এ পৃথিবী একবার পায় তারে

জীবনানন্দ দাশ (১৮ ফেব্রুয়ারি ১৮৯৯—২২ অক্টোবর ১৯৫৪)
প্রতিকৃতি: মাসুক হেলাল

‘হাজার বছর ধরে আমি পথ হাঁটিতেছি পৃথিবীর পথে,
সিংহল সমুদ্র থেকে নিশীথের অন্ধকারে মালয় সাগরে
অনেক ঘুরেছি আমি; বিম্বিসার অশোকের ধূসর জগতে
সেখানে ছিলাম আমি; আরো দূর অন্ধকারে বিদর্ভ নগরে;
আমি ক্লান্ত প্রাণ এক, চারিদিকে জীবনের সমুদ্র সফেন,
আমারে দুদণ্ড শান্তি দিয়েছিল নাটোরের বনলতা সেন।
[বনলতা সেন]
যাঁকে বলা হয় রূপসী বাংলার কবি—কেননা তাঁর কবিতার ছন্দ, মর্মস্পর্শী বাণীর আবেদনে বারবার ডেকে আনে বাংলার রূপলাবণ্য—সবুজের মাঠঘাট-খালবিল-হিজল তরু শাখে শীতল স্নিগ্ধতা; তিনিই জীবনানন্দ দাশ।
সাম্য, প্রেম, দহন আর প্রকৃতি তাঁর কবিতায় যেভাবে ফুটে উঠেছে, তা বাংলা সাহিত্যে আর কোনো কবির ভেতর খুঁজে পাওয়া দুস্তর; তাই তিনি বাঙালির কাছে দিনে দিনে হয়ে উঠেছেন হৃদয়ের কবি-প্রেমের কবি-জীবনানন্দের কবি।

তাঁর লেখা বিখ্যাত বনলতা সেন কবিতার প্রেমময়ী এক আশ্চর্য বিভায় আমরা বুঝতে পেরেছি, কতটা গভীর থেকে প্রেমকে অবলোকন করেছেন কবি; পাশাপাশি আমাদের ভক্তমনেও প্রশ্নের অবতরণ হয়েছে, কে এই বনলতা সেন? নাকি কবির এ শুধুই কল্পনাতীত ছায়া দেবী হয়ে এসেছে তাঁর মানসপটে? যে তাঁর জন্য অপেক্ষায় থাকে নিকষ আঁধার পেরিয়ে—বাংলার ঘরে ঘরে—শঙ্খচিল বেশে, ধানসিড়ির কোলে কবি অকাতরেই সঁপে দেয় তার তরে হৃদয়ের সমস্ত আকুলতা—তাই সে মানুষ নামের প্রেমিক।
সেই আনন্দ-সেই সুখের মুহূর্তগুলোই কবিকে করেছে কখনো কখনো বড্ড একা, হৃদয় নিয়ত পুড়িয়েছেন প্রেমিকার অবহেলায়...
১৯৩০–এর যুগের কবি জীবনানন্দ দাশ আধুনিক বাংলা কবিতার আকাশের ক্ষণজন্মা গুটিকয়েক নক্ষত্রমণ্ডলের মতো অন্যতম একজন প্রধান হিসেবে পরিচিত। একটা নিঃসঙ্গ কাব্যময় জীবনে তিনি একদিকে যেমন আধুনিক বাংলা কবিতাকে করেছেন আরও আলোকিত, একাধারে পাঠকের হৃদয়ের মণিকোঠায় মর্মর জাগিয়ে আজন্ম স্থান দখল করে নিয়েছেন অল্প সময়ের মধ্যেই। তাঁর কবিতাভাবনা রবীন্দ্রনাথ এবং নজরুলের কাব্যধারার বাইরে থেকে তিনি হয়ে ওঠেন মৌলিক ও ভিন্ন পথের অনুসন্ধানী এক কবি।

জীবনানন্দ দাশের প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘ঝরা পালক’ প্রকাশিত হয়েছিল ১৯২৭ সালে। এর ৯ বছর পর ১৯৩৬ সালে প্রকাশিত হয় দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ ‘ধূসর পাণ্ডুলিপি’। এ সময়ে কবির মনোজগতে যেমন পরিবর্তন হয়েছে তেমনি রচনাকৌশলও অর্জন করেছে সংহতি এবং পরিপক্বতা। তাঁর তৃতীয় কাব্যগ্রন্থ ‘বনলতা সেন’ প্রকাশিত হয় ১৯৪২ সালে। এটি ‘কবিতাভবন সংস্করণ’ নামে অভিহিত। সিগনেট প্রেস বনলতা সেন প্রকাশ করে ১৯৫২ সালে। ‘বনলতা সেন’ কাব্যগ্রন্থের কবিতাসমূহসহ পরবর্তী কবিতাগ্রন্থ ‘মহাপৃথিবী’ ১৯৪৪ সালে প্রকাশিত। জীবনানন্দের জীবদ্দশায় সর্বশেষ প্রকাশিত গ্রন্থ ‘সাতটি তারার তিমির’ (১৯৪৮)। ১৯৫৪ সালে মৃত্যুর কিছু আগে প্রকাশিত হয় জীবনানন্দ দাশের শ্রেষ্ঠ কবিতা।
‘শেষবার তার সাথে যখন হয়েছে দেখা মাঠের উপরে—
বলিলাম—‘একদিন এমন সময়
আবার আসিও তুমি—আসিবার ইচ্ছা যদি হয়!—
পঁচিশ বছর পরে।’
[পঁচিশ বছর পরে]

জীবনানন্দ দাশ নিজেকে আপাদমস্তক উৎসর্গ করেছেন কবিতার কাছে। শহরজীবন, বন্ধু আড্ডা, পাখির শিস, সবুজ আকাশ আর ভেঙে পড়া রাতের তাবৎ ক্লেদাক্ততায় সুপ্ত শিশিরবিন্দুর মতো মোহ নিয়ে খুঁজেছেন কবিতার নিবিড় স্পর্শ। হয়তো রক্তমাংসের প্রেম না পেলেও প্রকৃতির রূপলাবণ্যে কবি পেয়েছেন বিদায়ের শেষ সন্ধিক্ষণে অস্ত যাওয়া সোনালি দিগন্তে ফেলে রাখা একজোড়া সারসের ডানা ঝাপটে উড়ে যাওয়া আর্তনাদ, ২৫টি বসন্ত পেরোলেও দেখা না হওয়ার এক তীব্র আকাঙ্ক্ষা, চারপাশে চলমান জীবন বাস্তবতার শাণিত রূপ, আবহমান গ্রামবাংলার সবুজ প্রকৃতির মাধুরী মেশানো জ্যোৎস্নায় কচি ধানের শিষের বুকে লেগে থাকা ফসলের নব্য দুধেল ঘ্রাণ। কবিতার মধ্য দিয়ে কবির বুকে রক্তক্ষরণ অতি সূক্ষ্ম মেলবন্ধন ঘটাতে সক্ষম হয়েছে পাঠকের সঙ্গে, তাঁর কলমের কালিতে বারবার বেজে উঠেছে কাদাবালু জলে মিশে থাকা বিষের ভায়োলিন, যার বিরহের সুর ডেকে আনে কেবলই হাহাকার। তবু প্রকৃতির এমন রূপ–মধুরিমায় বারবার মুগ্ধ হয় লিখে ফেলেন তাঁর হৃদয়ের সব অনুভূতি দিয়ে ভালোবাসার এমন শ্রেষ্ঠ আবেদন...লিখেছেন রিক্ততার রোদন থেকে:
সুরঞ্জনা, ওইখানে যেয়ো নাকো তুমি,
বোলোনাকো কথা ওই যুবকের সাথে;
ফিরে এসো সুরঞ্জনা:
নক্ষত্রের রূপালি আগুন ভরা রাতে;
ফিরে এসো এই মাঠে, ঢেউয়ে;
ফিরে এসো হৃদয়ে আমার;
দূর থেকে দূরে—আরো দূরে
যুবকের সাথে তুমি যেয়ো নাকো আর।
কী কথা তাহার সাথে? তার সাথে!
আকাশের আড়ালে আকাশে
মৃত্তিকার মতো তুমি আজ:
তার প্রেম ঘাস হয়ে আসে।
[আকাশলীনা]

প্রেম তার কাছে নিত্যই এক সাবলীল রূপ পেয়েছে, প্রেমিকার বেদনায় ঈর্ষান্বিত হননি বরং তাঁকে ডেকেছেন পিঞ্জরের তাবৎ অনিমেষ তুলে নিয়ে...কবি বারবার প্রেমে পড়েছেন, আঘাত পেয়েছেন, তবু আবার প্রেমে পড়েছেন। জীবনানন্দ দাশের কবিতায় শরীরজুড়ে থাকে বেদনাকাতর প্রেম, আঘাতে ক্ষতবিক্ষত তাঁর শরীর বেয়ে ঝরে পড়া নোনা রক্তের স্রোতোধারা, যার কান্নার রোল তার অগণিত পাঠকহৃদয় আজও আপন আরশিতে বয়ে বেড়ায় নিয়ত।
কবি চলে গেছেন, কবি আদতে কি চলে যায়? কবি তো বারবার ছুটে আসেন রূপবতী বাংলার কোলে, কার্তিকের জ্যোস্নারাতে।
কবি–শিক্ষাবিদ জীবনানন্দ দাশ ১৮৯৯ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি বরিশালে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁদের আদি নিবাস ছিল বিক্রমপুরের গাঁওপাড়া গ্রামে। তাঁর বাবা সত্যানন্দ দাশ ছিলেন স্কুলশিক্ষক ও সমাজসেবক। তিনি ‘ব্রহ্মবাদী’ পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক ছিলেন। মাতা কুসুমকুমারী দাশ ছিলেন একজন কবি।
জীবনানন্দ বরিশাল ব্রজমোহন স্কুল থেকে ম্যাট্রিক (১৯১৫), বিএম কলেজ থেকে আইএ (১৯১৭) এবং কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে ইংরেজিতে অনার্সসহ বিএ (১৯১৯) ও ইংরেজিতে এমএ (১৯২১) পাস করেন। আইন কলেজে ভর্তি হলেও শেষ পর্যন্ত তিনি পরীক্ষা দেননি।

জীবনানন্দ কলকাতা সিটি কলেজে ১৯২২ সালে ইংরেজি সাহিত্যে অধ্যাপনা শুরু করেন। ১৯২৯ সালে তিনি সদ্য প্রতিষ্ঠিত বাগেরহাট প্রফুল্লচন্দ্র কলেজে যোগ দেন, কিন্তু কিছুদিন পর চাকরি ছেড়ে কলকাতায় চলে যান। ওই বছরই (১৯২৯) তিনি দিল্লির রামযশ কলেজে যোগ দেন এবং ১৯৩০ সালে আবার দেশে প্রত্যাবর্তন করেন। পরে কিছুকাল বেকার থেকে জীবনানন্দ ১৯৩৫ সালে বরিশালের বিএম কলেজে যোগ দেন। এভাবে তাঁর কর্মজীবন বিভিন্ন কলেজে অধ্যাপনায় এবং মাঝেমধ্যে অন্য পেশায় অতিবাহিত হয়। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের কিছু আগে তিনি সপরিবার কলকাতায় চলে যান। ১৯৫৪ সালের ২২ অক্টোবর মারা যান তিনি।
বাংলার চির–আধুনিক কবি জীবনানন্দ দাশের প্রয়াণদিবসে তাঁর স্মৃতির প্রতি রইল আজন্মই গভীর শ্রদ্ধা এবং ভালোবাসা...
*[email protected]