উচ্চ রক্তচাপের ভয়াবহতা মোকাবিলায় আমরা তৈরি তো?

কিছুদিন আগেও আমাদের দেশের মানুষের মধ্যে একটা ধারণা ছিল, অসংক্রামক রোগ যেমন উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস ও হৃদ্‌রোগ শুধু উন্নত দেশের মানুষের হয়। কিন্তু সে ধারণা পুরোপুরি ভুল প্রমাণিত হয়েছে। সারা পৃথিবীর মতো আমাদের দেশেও সংক্রামক রোগ দিন দিন কমছে এবং অসংক্রামক ব্যাধি বাড়ছে। ২০১৫ সালের গবেষণা অনুযায়ী, সারা পৃথিবীর ২২ শতাংশ প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের উচ্চ রক্তচাপ আছে।

দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে উচ্চ রক্তচাপের হার ২৭ থেকে ২৯.৬ শতাংশ। এসব দেশের মধ্যে নেপালে উচ্চ রক্তচাপের হার সবচেয়ে বেশি—৩৩.৮ শতাংশ। বাংলাদেশে ১৯৭৬ সালে উচ্চ রক্তচাপের হার ছিল মাত্র ১.১ শতাংশ, ১৯৯৯ সালে ১১.৩ শতাংশ, ২০১০ সালে ১৭.৯ শতাংশ ও ২০২০ সালের সর্বশেষ গবেষণা অনুযায়ী ২১ শতাংশ। রংপুর বিভাগের প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে ৩৩ শতাংশ উচ্চ রক্তচাপে ভুগছেন (২০১৩ সালের গবেষণা অনুযায়ী)।

উচ্চ রক্তচাপ কেন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়

দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে ৫৭ শতাংশ স্ট্রোক ও হার্টের অসুখে ২৪ শতাংশ মৃত্যুর কারণ উচ্চ রক্তচাপ। রংপুর হাইপারটেনশন অ্যান্ড রিসার্চ সেন্টারের এক গবেষণায় দেখা গেছে, উচ্চ রক্তচাপের রোগীদের ৭১ শতাংশের মৃত্যু হয় উচ্চ রক্তচাপের জটিলতায়। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি মৃত্যু হয় স্ট্রোকে—৩৩ শতাংশ, ২০ শতাংশ হার্ট অ্যাটাক ও ১৮ শতাংশ কিডনি নষ্ট হয়ে। রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের এক গবেষণায় দেখা যায়, উচ্চ রক্তচাপের রোগীদের মধ্যে ৭৫ শতাংশ স্ট্রোকে, ১০ শতাংশ কিডনি রোগে ও ৫ শতাংশ হার্ট অ্যাটাকে মারা যান।

উচ্চ রক্তচাপের সাধারণত কোনো লক্ষণ থাকে না, রোগীর শারীরিক কষ্ট থাকে না। তাই এ রোগে কেউ ভুগছেন কি না, সেটা তিনি নিজে বুঝতে পারেন না। যখন উচ্চ রক্তচাপের জটিলতা যেমন স্ট্রোক, হার্ট অ্যাটাক, কিডনি নষ্ট হওয়া—এসবের কোনো একটি হয়, তখন রোগীর বিভিন্ন শারীরিক সমস্যা দেখা দেয়। তাই এ রোগ নির্ণয় করাই অনেক বড় চ্যালেঞ্জ। কারণ, শারীরিক সমস্যা না থাকায় কেউ নিজের অর্থ ব্যয় করে প্রেশার কেমন আছে, উচ্চ রক্তচাপ আছে কি না, তা দেখার জন্য চিকিৎসকের শরণাপন্ন হন না।

আবার যদি কারও উচ্চ রক্তচাপ নির্ণয় করা হয়, তবে প্রায় অর্ধেক রোগী নিয়মিত চিকিৎসা গ্রহণ করেন না। উচ্চ রক্তচাপের রোগীদের এক থেকে তিন মাস পরপর কোনো সমস্যা না থাকলেও ফলোআপে আসতে হয়, দেখতে হয় যে প্রেশার নিয়ন্ত্রণে আছে কি না। এ ছাড়া রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে আসার পরও ওষুধ সারা জীবনের জন্য খেতে হয়। যে রোগের জন্য রোগীর কোনো শারীরিক সমস্যা থাকে না, সে রোগের জন্য রোগীরা নিজের অর্থ ব্যয় করে ফলোআপ বা ওষুধ চালিয়ে যেতে চান না। এটি বিশেষ করে আমাদের দেশের গরিব ও মধ্যবিত্ত রোগীদের জন্য একটি বড় সমস্যা।

উচ্চ রক্তচাপের চিকিৎসায় প্রধান জটিলতা—

১. উচ্চ রক্তচাপ রোগী শনাক্ত করা।
২. নিয়মিত ফলোআপ করা।
৩. রোগীর নিয়মিত ওষুধ গ্রহণ নিশ্চিত করা।

উচ্চ রক্তচাপ নির্ণয় করা

উচ্চ রক্তচাপের যেহেতু কোনো লক্ষণ থাকে না, তাই প্রত্যেক প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের নির্দিষ্ট সময় পরপর রক্তচাপ পরিমাপ করা উচিত। এটির একটা সহজ সমাধান হতে পারে, সারা দেশে জেনারেল ফিজিশিয়ান সেন্টার (জিপি সেন্টার) স্থাপন। আমাদের দেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থা উন্নত দেশের মতো সমুন্নত করে গড়ে তোলা হয়নি। উন্নত দেশগুলোতে প্রতিটি এলাকার মানুষের জন্য একটি জেনারেল ফিজিশিয়ান (জিপি সেন্টার) থাকে।

সেই সেন্টারে ওই এলাকার সব মানুষের চিকিৎসা হয়। কেউ চাইলেই ওই জিপি সেন্টারের বাইরে চিকিৎসা নিতে পারেন না। জিপি সেন্টারের চিকিৎসক যদি কোনো রোগীকে রেফার করেন, তবেই সেই রোগী বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক দেখাতে পারেন। প্রতি ২০ হাজার মানুষের জন্য যদি একটি করে জিপি সেন্টার গড়ে তোলা যায়, তাহলে ওই ২০ হাজার মানুষ তাদের সব ধরনের স্বাস্থ্যসেবা জিপি সেন্টার থেকে নেবেন। চিকিৎসাসেবা ছাড়াও ওই সব সেন্টারে স্বল্প মূল্যে হাইপারটেনশন, ডায়াবেটিস স্ক্রিনিং করা যাবে। ওই ২০ হাজার মানুষের হাতের কাছে ও নামমাত্র মূল্য হওয়ায় মানুষ সহজেই নিজের রক্তচাপ এখানে পরিমাপ করতে পারবেন। এ ছাড়া উচ্চ রক্তচাপ নির্ণয় হলে তাঁরা নিয়মিত চিকিৎসা ও ফলোআপ করতে পারবেন।

নিয়মিত ফলোআপ করা

উচ্চ রক্তচাপ একটি অনিরাময়যোগ্য রোগ। এ রোগ নিয়ন্ত্রণ করাই প্রধান লক্ষ্য। সে জন্য উচ্চ রক্তচাপ নির্ণয় হওয়ার পর থেকে এক থেকে তিন মাস পরপর ফলোআপ করা বাধ্যতামূলক। এ ফলোআপে সাধারণত খেয়াল করা হয়, রোগীর রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে আছে কি না, রোগী নিয়মিত ওষুধ খান কি না, নিয়মিত কায়িক শ্রম বা ব্যায়াম করেন কি না ইত্যাদি। এ ছাড়া কোনো রোগীর যদি ওষুধ খেয়ে রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে থাকে, তবে কিছুদিন পর সেই ওষুধে রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে না–ও থাকতে পারে। তাই উচ্চ রক্তচাপ চিকিৎসায় ফলোআপের কোনো বিকল্প নেই।

তবে এ ফলোআপের জন্য যদি রোগীকে ৫০ বা ১০০ কিলোমিটার দূরে যেতে হয়, একটি দিন ও অনেক অর্থ ব্যয় করতে হয়, তাহলে নিয়মিত ফলোআপ করা কঠিন হয়ে যাবে। আমার করা রংপুর হাইপারটেনশন অ্যান্ড রিসার্চ সেন্টারের এক গবেষণায় দেখা গেছে, ৬৮ শতাংশ রোগী ফলোআপে আসে না এবং যেসব রোগী ফলোআপে আসে না, তাদের মধ্যে প্রেশার নিয়ন্ত্রণে না থাকার সম্ভাবনা বেশি এবং পরবর্তীকালে উচ্চ রক্তচাপের জটিলতা হওয়ার আশঙ্কা বেশি।

উচ্চ রক্তচাপ সম্পর্কে একটি সূত্র আছে ‘রুল অব হাফ’। উচ্চ রক্তচাপের রোগীদের মধ্যে অর্ধেক জানেন না, তাঁদের উচ্চ রক্তচাপ আছে। যাঁরা জানেন, তাঁদের অর্ধেক ওষুধ খান না। আবার যারা ওষুধ খান, তাঁদের অর্ধেকের রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে থাকে। রংপুর বিভাগের এক গবেষণায় দেখা গেছে, মাত্র ৪৬ শতাংশ উচ্চ রক্তচাপের রোগী নিয়মিত ওষুধ খান। ২০২০ সালে দেশব্যাপী করা গবেষণায় দেখা গেছে, রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে আছে মাত্র ২৩.৫ শতাংশ রোগীর। উচ্চ রক্তচাপের চিকিৎসার মধ্যে নিয়মিত ওষুধ খাওয়া একটি বড় চ্যালেঞ্জ। অনেক রোগী আছেন, যাঁরা ওষুধ শুরু করতে চান না এই ভয়ে যে ওষুধ শুরু করলে সারা জীবন খেতে হবে।

আবার কিছু রোগী আছেন, যাঁরা মাঝেমধ্যে ওষুধ খান, বিশেষ করে যখন ঘাড়ব্যথা বা মাথাব্যথা হয়। ওষুধ না খাওয়া বা মাঝেমধ্যে খাওয়া দুটিই বিপজ্জনক। রোগীদের নিয়মিত ওষুধ খাবার জন্য চিকিৎসকদের ভালোভাবে কাউন্সেলিং করতে হবে এবং এই কাউন্সেলিংয়ে পরিবারের সদস্যদের অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। নিয়মিত ওষুধ খেলে কী উপকার হবে এবং না খেলে বা মাঝেমধ্যে খেলে কী ধরনের জটিলতা হবে, সেগুলো রোগী ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে শেয়ার করতে হবে।

উচ্চ রক্তচাপ মোকাবিলায় দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা

উচ্চ রক্তচাপ সহজেই শনাক্ত করার জন্য প্রতিটি ইউনিয়ন পরিষদ/মসজিদ/প্রতিটি স্কুলের একজন করে স্টাফকে প্রশিক্ষণ দিতে হবে। তাঁরা প্রতিটি স্কুলের ছাত্রছাত্রীর পরিবারের প্রাপ্তবয়স্ক সদস্যদের ছয় মাস পরপর অথবা বছরে অন্তত একবার রক্তচাপ পরিমাপ করবেন; যাঁদের রক্তচাপ বেশি পাবেন, তাঁদের চিকিৎসকের কাছে রেফার করবেন। এভাবে তথ্য সংগ্রহ করে সবার রক্তচাপের রেকর্ড স্বাস্থ্য বিভাগে পাঠাবেন। সারা দেশের সব তথ্য নিয়ে গবেষণা করা যাবে—আমাদের দেশের মানুষের গড় রক্তচাপ কেমন? উচ্চ রক্তচাপের রোগীর প্রকৃত সংখ্যা কত ইত্যাদি।

২.

উচ্চ রক্তচাপসহ অন্যান্য অসংক্রামক রোগগুলোকে ‘স্কুল হেলথ এডুকেশন’–এ অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। অসংক্রামক রোগ কী, কেন হয়, কত দিন চিকিৎসা করতে হবে, চিকিৎসা না করলে কী কী জটিলতা দেখা দেবে—এগুলো স্কুলের পাঠ্যবইয়ে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।

৩.

মানুষের হাতের নাগালে স্বাস্থ্যসেবা পাওয়ার জন্য জেনারেল ফিজিশিয়ান সেন্টার প্রতিষ্ঠা করতে হবে।

লেখক: ডা. রতীন্দ্র নাথ মণ্ডল, সহযোগী অধ্যাপক, মেডিসিন বিভাগ, প্রাইম মেডিকেল কলেজ ও প্রতিষ্ঠাতা ডাক্তারখানা