একজন আরজ আলী

ছবি : সংগৃহীত

আরজ আলী। বয়স চৌষট্টি বা পঁয়ষট্টি হবে। ছিলেন সরকারি প্রথম শ্রেণির কর্মকর্তা। বছর সাতেক অবসরে গেছেন। স্ত্রী নাজমা বেগম কিডনি জটিলতায় ভুগে মারা গেছেন তাও প্রায় ১০ বছর হলো। তাঁদের দুই মেয়ে আমেরিকায়। বিয়ে করে ওখানেই থিতু হয়েছে। কালেভদ্রে ওরা দেশে আসে। ফোন করে মাঝেমধ্যে। নাহ, বাবার জন্য তাদের মন কেমন করে সে কারণে নয়। ওরা মোবাইলে বাবার অনেক মিসড কল যখন দেখে, তখন সময় করে একটা কল দেয়। আরজ আলী তাঁর অখণ্ড অবসরে মোবাইল কী করবে কী করবে ভাবতে ভাবতে হাতের মোবাইলে মেয়েদের হরহামেশা কল দিয়ে বসে। ছেলেকেও ফোন করে। ছেলে অবশ্য কখনো তাকে কলব্যাক করেনি। ছেলে করপোরেট অফিসের ডাকসাইটে কর্মকর্তা। ব্যস্ততার শেষ নেই।

জুমার দিনে, ঈদের জামাতে ছেলে বাবাকে সঙ্গে নিয়ে নামাজ পড়তে যায়। নাতি আরিজ আর ছেলের সঙ্গে যখন আরজ আলী একসঙ্গে যান, তখন মন তাঁর আনন্দে ভরে ওঠে। বউমা তিনজনের একরকম পাঞ্জাবিও কিনে দেয় কোনো ঈদে বা পয়লা বৈশাখে। নাতিকে দিয়ে আরজ আলী ছবি তুলে রাখেন। কখনো ফেসবুকেও দেন। তাঁর সৌভাগ্য দেখে বন্ধুরা তাঁকে হিংসা করে।

আরজ আলী থাকেন তাঁর একমাত্র ছেলের বাসায়। ছেলের বাসায় বললে ভুল হবে; বরং তাঁর বাসায় ছেলে থাকে। ছেলের বউ রুমা আর ১৩ বছর বয়সী নাতি আরিজ—এই নিয়েই এখন তার পরিবার। মোহাম্মদপুরের আদাবরে এই অ্যাপার্টমেন্টটা আরজ আলী চাকরি থাকাকালে গিন্নির জেদে ব্যাংক থেকে লোন নিয়ে কষ্টেসৃষ্টে কিনেছিলেন।

স্ত্রী মারা যাওয়ার পর এটাকে আর নিজের বাড়ি মনে হয় না আরজ আলীর। আর কখনো যদি আচরণে তা প্রকাশও পায়, তাহলে বরং অস্বস্তি হয়। ছেলের বউ নিজের পছন্দমতো নতুন করে বাড়িটা সাজিয়েছে। জীবনের এই শেষ প্রান্তে এসে ‘আমার’ শব্দটার কাছে আত্মসমর্পণ করাই বুদ্ধিমানের কাজ। আরজ আলীও তা–ই করেছেন। আমার বাড়ি, আমার সংসার—এ কথা মনেও হয় না এখন তাঁর। কোনোমতে বাকি দিনগুলো পার করে দিতে পারলেই বেঁচে যান। স্রোতে গা ভাসিয়ে চলা আর কী। আজকাল সন্তানদেরও কেমন অন্য গ্রহের অন্য মানুষ মনে হয় তাঁর।

আরজ আলী ফজর নামাজ সেরে চন্দ্রিমা উদ্যানে হাঁটতে যান নিয়মিত। এই সময়টুকু তাঁর একান্ত নিজের। খোলা আকাশ, সবুজ, পথ, মানুষ! বেশ লাগে। এখানে প্রায় সমবয়সী মানুষগুলোর সঙ্গে আরজ আলীর পারস্পরিক বোঝাপড়া বা বন্ধুত্ব হয়ে গেছে। মাঝেমধ্যে হাঁটার পর তাঁরা একসঙ্গে কোথাও নাশতা করেন, আড্ডা দেন। সবার বয়স ও রোগ কাছাকাছি। সবার গল্পও প্রায় এক রকম।
আরজ আলীর তেমন কোনো নির্দিষ্ট শখ নেই। তবে দু–এক পাতা নিয়মিত ডায়েরি লেখেন। ছাত্রজীবনের অভ্যাস। যদিও ফেসবুকিং আর জি বাংলার সিরিয়াল দেখে ইদানীং ডায়েরি লেখায় কিছুটা ছেদ পড়ছে।

আজ সকালে ঘরে ফিরে ডায়েরি নিয়ে বসেন আরজ আলী। সাইড টেবিলে নাশতা ঢাকা দেওয়া আছে। সেই রুটি, সবজি বা বুটের ডাল। খেতে ইচ্ছে হচ্ছে না। নাজমা বেগমের কথা মনে পড়ে। কী যত্ন করেই না তাঁকে খাওয়াতেন! তবে ভাত খাবার সময় নিজ হাতে লেবু চিপে দিতেন। এ দৃশ্যটা খেতে বসলে চোখে ভাসে। আরজ আলী দীর্ঘশ্বাস ফেলেন। বেঁচে থাকতে এই ভালো লাগার কথাটা বলা হয়নি এত দিন একসঙ্গে সংসার করা নিজের স্ত্রীকে। নেহাত পুরুষালি ইগো হয়তো। এ ইগো জিনিসটা না থাকলে বোধ করি সব সংসারেই শান্তি থাকত।

আজ লেখা আসছে আরজ আলীর মাথায়। তাঁর কলম দ্রুত চলছে। লিখছেন জীবনচক্র, জীবনপ্রবাহ নিয়ে নানান ভাবনার কথা। দরজায় ছায়া দেখে তিনি চোখ তোলেন। মায়ের চোখ ফাঁকি দিয়ে তাঁর নাতিটা এসে দাঁড়িয়েছে। দাদুর ডায়েরি নিয়ে নাতি আরিজের সব সময় ভীষণ কৌতূহল। মাঝেমধ্যে তাকে পড়ে শোনাতে হয় কী লিখলেন তিনি। কলম বন্ধ করে আরজ আলী নাতিকে কাছে ডাকেন। বিছানায় বসেই দাদুর মোবাইল নিয়ে শুরু হয় তার গেম খেলা। স্বল্পভাষী হলেও খেলার ফাঁকে ফাঁকে সে তার দাদার সঙ্গে টুকটাক কথা বলতেই থাকে। একসময় প্রতিদিনের মতো আরিজ আজও শুনতে চায় ডায়েরিতে আজ কী লেখা হয়েছে। বুঝুক না বুঝুক, শুনুক না শুনুক, নাতি আরিজের এ আগ্রহটুকুর জন্যই আরও লিখতে ইচ্ছা করে আরজ আলীর।

আরজ আলী ডায়েরিটা খুলে পড়তে শুরু করেন—

মানুষের জীবনের শুরুতে একটা সময় থাকে, যখন জীবন হয় শুধু যোগ অঙ্কের। প্রতিষ্ঠান, পেশা, বাবা-মা, ভাই-বোন, নানা-নানি, দাদা-দাদি, স্বজন, বন্ধু, সহপাঠী অথবা ভালোবাসার একান্তজন। তারপর কর্মজীবন। সফলতার চাবি হাতের মুঠোয় ধরার নিরন্তর চেষ্টা। সংসারী হয় সে। যোগের হিসাব নানা বৈচিত্র্যে পূর্ণতা পায়। নিজের ঘর, জীবনসঙ্গী, সন্তান, আত্মীয়, প্রতিবেশী—ভরভরন্ত জীবন! সময় পরিক্রমায় সূর্য তখন মাথার ওপর!

এরপর কখন যে জীবন পাতায় বিয়োগ অঙ্ক জায়গা করে নেয়। প্রকৃতির নিয়মে একে একে চলে যেতে থাকে পূর্বসূরিরা। নানা-নানি, দাদা-দাদির পর্ব শেষে মা-বাবা, খালা, ফুফু, মামা, চাচাদের যাওয়ার পালা।

আঁচল ধরা সন্তানেরা ঘর ছেড়ে পেছনের পথ পেছনে ফেলে এগোয়। আর সন্তানেরা যদি বিদেশমুখী হয়, তবে সব পাখি ঘরে ফিরলেও তারা আর ফিরে আসে না। দেশে গাদাগাদি করে থাকা ঘরগুলো, কাপড়ে ঠাসা আলমারি, জুতার ড্রয়ার, খাবার টেবিলঘেরা চেয়ার—ফাঁকা হতে থাকে।

একসময় কর্মজীবনের ছোটাছুটি ফুলস্টপে এসে থামে। হঠাৎ পাওয়া হাতের মুঠোয় বেহিসাবি সময়। এত দিনের ঘড়ির কাঁটায় চলা অভ্যাস, কিছুটা অর্থনৈতিক টানাপোড়েন অনেককে একধরনের হতাশায় নিমজ্জিত করে। তবে এই পরিবর্তনকে মানিয়ে নেওয়াই মঙ্গলজনক।

এত দিনের খেয়াল না রাখা নিজের শরীর উচ্চ রক্তচাপ বা অতিরিক্ত শর্করার নোটিশ ঝুলিয়ে অস্তিত্বের জানান দিতে থাকে। সকালে অফিসে ছুটে যাওয়া কর্তাব্যক্তিটিও এত দিনে পার্কে হাঁটতে বের হয়ে পড়ে। পার্কে এসে মেলে নতুন বন্ধু, যাদের জীবনেও পড়েছে পড়ন্ত সূর্যের ছায়া। বাড়িতে রান্নার আয়োজন সংক্ষিপ্ত হয়। সামাজিকতা কমে আসে।

ওষুধ আর ডাক্তারের প্রেসক্রিপশনে ভরে যায় টেবিল। দরজায় কল বেলের শব্দ আগের মতো আর বাজে না। সন্তানের চেয়ে মোবাইল ফোন, টেলিভিশন বেশি প্রয়োজনীয় মনে হয়। এরা সময় কাটাতে সাহায্য করে, একাকিত্ব দূর করে। ধর্মকর্ম, পত্রিকা পড়া, গ্রামের বাড়ি, সমাজসেবা বা সমাজ নিয়ে থাকতে আগের চেয়ে ভালোই লাগে। বয়সকালের সেই দোর্দণ্ড প্রতাপ, রাগ, ভাবসাব মিইয়ে আসে। নিদ্রাস্বল্পতার ঘুম ভাঙা রাতে হঠাৎ চাওয়া–পাওয়ার হিসাব কষে মন। জগৎ–সংসারের প্রতি জমা হয় শীতল অভিমান। কেউ নিজেকে গুটিয়ে নেয়, কেউ নিস্পৃহতার পাহাড় গড়ে।

মৃত্যুর জন্য অপেক্ষার মধ্যে শুরু হয় বদলে যাওয়া পারিপার্শ্বিকতার সঙ্গে মানিয়ে নেওয়া। সমর্পণের চেষ্টা। ঘরদোরে ঝুল জমলে, জায়গার জিনিস জায়গায় না পেলে, তরকারিতে লবণ বেশি হলে আগের মতো আর মেজাজ তিরিক্ষি হয় না। আত্মজ, জীবনসঙ্গীর, এমনকি ঘরের সহযোগীর তিক্ত কথার বর্ষণ না শোনার ভান করে দিব্যি এড়িয়ে যাওয়া যায়। যারা একসময় তার ওপর নির্ভরশীল ছিল, যারা তার সামনে নতজানু হয়ে থাকত, তারাই এখন আর আগের মূল্যায়ন করছে না, তার কোনো মতামত গ্রহণ করছে না। তাতেও সে আর কষ্ট পায় না।

বার্ধক্যে এসে জীবনদর্শন পাল্টে যায়। মৃত্যুভয় ভর করে চিন্তাচেতনায়। শরীর ও মনের সচলতা কমে আসে। ডাক্তারের কাছে চেকআপে যেতে আগের মতো আর ভুল হয় না। নিষ্ক্রিয়তায়, স্থবিরতায় নিজেকে মাঝেমধ্যেই সংসারে অপাঙেক্তয়, অপ্রয়োজনীয় মনে হয়। কখনো সন্তানদের স্বার্থপরতা জীবনের প্রতি জাগায় আরও বিতৃষ্ণা।

এখানেই যদি কারও জীবনের পরিসমাপ্তি ঘটে ভালো। অথবা কোনো এক সকালে যদি ঘুম থেকে আর না জাগে, তাহলে ধরে নিতে হবে তিনি ভাগ্যবান। আর দুর্ভাগা হলে স্ট্রোক, প্যারালাইসিস, আলঝেইমার, বাত বা অচল অস্থিমজ্জা নিয়ে বিছানায় নিজের বর্জ্যের গন্ধের সঙ্গে সকাল–সন্ধ্যা কাটানো। চারপাশের মানুষদের কপাল কুঁচকানো, মুখঝামটা, করুণা তো আছেই! ক্ষুধা, তৃষ্ণা, ঘুমের জাগতিক চাওয়া–পাওয়ার ঊর্ধ্বে উঠে যেতে থাকে মানুষ। তিনি সবার চরম বিরক্তির মধ্যে একদিন তিনি পুত্র–কন্যা বা কারও ঘরে আশ্রয় পান শেষের কটা দিন। অথবা কেউ আইসিইউর বিছানায় চিরতরে চোখ বন্ধ করেন। মৃত্যুর পর ঘরভর্তি কান্নাকাটি কারও কপালে জোটে বা জোটে না। কারও জোটে একটু–আধটু সামাজিক মৌনতা বা দীর্ঘশ্বাস।

এ তো গেল নন–কোভিড মৃত্যুর কথা। এখন কোভিডে মৃত্যু মানেই যেন অপমৃত্যু। অন্য সব যেন স্বাভাবিক মৃত্যু। হয়তো এখন এটাই একমাত্র রোগ যার কারণে কেউ তার কাছে–ধারে ঘেঁষে না। মৃত্যুর আগেও না, পরেও না। কেউ লাশ ধরে না, জানাজা–দাফন থেকে দূরে থাকে শত হাত। সে তার যত আপনিই হোক না কেন!

আরজ আলী অবশ্য এসব নিয়ে ভাবে না। মারা যাওয়ার পরে কে কাছে এল তার, কে আসল না তাতে মৃত ব্যক্তির কীই–বা যায়–আসে! সে তো তখন সকল কিছুর ঊর্ধ্বে। সে তখন অনন্ত যাত্রার যাত্রী।

চোখ ঝাপসা হয়ে আসে বুঝি আরজ আলীর। তিনি ডায়েরিটা বন্ধ করে পাশে রাখেন। নাতি আরিজ কী বুঝল কে জানে! সে এসে দাদার গলা জড়িয়ে ধরে—
‘দাদু, তুমি কিন্তু কোথাও যাবে না—’
আরজ আলীর অনেক দিন বেঁচে থাকতে ইচ্ছে করে।

  • লেখক: মালিহা পারভীন, চিকিৎসক