বেঙ্গালুরু ভ্রমণ: সিটি অব লাইফ

২০১৯ সালের নভেম্বর। সকাল সকাল খালি একটা অটো পেতেই চড়ে বসলাম। বেঙ্গালুরু শহর ঘুরে দেখার জন্য হাতে সময় আছে মাত্র ১০ ঘণ্টা। অতএব যা দেখার ঝটপট দেখতে হবে। এদিকে পর্যবেক্ষক বুঝতে পেরে অটোচালক নিজেই গাইড হওয়ার প্রস্তাব দিলেন। এ যে মেঘ না চাইতে বৃষ্টি! আমরা সানন্দে রাজি।

শহরের চওড়া রাস্তা দিয়ে অটো ছুটতে শুরু করল। প্রথমে পৌঁছালাম ফ্রেজার টাউনে। সেই ভোরে নাশতা করেছি। খিদেয় পেট চোঁ–চোঁ করছে। অটোচালক একটা রেস্তোরাঁর সামনে থামিয়ে বললেন, এটার খাবার ভালো। বেঙ্গালুরু যত সুন্দরই হোক, এদের খাবারটা একটু অন্য রকম। প্রথমবার খাবারের স্বাদ মুখে নেওয়ার পর দ্বিতীয়বার খাওয়ার চেষ্টা করাটা আমার জন্য কঠিনই বটে। আর আমার জীবনসঙ্গীর কথা বাদই দিলাম। খাওয়ার বেলায় তাঁর খুঁতখুঁতের শেষ নেই। তাই এবার খাবার পছন্দ করার দায়িত্বটা তিনিই নিলেন। অনেক চিন্তাভাবনা করে অর্ডার দেওয়ার পর পাতলা রুটি আর গ্রিল করা মুরগির মাংস টেবিলে এল। প্রচণ্ড ক্ষুধায় আমরা দুজন সেই খাবারের ওপর হামলে পড়লাম। নাহ্‌! আমাদের চালক ভুল বলেননি। বেঙ্গালুরুর এই মুসলমান পাড়ার রেস্তোরাঁর রান্না অসাধারণ! মুখে দিতেই চোখ আপনাই তাই বড় হয়ে গেল (লিখতে লিখতেই জিভে জল এসে পড়েছে)। আরামে বার কয়েক ঢেঁকুর তুলে আবার ছুটলাম।

অটোচালক আমাদের নিয়ে গেলেন বেঙ্গালোর প্রাসাদে। বসন্তনগরে প্রায় ১৩২ বছর বয়সী এ প্রাসাদের রাজা ছিলেন চামারাজা ওদিয়ার। টিকিট কেটে আমরা ভেতরে ঢুকে পড়লাম রাজাদের জীবন বোঝার জন্য। নিচতলায় ঝলমলে ঝাড়বাতিওয়ালা দরবার হল। দেয়ালে কারুকাজ আর দুটি হাতির মাথা শোভা পাচ্ছে। সিঁড়ির হাতলগুলোতেও নকশা। আরেকটি ঘরে রাজা ও তাঁদের পরিবারের সদস্যদের ব্যবহৃত কাপড়। অন্য ঘরে তৈজসপত্র।

দোতলায় উঠে পড়লাম। সারি সারি সেগুনকাঠের তৈরি নকশাখচিত দরজা। সঙ্গী একটি ছবি তুললেন। সঙ্গে সঙ্গে কোথা থেকে নিরাপত্তা প্রহরী উদয় হলেন! গম্ভীরভাবে আমাদের অনুরোধ করলেন ছবিটা বাদ দেওয়ার জন্য। অগত্যা তাঁর সামনে ছবি বাদ দিয়ে দিতে হলো। দোতলা থেকে উঁকি দিতেই দেখলাম আলপনার মতো নকশা করা উঠান। বেশ লাগছিল। হেঁটে হেঁটে অন্য পাশের সিঁড়ি দিয়ে নিচে নেমে এগোতেই সঙ্গীর উত্তেজিত ডাক কানে এল। ফিরে তাকিয়ে আঁতকে উঠলাম! কয়েকটি টি–টেবিলকে তিনি খুব মনোযোগ দিয়ে দেখছেন। কারণ, এর পায়াগুলো সাধারণ কোনো কিছু নয়। বড় হাতির পাকে পায়া হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। মনে হলো, দেয়ালে থাকা হাতির মাথাগুলো এসব পায়ের মালিক। ফোঁস করে নিশ্বাস ছেড়ে অন্দর থেকে বেরিয়ে এলাম।

বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা কামানগুলো আর বিশাল বাগান মনে করিয়ে দিচ্ছিল, রাজাদের জীবন মানে অন্য রকম ব্যাপার-স্যাপার।

পরের গন্তব্য ইন্দিরা গান্ধী মিউজিক্যাল ফাউনটেন পার্ক। সেখানে নেমে জানতে পারলাম, পার্কটি ওই দিন সরকারিভাবে বন্ধ। তবে হেঁটে ঘুরে আসা যাবে। আমরা নেমে পড়লাম। সবুজের ভেতরে একটু হাঁটতেই একটি রকেট, একটি উড়োজাহাজ সামনে এল। আমাদের মতো কয়েকটি পরিবার তাদের শিশুদের নিয়ে এসেছিল। একটু এদিক-সেদিক করে আমরা আবার অটোতে উঠে বসলাম।

মধ্যদুপুর নাগাদ আমরা চলে এলাম মাভালি এলাকায়। এখানে আছে লালবাগ বোটানিক্যাল গার্ডেন। ২৪০ একরের এ বাগানের পরিবেশ দেখে আমরা যারপরনাই মুগ্ধ। পরিষ্কার রাস্তা, সাজানো গাছ। অল্প সময়ে বেঙ্গালুরুর এই বিষয় দারুণ লেগেছে। ওদের রাস্তাঘাট পরিষ্কার। এমনকি বাসস্টেশনের মতো ভিড়ভাট্টার জায়গাতেও একটুখানি ময়লা নেই! সেই পরিষ্কারের নমুনা দেখতে পেয়ে আমি অবাক হয়ে ছবি তুলে রেখেছিলাম। সে যাকগে। বোটানিক্যাল গার্ডেনে দেখলাম ছোট ছোট গাড়িতে ১০-১২ জনকে তুলে নিয়ে পুরো এলাকা ঘুরিয়ে দেখানোর ব্যবস্থা আছে। বিশেষ করে এখানে ফুলের প্রদর্শনীর জন্য তৈরি কাচের ঘরগুলো চমৎকার। প্রায় দুই হাজার প্রজাতির গাছ এখানে আছে। স্কুলের শিক্ষার্থীরা দল বেঁধে ঘুরছে। বাচ্চারা দৌড়াচ্ছে।

চলছে অল্পস্বল্প বাদাম, আইসক্রিম, নারকেল ও কাঁচা আমের বিকিকিনি। পাশে একটি অংশে বনসাইয়ের বাগান। ৬০ বছরের পুরানো এক বনসাইকে ফ্রেমবন্দী করে ফেললাম। এরপর বেরিয়ে কাঁচা আম হাতে নিলাম। কিশোর ছেলেটি বিশাল একটি আম চার ফালি করে কেটে আচ্ছামতো মরিচের গুঁড়া দিয়ে দিল। আর বলল, খোসাসহ খেতে। কামড় দিয়ে বুঝলাম, দেশের কাঁচামিঠা আম যেমন মজার, তেমনি এটার স্বাদও কম যায় না। খালি খোসাসহ অত বড় বড় টুকরা খেতে গিয়ে মুখ ব্যথা হয়ে গেল!

দক্ষিণ ভারতের তাজমহল
পথে যেতে যেতে সাম্পাঞ্জি রামনগর এলাকায় চোখে পড়ল বিশাল একটি ভবন। প্রাসাদই বলা যায়। জানলাম, এটি রাজ্য আইনসভা এবং কর্ণাটকের সচিবালয় ভবন—বিধান সৌধ। যাকে নাকি অনেক সময় ‘দক্ষিণ ভারতের তাজমহল’ বলে। নেমেই টপাটপ কয়েকটি ছবি তুলে ফেললাম। অটো ওঠার আগমুহূর্তে এক শসা বিক্রেতার ওপর নজর গেল। ১০ রুপির একটি শসা মুখে দিতেই মনে হলো, আমার জীবনের সেরা শসা খাচ্ছি। এত মজার স্বাদের শসা আজ পর্যন্ত খাইনি! ভেবে রেখেছি, আবার কোনো দিন এখানে আসার সুযোগ হলে মন ভরে শসা খাব।

শ্রীরানগাপাথা এলাকায় মহীশূরের রাজা টিপু সুলতানের গ্রীষ্মকালীন প্রাসাদে এরপর আমরা ঢুকে পড়লাম। কাঠ আর মার্বেলের কী অর্পূব কারিগরি। দোতলা প্রাসাদটি এমনভাবে তৈরি যাতে চারদিক থেকে বাতাস বয়ে যেতে পারে। আমাদের অটোচালক যেখানেই নিয়ে যাচ্ছিলেন, সেখানকার গল্পও বলে দিচ্ছিলেন। আসার সময় তিনি বলছিলেন, ১৭৯১ সালে এর কাজ শেষ হয়। পরে একসময় ব্রিটিশরা এসে এটি দখল করে। সে কথা মনে হতে হতে কাঠের তৈরি সরু সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় এসে পড়লাম।

দেয়ালের একটি অংশে ফারসি ভাষায় কিছু লেখা। অন্য পাশের একটি ঘরে ছোটখাটো জাদুঘরের মতো ব্যবস্থা করে রাখা। দেয়ালজুড়ে টিপু সুলতানের জীবনকর্ম ও প্রাসাদের ইতিহাস রাখা। পড়তে পড়তে সময় কেটে গেল। বারান্দার একচিলতে জায়গায় দাঁড়িয়ে চোখে পড়ে আধুনিক দালানগুলো। এ প্রাসাদের পাশে বেমানান। তবে থেকে থেকে ভাবনায় বাদ সাধছিল দর্শনার্থীদের ভিড় আর হইচই। সবাই ছবি তোলা আর গল্পগুজবে ব্যস্ত। হঠাৎ মনে হলো, টিপু সুলতান কি কখনো কল্পনা করেছিলেন, একদিন এই প্রাসাদ সাধারণের কলকাকলিতে মুখর হবে? সঙ্গী পাশ থেকে টোকা দিয়ে জানান দিলেন, আবার রাস্তায় নামতে হবে। সময় বেশি নেই!
এরপর অটোচালক নিয়ে এলেন বেঙ্গালুরু দুর্গে। তিনি জানালেন, ১৫৩৭ সালের দিকে এটা তৈরি। একসময় টিপু সুলতান এটির সম্প্রসারণ করেন। মোগলদের পদচারণও এখানে ছিল।

পরে ব্রিটিশরা একপর্যায়ে এখানে আক্রমণ চালিয়ে কিছু অংশ নষ্ট করে ফেলে। বিশাল পাঁচিল দিয়ে ঘেরা জায়গায় ঢুকতেই কেমন জানি অস্বস্তি শুরু হলো। কৃত্রিম পুকুর, অস্ত্রাগার, মন্দির দেখতে দেখতে এক জায়গায় এসে দাঁড়িয়ে পড়লাম। সামনে সারি সারি কারাগার। ঠোঁট টেনে টেনে ভাবছিলাম, কত মানুষ এখানে একসময় আটকে ছিলেন, কে জানে! কয়েদখানাগুলোর গারদ ধরে ভেতরে তাকিয়ে দেখি ছোট ছোট ঘর। কোনোরকমে একজন আঁটে। পাথরের দেয়াল আর বোঁটকা একটা গন্ধ। গা কেমন শিরশির করে উঠতেই পাশে নজর দিলাম। পেল্লাই এই দরজাখানা দেখে বোঝার চেষ্টা করলাম, কতজন মিলে টানাটানি করে এটি লাগাতেন আর খুলতেন! নিজের কল্পনাকে বাস্তবসংগত করার চেষ্টায় কয়েকটা সিনেমার দৃশ্যও এর মধ্যে মনে করার জন্য মস্তিষ্কে ঘাঁটাঘাঁটি শুরু হলো। কিন্তু সফরসঙ্গী পট করে ভাবনায় বাগড়া দিয়ে বসলেন। এমন দরজার সঙ্গে স্মৃতি না রাখলে নাকি ঘোরাফেরা বৃথা। অগত্যা তাঁর কথা মেনে এই স্মৃতি ধরে রাখলাম।

সময় এদিকে শেষ হওয়ার পথে। রাতে দিল্লি উড়ে যাব। সেখান থেকে মানালি। অটোচালক আমাদের বিমানের বাসে তুলে দিলেন। মনটা ভালো লাগায় ভরে গেল, এমন একজন মানুষের কারণে কতগুলো সুন্দর স্মৃতি জমা হলো। দিল্লিতে নেমেই মানালির বাস ধরলাম। নভেম্বরের শীতে মানালির সৌন্দর্যের গল্প আরেক দিন না হয় বলা যাবে।
*লেখক: সহকারী অধ্যাপক, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়