বুদ্ধ পূর্ণিমার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি

বৈশাখী পূর্ণিমায় চাঁদের পরিপূর্ণতায় স্নিগ্ধ রজনী সত্য, সুন্দর ও পবিত্রতার নিদর্শন বহন করে। মানুষের মনকে ভরিয়ে দেয় শুভ্রতায়। চেতনাকে জাগ্রত করে পরিপূর্ণতার অনুরাগে। আর বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের কাছে ‘বৈশাখী পূর্ণিমা’ আসে পবিত্রতায় সিক্ত হয়ে মহাকারুণিক তথাগত বুদ্ধের প্রেম, মৈত্রী, ভালোবাসার অমিয় বার্তা নিয়ে শান্তির বাতাবরণ সৃষ্টি করতে। তাই প্রত্যেক বৌদ্ধ নর-নারীর জন্য এ দিবসের ধর্মীয় মহিমা বিশেষভাবে মহিমান্বিত।

এ পূর্ণিমার তিথিতে চিত্ত বিকারে আপন চরিত্রের অপূর্ণতায় পীড়িত মানুষ উচ্চারণ করে—‘আমি বুদ্ধের শরণ কামনা করছি।’ তাই বৈশাখী বা বুদ্ধ পূর্ণিমা হলো চিত্ত শুদ্ধির দিন, অজ্ঞতার আবর্জনা বিসর্জন দিয়ে জ্ঞানের আলোতে কুশল চেতনায় স্নাত হওয়ার দিন।

বুদ্ধ পূর্ণিমা তিথিতে পবিত্র বুদ্ধগয়ায় ৪ জ্যৈষ্ঠ ১৩৪২ বাংলা বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মহামানব গৌতম বুদ্ধের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করতে গিয়ে মনের অভিপ্রায় প্রকাশ করেছেন এভাবে, ‘আমি যাঁকে অন্তরের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ মানব বলে উপলব্ধি করি, আজ এই বৈশাখী পূর্ণিমায় তাঁর জন্মোৎসবে প্রণাম নিবেদন করতে এসেছি। এ কোনো বিশেষ অনুষ্ঠানের উপকরণগত অলংকার নয়, একান্তে–নিভৃতে যা তাঁকে বারবার সমর্পণ করছি, সেই অর্ঘ্যই আজ এখানে উৎসর্গ করছি।’

খ্রিষ্টপূর্ব ৫৬৩ অব্দে সিদ্ধার্থ গৌতম বৈশাখী পূর্ণিমায় জন্মগ্রহণ করেন। ২৯ বছর বয়সে গৃহত্যাগ করে ৬ বছর তপস্যার পর ৩৫ বছর বয়সে বৈশাখী পূর্ণিমায় বুদ্ধত্ব লাভ করেন এবং ৪৫ বছর নবলব্দ ধর্ম-দর্শন প্রচার করে ৮০ বছর বয়সে খ্রিষ্টপূর্ব ৪৮৩ অব্দে বৈশাখী পূর্ণিমায় মহাপরিনির্বাণ লাভ করেন। (মতান্তরে তাঁর জন্ম খ্রিষ্টপূর্ব ৬২৪ অব্দে ও মহাপরিনির্বাণ লাভ খ্রিষ্টপূর্ব ৫৪৪ অব্দে)। একই তিথিতে জন্ম, বুদ্ধত্ব লাভ ও মহাপরিনির্বাণ লাভের ঘটনা পৃথিবীর ইতিহাসে কোনো সাধারণ মানুষের জীবনে তো ঘটেনি, কোনো মহাপুরুষের জীবনেও ঘটেনি।

তাই বৌদ্ধ ইতিহাসে এ দিবস বা তিথির গুরুত্ব বিশেষ তাৎপর্যমণ্ডিত। ত্রিস্মৃতিবিজড়িত এ দিবসকে শুভ বুদ্ধ পূর্ণিমা হিসেবে বৌদ্ধ প্রতিরূপ দেশসহ বিভিন্ন দেশে নানা আয়োজনে উদ্‌যাপন হয়ে আসছে।

পৃথিবীর ইতিহাসের বহু বিরল ঘটনাকে জাগ্রত করে রাখার জন্য পৃথিবীর বৃহত্তম প্রতিনিধিত্বশীল সংস্থা জাতিসংঘ কর্তৃক সারা বিশ্বে সেগুলো বিভিন্ন দিবস হিসেবে একযোগে উদ্‌যাপন বা পালন করা হয়। যেমন ২৪ জানুয়ারি আন্তর্জাতিক শিক্ষা দিবস, ২১ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস, ৮ মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবস, ৭ এপ্রিল বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবস, মে মাসের যে তারিখে পূর্ণিমা হবে, সেই তারিখ ‘বেশাক ডে’ দিবস, ৫ জুন বিশ্ব পরিবেশ দিবস, ১১ জুলাই বিশ্ব জনসংখ্যা দিবস, ১২ আগস্ট বিশ্ব যুব দিবস, ২১ সেপ্টেম্বর বিশ্ব শান্তি দিবস, ৫ অক্টোবর বিশ্ব শিক্ষক দিবস, ১৬ নভেম্বর বিশ্ব সহিষ্ণুতা দিবস, ১০ ডিসেম্বর বিশ্ব মানবাধিকার দিবসসহ জাতিসংঘ কর্তৃক আরও বহু স্বীকৃত স্মরণীয় ও বরণীয় দিন রয়েছে, যে দিবসগুলো আন্তর্জাতিকভাবে উদ্‌যাপিত হয়।
বিভিন্ন দেশে বুদ্ধ পূর্ণিমা ধর্মীয় মহিমায় উদ্‌যাপিত হয়ে এলেও এর ওপর কোনো দেশের রাষ্ট্রীয় বা সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা কিংবা স্বীকৃতি ছিল না।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ১৯৫৫ সালে সিঙ্গাপুর বুড্ডিস্ট অ্যাসোসিয়েশনের পক্ষ হতে সেই দেশের সরকারের কাছে বুদ্ধ পূর্ণিমার তাৎপর্য উল্লেখপূর্বক স্মারকলিপি প্রদানের মাধ্যমে ওই তারিখে সাধারণ ছুটি ঘোষণার জন্য সরকারের কাছে জোরালো দাবি উত্থাপন করা হয়। ওই দাবির যথার্থতা উপলব্ধি করে সরকার বুদ্ধ পূর্ণিমার দিন সরকারি ছুটি ঘোষণা করে। সেই থেকে পর্যায়ক্রমে থাইল্যান্ড, শ্রীলঙ্কা, মিয়ানমার, লাওস, কম্বোডিয়া, ভুটান, মঙ্গোলিয়া, বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দেশে বুদ্ধ পূর্ণিমা উপলক্ষে সাধারণ ছুটি ঘোষিত হয়।

বর্তমানে বৌদ্ধপ্রধান দেশ ছাড়াও পৃথিবীর বহু দেশে বৌদ্ধ পূর্ণিমা বা ‘বেশাক ডে’ সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে নানা আয়োজনে উদ্‌যাপিত হয়। একদিকে ধর্মীয় চেতনার উন্মেষ, অন্যদিকে কৃষ্টি, সংস্কৃতি, ঐতিহ্যের বিকাশ সাধনে এ দিবসের তাৎপর্য গভীরভাবে অন্তর্নিহিত। তাই পৃথিবীর বৌদ্ধ নর–নারী, বিশেষ করে বৌদ্ধ ভিক্ষু, সংস্থা, সংগঠনের নেতারা প্রতিবছর বেশাক ডের আন্তর্জাতিক সমাবেশ বা সম্মেলনে যোগদানের জন্য অধীর আগ্রহে থাকেন। ২০১৯ সালে বাংলাদেশের বিভিন্ন সংস্থা, সংগঠনের পক্ষ থেকে অনেক প্রতিনিধি ভিয়েতনামে গমন করেছেন ১২-১৪ মে অনুষ্ঠিত বেশাক ডে সম্মেলনে যোগ দিতে।

বাংলাদেশ বৌদ্ধ কৃষ্টি প্রচার সংঘের পক্ষ থেকে প্রতিবছর বেশাক ডে অনুষ্ঠানে প্রতিনিধি যোগদান করে থাকেন ও বিশেষ ভূমিকা রাখেন।

২০১৯ সালে সংঘনায়ক শুদ্ধানন্দ মহাথেরের নেতৃত্বে সংঘের সহসভাপতি যথাক্রমে মি রণজিৎ বড়ুয়া, মি সুজিত কুমার বড়ুয়া, মিসেস নন্দিতা বড়ুয়া, সদস্য হৃদয় শ্রমণ যোগ দেন। সংঘের মহাসচিব মি পি আর বড়ুয়ার যোগদানের কথা থাকলেও শারীরিক অসুস্থতার কারণে যোগদান করা সম্ভব হয়নি তাঁর।

সংঘনায়ক শুদ্ধানন্দ মহাথেরের নেতৃত্বে ২০১২ সালে থাইল্যান্ড ও ২০১৪ সালে ভিয়েতনামে অনুষ্ঠিত বেশাক ডে অনুষ্ঠানে আমার যোগদানের সুযোগ হয়। বিশ্বের নেতাদের মহামিলনমেলা হলো বেশাক ডে। বর্ণাঢ্য আয়োজন, সুনিপুণ পরিবেশনা, সুশৃঙ্খল ব্যবস্থাপনা, আধুনিক প্রযুক্তি সংযোজনের মাধ্যমে খুবই দৃষ্টিনন্দন ও আকর্ষণীয় হয় এ অনুষ্ঠান, যা চোখে না দেখলে বিশ্বাস হবে না।

অভিজ্ঞতা অর্জনের জন্য, নিজের যোগ্যতা প্রমাণের জন্য, নিজ দেশের কৃষ্টি, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য তুলে ধরার জন্য এ–জাতীয় অনুষ্ঠানে যোগদান করা খুবই জরুরি। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা ও সহযোগিতায় প্রতিনিধি যোগদানের ব্যবস্থা থাকলে এতে দেশের ভাবমূর্তি আরও উজ্জ্বল হবে।

এ জন্য বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্বশীল বৌদ্ধ সংগঠনের পক্ষ থেকে যৌথভাবে বাংলাদেশ সরকারের কাছে আবেদন করা যেতে পারে। এ জন্য বৌদ্ধ ধর্মীয় কল্যাণ ট্রাস্ট বিশেষ ভূমিকা রাখতে পারে।

ক্ষুদ্র পরিসরে এ লেখায় বিভিন্ন সালে অনুষ্ঠিত বেশাক ডে সম্মেলনের প্রস্তাব বা সিদ্ধান্তগুলো বিস্তৃত লেখা সম্ভব হয়নি। তাই পরবর্তীকালে লেখার প্রত্যাশা রইল। বেশাক ডে সম্মেলনের মাধ্যমে অনেকগুলো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় উঠে আসে। সেগুলো জাতিসংঘে পেশ করা হয় এবং বাস্তবায়নের জন্য সুপারিশ করা হয়।

বাংলাদেশের বৌদ্ধ সংগঠনের নেতারা সরকারের সহায়তায় বাংলাদেশে বেশাক ডে অনুষ্ঠান করার উদ্যোগ নিতে পারলে আরও ভালো হয়। এ জন্য বৌদ্ধ সংগঠনগুলোকে এগিয়ে আসতে হবে। জগতের সব প্রাণী সুখী হোক।

লেখক ধর্মরাজিক উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক, বাংলাদেশ বৌদ্ধ কৃষ্টি প্রচার সংঘের সাংগঠনিক সচিব, সরকার মনোনীত বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারী অবসর সুবিধা বোর্ডের সদস্য ও বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতি ঢাকা মহানগর দক্ষিণের সাধারণ সম্পাদক।