আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্রের নামে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে তোলা হোক

‘স্কুলের শুকনো বইখাতা থেকে মুক্তি পেয়ে আমি সুযোগ পেয়েছিলাম নিজের পছন্দানুযায়ী বই পড়ার।’ উক্তিটি ছিল বিখ্যাত বাঙালি বিজ্ঞানী আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র (পি সি) রায়ের। পি সি রায় ছিলেন মূলত একজন রসায়নবিদ। রসায়নকে শুধু ঘরে সীমাবদ্ধ না রেখে তাকে বাস্তব জীবনে কাজে লাগানোর প্রচেষ্টাই ছিল তাঁর মূল লক্ষ্য। আর তারই ধারাবাহিকতায় তিনি ১৮৯৫ সালে মারকিউরাস নাইট্রাইট [Hg2 (NO2) 2] আবিষ্কার করেন।

ব্যক্তিগত জীবনে বাঙালি বিজ্ঞানী আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায় ছিলেন খুবই সাধাসিধে। পিতা তদানীন্তন জমিদার থাকলেও পাশের বাড়ির দশটা ছেলের মতো তিনি শৈশব-কৈশোর কাটিয়েছেন। তবে তাঁর দেশপ্রেম, মানবপ্রেমই হয়তো আজ তাঁকে স্মরণে রাখার অন্যতম কারণ। কেননা, তিনি দেশকে অত্যন্ত ভালোবাসতেন এবং দানশীলতায় তিনি ছিলেন অনন্য দৃষ্টান্ত।

১৮৬১ সালের ২ আগস্ট খুলনার পাইকগাছা উপজেলার বাড়ুলী গ্রামে আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায় জন্মগ্রহণ করেন। পিতার প্রতিষ্ঠিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকেই তাঁর হাতেখড়ি হয়।

এরপর বিভিন্ন স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া করে তিনি সর্বোচ্চ ডিগ্রি অর্জন করেন। অসাম্প্রদায়িক চেতনার মানুষটি চেয়েছিলেন গতানুগতিক সমাজের শিক্ষাব্যবস্থা থেকে বেরিয়ে এসে গবেষণালব্ধ সৃজনশীলতায় প্রত্যেক ছাত্রছাত্রীকে গড়ে তুলতে। তিনি শিক্ষার্থীদের মধ্যে গবেষণার বীজ ছড়িয়ে দিতে চেয়েছিলেন। এটাই ছিল কর্মজীবনের অন্যতম একটি লক্ষ্য। এ জন্য তাঁর এ স্বপ্নকে বাস্তবায়ন করতে তাঁর নামে দক্ষিণাঞ্চলে একটি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে তোলা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশেষ করে দেশের খুলনা, সাতক্ষীরা ও বাগেরহাটে কোনো প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় না থাকায় গবেষণা খাতে পিছিয়ে আছে এ অঞ্চল। তাই দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সবশেষ এই জনপদগুলো থেকেও আমাদের নতুন কিছু করার স্বপ্ন দেখাতে হবে। আর বিশেষ করে আমরা গবেষণা নামক শব্দটি থেকে ধীরে ধীরে দূরে সরে আসছি, যেটি আমাদের জন্য বড় একটি দুঃসময় বয়ে আনছে। সেসব দিক বিবেচনা করে, পি সি রায়ের স্মৃতি রক্ষার্থে দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের এই প্রাণের দাবি বাস্তবায়ন করতে হবে।

পি সি রায় স্থানীয়ভাবে শিক্ষার আলো জ্বালাতে নিজ গ্রামেই ১৯০৩ সালে পিতার নামে আর কে বি কে হরিশ্চন্দ্র স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন। এরপর তিনি ১৯১৮ সালে বাগেরহাটে পি সি কলেজ নামে একটি কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন। যে প্রতিষ্ঠানগুলো দেশের শিক্ষা বিস্তারে আজ বিশাল ভূমিকা রেখে চলেছে। আচার্য দেব সমাজের পিছিয়ে পড়া মানুষের কল্যাণে স্থায়ী উন্নয়ন সাধনায় বিশ শতকের শুরুতেই ১৯০৯ সালে নিজ জন্মভূমিতে রাড়ুলী সেন্ট্রাল কো-অপারেটিভ ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করেন। যেটি ছিল অবিভক্ত বাংলায় প্রথম গ্রামীণ সমবায় ব্যাংক। দুঃখজনক হলেও সত্য, তার প্রতিষ্ঠিত এ সমবায় ব্যাংকটি আজ অবহেলা, অনাদরে পড়ে আছে। পাশে থাকা তাঁর মায়ের নামে গড়া দেশের প্রথম বালিকা বিদ্যালয় এবং পিতার নামে গড়ে তোলা প্রতিষ্ঠানটি আজও জাতীয়করণ করা হয়নি। সম্প্রতি দেখা গেছে, স্যার পি সি রায় স্মৃতি সংসদের উদ্যোগে স্যার পি সি রায়ের স্মৃতি সংরক্ষণ ও স্যার পি সি রায় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার দাবিতে কয়েকবার মতবিনিময় সভা, সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়েছে। সেখানেও তারা বিষয়টি নিয়ে জোর দাবি জানিয়েছে।

তাই দেশের দক্ষিণাঞ্চলের সবশেষ জেলা সুন্দরবনের কোল ঘেঁষে গড়ে ওঠা খুলনার পাইকগাছায় বিশ্ববরেণ্য এ বিজ্ঞানীর নামে একটি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে তোলা হোক, যেখানে উচ্চশিক্ষার জন্য স্থানীয় তরুণ সমাজ সুযোগ পাবে, নতুন প্রজন্ম জানতে পারবে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের এমন একজন মহৎ মানুষের কর্মময় জীবনী সম্পর্কে।

লেখক: রিয়াদ হোসেন, শিক্ষার্থী, সরকারি বিএল কলেজ, খুলনা।