আত্মচেতনা উন্মোচনে শিক্ষা

ছবি: সংগৃহীত

সমাজের সঙ্গে শিক্ষার সম্পর্ক অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ। যেকোনো দেশের শিক্ষাব্যবস্থা সেই দেশের সমাজব্যবস্থারই অন্তর্গত। সমাজের সামাজিক নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে শিক্ষা নিয়ামক ভূমিকা পালন করে। শিক্ষার মাধ্যমে সমাজের ঐক্য ও সংহতি সুদৃঢ় হয়।

সমাজের অন্তর্গত মানুষের মধ্যে শিক্ষাই গড়ে তোলে সুস্থ পারস্পরিক সম্পর্ক। শিক্ষার মাধ্যমেই সমাজের বৃহত্তর স্বার্থ ও নাগরিক অধিকার বজায় থাকে। সমাজ জীবনে সম্প্রীতি সৃষ্টি হয়। উপযুক্ত শিক্ষার প্রভাবে সমাজের মানুষ সমাজসচেতন, দায়িত্বশীল ও কর্তব্যপরায়ণ হয়ে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে। এ জন্য যথার্থ শিক্ষিত একজন মানুষ সংকীর্ণ ব্যক্তিস্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠে সাম্প্রদায়িকতার প্রভাব মুক্ত থাকতে পারে। তাই শিক্ষা হলো সমাজের উচ্চতর সোপানগুলোতে উন্নীত হওয়ার জন্য সাহায্যকারী ও গুরুত্বপূর্ণ একটি হাতিয়ার, যা দ্বারা সমাজের মানুষের সামাজিক মর্যাদা নির্ধারিত ও নিয়ন্ত্রিত হয়। এটি একটি নিরবচ্ছিন্ন চলমান প্রক্রিয়া, যা অর্জনের মাধ্যমে সমাজস্থ ব্যক্তি মার্জিত, পরিশীলিত, রুচিবোধসম্পন্ন, জ্ঞান-বিজ্ঞানে উন্নত, আত্মনিয়ন্ত্রিত সুনাগরিক হয়ে গড়ে ওঠে।

এই লব্ধ জ্ঞান অর্জনের জন্য প্রয়োজন শিক্ষালয়। যেখানে শিক্ষার্থী তার চরিত্র গঠন ও ব্যক্তিত্বের বিকাশ সাধনের সুযোগ পায়। একটি বিদ্যালয় শিক্ষার্থীর বয়স, মানসিক প্রকৃতি, অনুরাগ ও রুচি অনুযায়ী জ্ঞান আহরণের ক্ষেত্র হিসেবে কাজ করে। এখান থেকেই শিক্ষা লাভ করে শিক্ষার্থী বৃহত্তর সমাজ জীবনে প্রবেশ করার পথ তৈরি করে। আর মহৎ গুরুদায়িত্বটি একজন আদর্শ শিক্ষক পালন করে থাকেন। তাই শিক্ষার্থীর মধ্যে বিশ্বাস, মূল্যবোধ, দৃষ্টিভঙ্গি ও আচরণের পারস্পরিক সম্পর্ক সৃষ্টি করা একজন শিক্ষকের প্রধান দায়িত্ব ও কর্তব্য।

বিশ্বাস মানুষের মনের একটি বিমূর্ত ধারণা। জন্মলগ্ন থেকে একটি শিশু যা দেখে, শোনে, বোঝে এবং যা থেকে তার ধারণা সৃষ্টি হয়, তা থেকেই তার আদর্শ গড়ে ওঠে। আর আদর্শ তাকে বিশ্বাস গড়ে তুলতে অনুপ্রাণিত করে। বিশ্বাসের সঙ্গে মানুষের আধ্যাত্মিক চেতনা, নীতিবোধ, সামাজিক, অর্থনৈতিক ঐতিহ্যগত এবং যৌক্তিক দৃষ্টিভঙ্গি যুক্ত। কারণ, বিশ্বাসের ভিত্তির ওপর গড়ে উঠে মূল্যবোধের কাঠামো। আধুনিক ধারণা অনুযায়ী মূল্যবোধ হলো কতগুলো জৈব মানসিক সংগঠনের এমন এক সমন্বয়, যা পরিবেশের বৃহৎ অংশকে সক্রিয়তার দিক থেকে সমগুণসম্পন্ন করে তোলে এবং ব্যক্তির মধ্যে উপযুক্ত আচরণ সৃষ্টি করে। আর শিক্ষার সংজ্ঞাতে বলা হচ্ছে আচরণের কাঙ্ক্ষিত স্থায়ী পরিবর্তনকেই বলা হয় শিক্ষা। তাহলে দেখা যাচ্ছে, শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য হলো মানবিক মূল্যবোধসম্পন্ন মানবসম্পদ সৃষ্টি করা। এমন গুণসম্পন্ন হওয়া এবং প্রকৃত মানুষ হিসেবে গড়ে উঠার স্বপ্ন ও অধিকার প্রতিটি শিক্ষার্থীর মধ্যেই সুপ্ত হয়ে বিরাজ করছে। কিন্তু নানা প্রতিকূলতার কারণে তা বিকশিত হতে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।

একজন শিক্ষার্থীর ওপর আগামী দিনের দেশ পরিচালনার দায়িত্ব আসবে, এটাই স্বাভাবিক। তাই তাকে মেধাবী করে তোলার অনুপ্রেরণা ও দায়িত্ব আমরা কেউ অস্বীকার করতে পারি না। শিক্ষক যদি হন জাতি গঠনের কারিগর, তাহলে সেই জাতির মর্যাদা ও উন্নয়ন সমুন্নত রাখতে মানবিক মূল্যবোধসম্পন্ন ভবিষ্যৎ প্রজন্ম তৈরি করাই হবে শিক্ষকের ব্রত। সেই দৃষ্টিকোণ থেকে অবহেলিত পিছিয়ে পড়া দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে সময়ের সঙ্গে সমানভাবে এগিয়ে নিতে সরকারের বিভিন্ন উদ্যোগের পাশাপাশি শিক্ষকসমাজকে আরও দৃঢ়তার সঙ্গে অগ্রণী ভূমিকা রাখা প্রয়োজন।

শিক্ষকের উদারতা, মহানুভবতা, ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি শিক্ষার্থীর অন্তরে লালিত প্রত্যাশার অঙ্কুরোদ্‌গম ঘটায়। একসময় তা পূর্ণতা পায়। শিক্ষার্থীর এই প্রাপ্যতা নিশ্চিতকরণের মধ্য দিয়েই একজন শিক্ষক তার মধ্যে বেঁচে থাকার স্বপ্ন দেখেন। অন্যদিকে এই দায়িত্ব যথাযথ ও আন্তরিকতার সঙ্গে পালনের জন্য প্রয়োজন শিক্ষকের উপযুক্ত সুযোগ–সুবিধা, সুষ্ঠু পরিবেশ ও সামাজিক মর্যাদা রক্ষা নিশ্চিত করা। শিক্ষক এই সমাজেরই কোনো পরিবারের সদস্য। তাঁরও একটি পরিবার আছে। তাই মহান এই দায়িত্ব পালনে নিয়োজিত মানুষগুলোর প্রতি সরকারেরও সুদৃষ্টি দেওয়া একান্ত প্রয়োজন। যাতে শিক্ষক তাঁর পেশাগত দায়িত্ব পালনে নিজেকে কেবল শিক্ষার্থীর মধ্যে আবিষ্কার করার অনুসন্ধান করেন। ফলে একজন শিক্ষক নিত্য মনস্তাত্ত্বিক গবেষণার মধ্যে নিজেকে ডুবিয়ে রাখবেন এবং শিক্ষার্থীকে তার অন্তরাত্মার স্বরূপের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেবেন। সরকারের আন্তরিকতা ও সঠিক সিদ্ধান্তে শিক্ষকের বিবেকবোধ শিক্ষার্থীকে মেধাবী হিসেবে গড়ে তোলার সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালিয়ে নিতে সাহায্য করবে। কারণ, একজন মানবিক গুণাবলিসম্পন্ন মানুষ তৈরি করাই শিক্ষকতা জীবনের সবচেয়ে বড় স্বার্থকতা। একজন মানুষ যখন তার মানবিক মূল্যবোধ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়, তখন তার দ্বারা এমন কোনো হীন কাজ নেই, যা করা অসম্ভব হয়। ফলে সমাজ ও ব্যক্তিজীবনে অপরাধপ্রবণতা বেড়ে যায়। অন্যদিকে যে জাতি যত শিক্ষার দিক থেকে উন্নত, তারা ততটা শৃঙ্খলাবদ্ধ ও ঝামেলাহীন জীবন যাপন করে। তাই শিক্ষার মাধ্যমেই এমন রুচিশীল, দুর্নীতিমুক্ত, কল্যাণময় চিন্তাশীল সমাজব্যবস্থা গড়ে তোলা সম্ভব। এ জন্য সরকার ও শিক্ষকের আন্তরিকতা ও সমন্বয়তা মানবসম্পদ উন্নয়নে অংশীদারত্বের মাধ্যমে প্রগতিশীল এবং প্রতিষ্ঠিত করার জোরালো ভূমিকা রাখে। শিক্ষা অর্জনের উদ্দেশ্য যদি হয় শুধু অর্থ উপার্জনকেন্দ্রিক, তাহলে একসময় সমাজে মানুষ তৈরি হবে না, তৈরি হবে মানুষের মতো দেখতে অর্থপ্রত্যাশী অবয়ব। যার অন্তরে অর্থ উপার্জনের নানা কৌশল নিয়ে গবেষণা চলবে অবিরত। ফলে যেকোনোভাবে অর্থ প্রাপ্তির কামনায় দুর্নীতিসহ মিথ্যার আশ্রয়ে নিজেকে লাভবান করার প্রয়াস সৃষ্টি করবে। প্রকৃতপক্ষে সে লাভবান না হয়ে বরং অভিশপ্ত জীবনের গ্লানি নিয়ে পৃথিবী থেকে বিদায় নেবে। মানবজীবনে বেঁচে থাকতে অর্থের প্রয়োজন আছে এ কথা ঠিক, কিন্তু তা প্রয়োজনের তুলনার অধিক চিন্তা না করাই ভালো। কারণ, জীবনের সময় খুবই স্বল্প। যে সময়ে মানবকল্যাণে আত্মনিয়োগ করাটাই শ্রেয়। তাই শিক্ষা অর্জন হোক আত্মচেতনা উন্মোচনের একমাত্র নির্ধারিত পথ। আর শিক্ষক হোন তার প্রেরণাকারী পথপ্রদর্শক।

প্রকৃত শিক্ষা লাভের মধ্য দিয়েই মানবিক মূল্যবোধ সৃষ্টি হোক। মুক্তিযুদ্ধের আদর্শিক চেতনা ও মূল্যবোধ নিয়ে এগিয়ে যাক বাংলাদেশ। মানবতা ও মানুষের জয় হোক।
*লেখক: জুলফিকার বকুল, শিক্ষক, ঢাকা ইঞ্জিনিয়ারিং ইউনিভার্সিটি স্কুল, গাজীপুর।