গল্প’, ‘মাতাল হাওয়া’, ‘লীলাবতী’, ‘কবি’, ‘বাদশাহ নামদার’ ইত্যাদি।

ইতিহাসকে আশ্রয় করে হুমায়ূন আহমেদ যে কটি উপন্যাস লিখেছেন, তার মধ্যে ‘বাদশাহ নামদার’ অন্যতম। ২০১১ সালের অমর একুশে গ্রন্থমেলায় উপন্যাসটি প্রকাশিত হয়।

মুঘল সম্রাট হুমায়ুনের বৈচিত্র্যময় শাসনকাল, তাঁর চরিত্রের খামখেয়ালিপনা এবং চারপাশের বহুবর্ণের বিচিত্র মানুষকে ইতিহাসের পাতা থেকে হুমায়ূন আহমেদ তাঁর এই উপন্যাসে চিত্রিত করেছেন। সুন্দর ও সাবলীল ভঙ্গিতে মুঘল সাম্রাজ্যের চমকপ্রদ উপস্থাপনে এ উপন্যাসে ইতিহাস জীবন্ত হয়ে পাঠকের সামনে উন্মোচিত হয়েছে।

কাহিনি বর্ণনা—
‘রাজ্য হলো এমন এক রূপবতী তরুণী
যার ঠোঁটে চুমু খেতে হলে
সুতীক্ষ্ণ তরবারির প্রয়োজন হয়।’

কবিতার এ চরণ পছন্দের, তাই এই চরণ দিয়ে শুরু করলাম। এবার আসি মূল কাহিনিতে। পানি পথের প্রথম যুদ্ধে বাবর ইব্রাহিম লোদিকে পরাজিত করে ভারতবর্ষে মুঘল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। বাবরের প্রথম পুত্র হুমায়ুন মীর্জা। লেখক মূলত বাদশাহ হুমায়ুনকে কেন্দ্র করেই উপন্যাসটি রচনা করেছেন।

ছবি: সংগৃহীত

সম্রাট বাবর চেয়েছিলেন তাঁর পুত্র হুমায়ুন সিংহাসনের দায়িত্ব নেবেন। কিন্তু হুমায়ুন ছবি আঁকতে, বই পড়তে, শের রচনা করতে ভালোবাসেন। প্রকৃতিপ্রেমী হুমায়ুনের প্রকৃতির মধ্যেই ছিল প্রকৃত সুখ। হুমায়ুন একবার খুব অসুস্থ হলেন। সব চিকিৎসক তাঁর বাঁচার আশা ছেড়ে দিলেন। সম্রাট বাবর নিজের জীবনের বিনিময়ে পুত্রের জীবন ভিক্ষা চাইলেন আল্লাহর কাছে। ৫০ বছর বয়সে সম্রাট বাবর মারা যান। তাঁর মৃত্যুর তিন দিন পর সিংহাসনের দায়িত্ব নেন হুমায়ুন মীর্জা।

হুমায়ুনের দুই ভাই কামরান মীর্জা আর হিন্দাল মীর্জা শুরু থেকেই তাঁর বিরোধিতা করে আসছেন। হুমায়ুনের কাছে চিতোরের রানি কর্ণাবতী সাহায্য চেয়ে একটি পত্র পাঠান। দরবারের সব আমির সম্রাটকে নিষেধ করেন সাহায্য করতে। কারণ, মুঘল সাম্রাজ্য এখন মহাবিপদে। আমিররা বলেন, শাহেনশাহ, রাজনীতিতে আবেগের কোনো স্থান নেই। উত্তরে বাদশাহ বলেন, ‘আমার রাজনীতিতে আছে। একজনের চরম বিপদে আমি যখন তার পাশে দাঁড়াব, আমার বিপদেও কেউ না কেউ আমার পাশে দাঁড়াবে।’
বাদশাহ দায়িত্ব পালনের সময় সঙ্গে পান সাহসী সেনাপতি বৈরাম খাঁকে। মুঘল শাসন পুনঃপ্রতিষ্ঠায় তাঁর অবদান সবচেয়ে বেশি। অন্যদিকে, মুঘল সাম্রাজ্যের শত্রু শেরশাহ শক্তি সংগ্রহ করছেন মুঘল সাম্রাজ্য আক্রমণের জন্য। শেরশাহ খুব ভালোভাবে জানতেন, শক্তিতে তিনি কখনোই হুমায়ুনকে পরাজিত করতে পারবে না। তাই তিনি হুমায়ুনের দুর্বল দিককে কাজে লাগিয়ে রাতের অন্ধকারে ঘুমন্ত সৈনিকদের ওপর হামলা চালান।

হুমায়ূন আহমেদ

বাদশাহ জীবন রক্ষার জন্য নদীতে ঝাঁপ দেন। সেখানে ভিসতিওয়ালা নাজিম তাঁর জীবন বাঁচান। শুরু হলো হুমায়ুনের কষ্টের জীবন। হুমায়ুন আশ্রয় নেন বীরভূমে। সেখানেও শেরশাহর লোকেরা আক্রমণ চালায়। বাদশাহ নদীপথে পালিয়ে যাওয়ার সময় বৈরাম খাঁর সঙ্গে দেখা হয়। ভগ্ন হৃদয় নিয়ে হুমায়ুন আগ্রায় পৌঁছান।

হুমায়ুনের দুই ভাই মুঘল সাম্রাজ্য ফিরে পেতে সব ধরনের সাহায্যের ওয়াদা করেন। ফলে, বাদশাহ শেরশাহের সঙ্গে কনৌজের যুদ্ধে লিপ্ত হন। কিন্তু এই যুদ্ধেও বাদশাহর শোচনীয় পরাজয় ঘটে। পরাজয়ের কারণ ভাইদের বিশ্বাসঘাতকতা। শুরু হয় হুমায়ুনের যাযাবর–জীবন।

একদিন মায়ের সঙ্গে সাক্ষাৎ করার জন্য লুকিয়ে রাজদরবারে আসেন। সেখানে দেখা হয় হামিদা বানুর সঙ্গে। হুমায়ুন যেকোনো মূল্যে হামিদা বানুকে বিয়ে করতে চান। এই হামিদা বানুই হয় বাদশাহর পঞ্চম স্ত্রী এবং দুঃসময়ের সঙ্গী। আর হামিদা বানুর গর্ভেই জন্মায় পৃথিবীর সেরা নৃপতি সম্রাট আকবর। স্ত্রী হামিদা বানুর সঙ্গে শুরু হয় সম্রাটের পথেপ্রান্তরের জীবন। হুমায়ুন বিভিন্ন দুর্গে আশ্রয় নেন। সবাই আশ্রয় দিলেও তাঁদের মূল উদ্দেশ্য থাকে কোহিনূর হীরা নেওয়া এবং সম্রাটকে শেরশাহের হাতে তুলে দেওয়া। সেনাপতি বৈরাম খাঁ নিজের জীবনের বিনিময়ে সম্রাটের জীবন বাঁচান।

১৫৪২ সালে জন্ম হয় আকবরের। শিশুপুত্রকে নিয়ে পথে পথে ঘুরতে থাকেন তাঁর পিতা–মাতা। বাদশাহ হুমায়ুন আজ বড়ই ক্লান্ত। তিনিএভাবে আর পারছেন না। তিনি সিদ্ধান্ত নেন পারস্য হয়ে মক্কা চলে যাবেন। তাই তিনি পারস্যের সম্রাট শাহ তামাস্পের কাছে আশ্রয় নেন। এদিকে পারস্যের সম্রাটের কাছে মীর্জা কামরান পত্র পাঠান হুমায়ুনকে জীবিত বা মৃত্যু তাঁর হাতে তুলে দিতে, বিনিময়ে তিনি কান্দাহার পারস্য সম্রাটকে উপহার দেবেন।

কিন্তু শাহ তামাস্প তা করলেন না। তিনি হুমায়ুনকে সব ধরনের সাহায্য করলেন মুঘল সাম্রাজ্য ফিরে পেতে। হুমায়ুন প্রথমে কান্দাহার জয় করলেন, এরপর কাবুল। হুমায়ুন আবার কঠিন পীড়ায় আক্রান্ত হলেন। এর মধ্যে সেনাপতি বৈরাম খাঁ সিকান্দার শাহকে পরাজিত করে দিল্লি দখল করেন। বাদশাহ হুমায়ুন সুস্থ হয়ে ১৫৫৫ সালের ২৩ জুলাই দিল্লির সিংহাসনে বসেন।

আমার উপলব্ধি

বইটি পড়তে গিয়ে কিছু ঘটনা পাঠকহৃদয়কে ছুঁয়ে যায়। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ঘটনাগুলো হলো—

বাদশাহ প্রজাদের দুঃখ–কষ্ট দেখার জন্য ছদ্মবেশে রাজ্যে ঘুরে বেড়াতেন। নদীর ঘাটে দেখেন, একটি অল্পবয়সী মেয়েকে সতীদাহ করা হচ্ছে। বাদশাহ মেয়েটিকে উদ্ধার করে দরবারে নিয়ে আসেন। মেয়েটি বাদশাহ কন্যার সঙ্গী হিসেবে তাঁর সঙ্গে থাকে। এখানে জাতি–ধর্মের মধ্যে বাদশাহ কোনো পার্থক্য করেননি।

বাদশাহর দক্ষ কামানচি রুমী খাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ আসে, তিনি চুনার দুর্গ দখলের সময় ৩৫০ মানুষের হাত কেটে নেওয়ার আদেশ দেন। রুমী খাঁ বলেন, ‘অভিযোগ সত্য। আমি যা করেছি, সম্রাটের নিরাপত্তার জন্য করেছি। কারণ, তারা সবাই দক্ষ কামানচি।’ হুমায়ুন এতে ভীষণভাবে অখুশি হন। তিনি বলেন, ‘আপনি ভয়াবহ অন্যায় করেছেন। তার শাস্তি আপনার দুই হাত কেটে নেওয়া।’ এখানে বাদশাহ হুমায়ুন ন্যায়বিচারের অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন।

বাদশাহ যখন দিল্লির সিংহাসনে বসেন, তখন গরিব ভিসতিওয়ালা তাঁর সঙ্গে দেখা করেন। হুমায়ুন তাঁর ওয়াদা রক্ষায় এক দিনের জন্য তাঁকে সিংহাসনে বসান। এতে দরবারের সবাই হাসাহাসি করেন। হুমায়ুনের ভাইয়েরা এটি মেনে নিতে পারেন না। সবাই যুক্তি দিয়ে বাদশাহকে বোঝানোর চেষ্টা করেন। উত্তরে বাদশাহ বলেন, ‘যুক্তি দিয়ে সবকিছু হয় না। যুক্তির ওপরে অবস্থান করে মানুষের হৃদয়। দুঃসময়ে আমরা অনেক কথা দিলেও পরে তা ভুলে যাই।’ বাদশাহ যেভাবে কথা রেখেছেন, তা সত্যিই শিক্ষণীয়।
মীর্জা কামরান বাদশাহকে হত্যার ষড়যন্ত্র করেন। কিন্তু তা প্রকাশ পেলে তাঁর শাস্তি হয় মৃত্যুদণ্ড। কিন্তু বাদশাহ হুমায়ুন তাঁকে ক্ষমা করে দিয়ে তাঁর সঙ্গে আলিঙ্গন করেন। বাদশাহ বলেন, ‘আমার মহান পিতা মৃত্যুর আগে আমাকে বলেছেন, তুমি সব সময় ভাইদের দেখবে ক্ষমাসুন্দর চোখে। তারা তোমার প্রতি নির্দয় হতে পারে, কিন্তু তুমি হয়ো না।’ সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আমরা কত কিছু ভুলে যাই। দিল্লির সম্রাট পিতার আদেশ ভুলে যাননি।

বাদশাহ হুমায়ুন যখন হামিদা বানুকে বিয়ের প্রস্তাব দেন, তখন হামিদা বানু বলেন, ‘আমি এমন একজনকে বিবাহ করব, চাইলেই যেন তার হাত ধরতে পারি, তার পাশাপাশি বসে জোছনা দেখতে পারি। এমন কাউকে বিবাহ করব না, যার সামনে যেতে তিনবেলা আমাকে কুর্নিশ করতে হবে।’ এখানে হামিদা বানুর কত সরল উত্তর। কত সুন্দর জীবনবোধ। যেখানে অর্থ, যশ, খ্যাতির প্রতি তাঁর কোনো লোভ নেই।
সাহসী এবং বিশ্বস্ত সেনাপতি বৈরাম খাঁর একটি বিখ্যাত উক্তি: ‘যুদ্ধ এবং প্রেমে কোনো কিছুই পরিকল্পনামতো হয় না’। পাঠকেরা জানেন, মুঘল সাম্রাজ্যে বৈরাম খাঁর অবদান কতটুকু। কিন্তু হুমায়ূনপুত্র আকবর যখন সিংহাসনে বসেন, তখন বাধ্য করেন বৈরাম খাঁকে মক্কা যেতে। আবার পথে আকবরের গুপ্তঘাতকেরা বৈরাম খাঁকে হত্যা করে। এই ঘটনা পাঠকহৃদয়কে ব্যথিত করেছে। মুঘল শাসকদের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন জেগেছে পাঠকমনে।

সর্বশেষে বলি, অমর কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ শেষ জীবনে এসে ইতিহাস–আশ্রিত একটি অসাধারণ উপন্যাস রচনা করেছেন। মনে হয় উপন্যাসটি বারবার পড়ি। পড়া শেষ হলেও ঘোর কাটতে সময় লাগে অনেক দিন। সুখপাঠ্য একটি উপন্যাস। আমি নিশ্চয়তা দিতে পারি, পাঠক উপন্যাসটি পড়া শুরু করলে শেষ না করে উঠতে পারবেন না।

*লেখক: সেতারা কবির, প্রভাষক ও লেখক।