কমলদহ ঝরনায় একটি দিন

কমলদহ ঝরনা
ছবি: সংগৃহীত

প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অপার লীলাভূমি বলা হয় বাংলাদেশকে। দেশের আনাচে–কানাচে ছড়িয়ে–ছিটিয়ে আছে অপার সৌন্দর্য। শুধু চোখ মেলে দেখতে হয় সৌন্দর্যের অপার এই লীলাভূমি। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর বাংলায় দেখা মেলে সুউচ্চ পাহাড়ের বুক চিরে বয়ে চলা জলস্রোত, বিশাল বঙ্গোপসাগর থেকে ছুটে আসা নীল জলরাশি। তাই তো কবি জীবনানন্দ দাশ তাঁর কবিতায় লিখেছেন, ‘বাংলার মুখ আমি দেখিয়াছি, তাই আমি পৃথিবীর রূপ খুঁজিতে যাই না আর।

বাংলাদেশের নয়নাভিরাম প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অন্যতম স্থান দখল করে আছে চট্টগ্রাম বিভাগ। পার্বত্য চট্টগ্রামসহ বৃহত্তর চট্টলার সৌন্দর্যে বিমোহিত হয়েছেন অনেকেই। চট্টগ্রাম অঞ্চলের সীতাকুণ্ডের পাহাড়ি ঝরনা আজ দর্শনার্থীদের টানছে। ভ্রমণপিপাসু মানুষ ছুটছেন। সীতাকুণ্ডের চন্দ্রনাথ পাহাড়, মহামায়া লেক, গুলিয়াখালী সমুদ্রসৈকত, কুমিরা ঘাট, বাঁশবাড়িয়া সমুদ্রসৈকত, ঝরঝরি ঝরনা ট্রেইল, কমলদহ ঝরনা ট্রেইল এবং সীতাকুণ্ড ইকোপার্ক দেখতে ভিড় জমায় হাজারো মানুষ। আমরা ঘুরে এলাম কমলদহ ঝরনায়।

কুবিসাসের সদস্যরা ঝরনায়
ছবি: সংগৃহীত

সকাল ছয়টা। সুয্যি মামা তখনো মেঘের গুমর ছেড়ে বের হতে পারেনি। কিন্তু কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের মূল ফটকে সাত/আটজনের বিচরণ। কাছে যেতেই দেখা গেল বিভিন্ন জাতীয় পত্রিকার কিছু সংবাদকর্মীকে। সবাই কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় সাংবাদিক সমিতির সদস্য। আজ তাঁদের গন্তব্য সীতাকুণ্ড কমলদহ ঝরনা ও বাশঁবাড়িয়া সমুদ্রসৈকত। যুক্ত হয়েছেন আরও বেশ কয়েকজন। সঙ্গে শীর্ষস্থানীয় দুই পত্রিকার দুই সাংবাদিক। সিএনজি, অটোরিকশা দিয়ে যাত্রা শুরু। ১৪ জনের বহর, অনায়াসে মিলে যাচ্ছে সব।

কুমিল্লা পদুয়ার বাজার বাসস্টপ থেকে বাস ছুটে যাচ্ছে ১১৬ কিলোমিটার দূরের সীতাকুণ্ডের উদ্দেশে। বাসে সেলফি, ফটোসেশন আর খুনসুটিতে মজলেন সবাই। প্রায় দেড় ঘণ্টার ভ্রমণ শেষে রূপসী ঝরনা নামক স্থানে গাড়ি থেকে নেমে হাঁটা শুরু মূল গন্তব্যের দিকে। কমলদহ ঝরনার পাশেই ছোট একটি দোকানে মেলে সকালের খাবার। যেখানে মিলেছে পরোটা, ডিম ভাজি আর শিঙাড়া। সে দোকানেই দুপুরের ভোজের অর্ডার হয়ে গেল। যার কারণে আমাদের ব্যাগ নিয়ে ভোগান্তিতে পড়তে হয়নি। প্রয়োজনীয় কাপড়চোপড় নিয়ে নিরাপদে ব্যাগ রাখার সুযোগ পেয়ে গেলাম। এবার যাত্রা ঝরনার পানে। এর মধ্যে নিয়মিত চলছে ফটোসেশন। ক্যামেরার দায়িত্বে কখনো জাহিদ ভাই, কখনো ফরহাদ। কমলদহ ঝরনায় ঢুকতে কাদার দুর্গম পথ দিয়ে শুরু।

বাশঁঝাড়িয়া সৈকত
ছবি: সংগৃহীত

যতই ঝরনার কাছাকাছি যাচ্ছি, মনে হচ্ছে দুর্গম পথ পাড়ি দিচ্ছি। মাঝেমধ্যে দেখা মিলছে ছোট–বড় ক্যাসকেড। ভয়ংকর রূপের ক্যাসকেডগুলোয় ছবি তুলছে দর্শনার্থীরা। ক্যাসকেডগুলো দিয়ে পাহাড়ি ঢাল বেয়ে নিচে নেমে যাচ্ছে জল। পাথর আর মাটির এই দীর্ঘ রাস্তা পাড়ি দিতে হবে পায়ে হেঁটে। হাঁটার সময় সাবধানতা অবলম্বন করা খুবই জরুরি। তা না হলে ভয়ংকর দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। বেশ কয়েকটি ক্যাসকেড পার হয়ে পৌঁছে যাই রূপসী ঝরনা নামক স্থানে। প্রায় ৩০ ফুট ওপরের পাহাড় থেকে নেমে স্রোতে গা ভাসিয়ে দিচ্ছে অনেকে। আবার অনেকে গা ভিজিয়ে নিতে অপেক্ষা করছে। এসব মুহূর্ত ফ্রেমবন্দী করছে সবাই। ঝরনার বয়ে চলা স্রোত স্থির হচ্ছে নিচেই। সেখানে দেখা মিলছে চিংড়ি মাছের। অনেকে সেখানে শখের বশে জেলের ভূমিকা পালন করছে। দুর্গম পাহাড় বেয়ে রূপসী ঝরনা থেকে এবারের গন্তব্য কমলদহের সবচেয়ে বড় ঝরনা ছাগলকান্দায়। গন্তব্যের বাঁকে বাঁকে ভয়ংকর রূপ।

বয়ে চলা ঝরনার মধ্যেই চোখে পড়ছে ছোট ছোট গর্ত। যেখানে সাবধানতা অবলম্বন ছাড়া চলা অসম্ভব বটে। ছাগলকান্দায় যেতে যেতে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের ঝরনায় ঘোরার স্মৃতিচারণা করছে সবাই। কয়েকটা ক্যাসকেড পার হয়ে ছাগলকান্দা ঝরনা। প্রায় ৪০-৫০ ফুট উচ্চতার পাহাড় থেকে নেমে আসা অপরূপ সৌন্দর্যের ঝরনা দেখে বিমোহিত হতে বাধ্য যে কেউ। এই স্বচ্ছ পানির ঝরনা টানবে যে কাউকে। অপরূপ সৌন্দর্যের ঝরনায় গা ভিজিয়ে নিচ্ছে সবাই। ফ্রেমে বন্দী করছে মুহূর্তগুলো। এখানে দমে যেতে নারাজ কুবিসাসের সদস্যরা। প্রায় ৫০ ফুট উচ্চতার পাহাড় বেয়ে ছাগলকান্দা ঝরনার ওপর রয়েছে আরও কয়েকটি ক্যাসকেড। প্রায় দুই ঘণ্টা শেষে আমরা পৌঁছে যাই কমলদহের শেষ প্রান্তে। এবার ফেরার পালা। দুপুর দেড়টায় ভয়ংকর এই ঝরনা বেয়ে নামতে শুরু করি আমরা। মাঝেমধ্যে সবাই মিলে ছবি তোলা চলছে। আর এই দুর্গম পথ পাড়ি দিয়েও ক্লান্ত নই আমরা। অবশেষে এক ঘণ্টা পর আমরা ফিরে আসি সকালের সেই হোটেলে। আমাদের পরের গন্তব্য বাশঁবাড়িয়া সৈকত। এর মধ্যে শেষ করতে হবে গোসল আর দুপুরের ভোজ। ক্লান্ত আর ক্ষুধার্ত সবাই মোরগ, ডিম, ডাল, ভর্তা দিয়ে পেট পুরে খেয়ে যাত্রা শুরু পরের গন্তব্যে। প্রায় ৩০ কিলোমিটার দূরের পথ পাড়ি দেওয়ার সঙ্গী এবার লেগুনা। ৪০ মিনিট পর আমরা পৌঁছে যাই মূল গন্তব্যে। গ্রামীণ পথ ধরে সেখানে যেতে হয়। এ এলাকায় নেই বিদ্যুৎ–সংযোগ। ফলে তীব্র পিপাসায়ও খেতে পারবেন না ঠান্ডা পানি। দোকানের পানিই ভরসা। গাড়ি থেকে পাশের একটি দোকানে ত্রিশ মিনিটের বিশ্রাম। তারপর শুরু সৈকত দর্শন। সারি সারি ঝাউগাছ আর শোঁ শোঁ বাতাসে যে কারও মন ভরে উঠবে এখানে। সমুদ্রসৈকতের অন্যতম মনোরম দৃশ্য হলো সূর্য অস্ত যাওয়ার মুহূর্ত।

দর্শনার্থীরা অপেক্ষায় থাকে সময়টার জন্য। আমরাও ব্যতিক্রম নই। কর্দমাক্ত বালুর পথ ধরে সমুদ্রের কাছাকাছি যাওয়ার চেষ্টা আমাদের। আমাদের ছবি তোলা আর খুনসুটিতে নেমে আসে সন্ধ্যা। আমাদের ছুটে চলা ধীরে ধীরে সমাপ্তির পথে। ফিরতে হবে এবার ক্যাম্পাসের আঙ্গিনায়। সারা দিন ঘোরাঘুরিতে ক্লান্ত সবাই। সবার জন্য এসি বাসের ব্যবস্থা হলে মন্দ হয় না। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে আসতে আসতে হয়তো সেটাই ভাবছিলেন আয়োজকেরা। অবশেষে তার দেখা। বাসে উঠে প্রথমে চলে সারা দিনের বিভিন্ন অভিজ্ঞতার কথা। এর মধ্যেই অনেকে নিদ্রায় নিমজ্জিত হয়েছেন। রাত ১২টায় ক্যাম্পাসের মূল ফটকে শেষ হয় সংবাদকর্মীদের কমলদহ ঝরনায় এক দিন।

লেখক: শিক্ষার্থী, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়