মাধবী কাল চ’লে যাবে...

ষাটের দশকের কবি রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ আধুনিক বাংলা কবিতার আকাশে ক্ষণজন্মা নক্ষত্রমণ্ডলীর মতো অন্যতম একজন কবি হিসেবে পরিচিত। মাত্র ৩৫ বছরের জীবনে অনেকটা নিঃসঙ্গ কাব্যময় তাঁর জীবন। তিনি যেমন একদিকে আধুনিক বাংলা কবিতাকে করেছেন আরও দীপ্তিময়, একাধারে তা পাঠকের হৃদয়ের মণিকোঠায় মর্মর জাগিয়ে আজন্ম স্থান দখল করে নিয়েছে অল্প সময়ের মধ্যেই।

জীবদ্দশার রুদ্র রচনা করেছেন ঈর্ষণীয়সংখ্যক কবিতা। অসংখ্য গান, গল্প, একটি কাব্যনাট্য ও চিত্রনাট্য।

বাতাসে লাশের গন্ধ-
নিয়ন আলোয় তবু নর্তকীর দেহে দোলে মাংসের তুফান।
মাটিতে রক্তের দাগ-
চালের গুদামে তবু জমা হয় অনাহারি মানুষের হাড়।

(বাতাসে লাশের গন্ধ)
আজন্মই অনেকটা বোহেমিয়ান স্বভাবের কবি রুদ্র মুহাম্মদ শহিদুল্লাহ, যাঁকে স্কুল-কলেজের নিয়মতান্ত্রিক প্রথা শুরুর দিকে কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করলেও পরবর্তী সময়ে আর বাঁধতে পারেনি কোনো কালেই। যিনি কিনা নিজেকে আপাদমস্তক উৎসর্গ করেছেন কবিতার কাছে, শহর জীবন, বন্ধু, আড্ডা পাখির শিস, সবুজ আকাশ, স্বাধীনতাসংগ্রাম-পরবর্তী উত্তাল কালপর্বে শুধু নয়, স্বৈরাচার ও সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে ছিল তাঁর বলিষ্ঠ উচ্চারণ। ভেঙে পড়া রাতের তাবৎ ক্লেদাক্ততায় সুপ্ত শিশিরবিন্দুর মতোই মোহ নিয়ে খুঁজেছেন কবিতার নিবিড় স্পর্শ। হয়তো রক্ত-মাংসের প্রেম না পেলেও প্রকৃতির রূপ-লাবণ্যে কবি পেয়েছেন বিদায়ের শেষ সন্ধিক্ষণে অস্ত যাওয়া সোনালি দিগন্তে চোখ ফেলে রাখা এক জোড়া সারসের ডানা ঝাঁপটে উড়ে যাওয়া আর্তনাদ।

সব কথা শেষ হলে ফিরে যাব,
একটি চোখ রেখে যাব শিথানের জানালায়।

সব কথা শেষ হলে করাঘাত জাগাবে তোমায়,
তমি এসে খুলবে দুয়ার-তুমি দ্যাখা হবে না!! (ইচ্ছের দরোজায়)
কবি রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহর কবিতায় অতি নিবিড়ভাবে ফুটে ওঠে তাঁর চারপাশের চলমান জীবন বা তার শাণিত রূপ, আবহমান গ্রাম-বাংলার সবুজ প্রকৃতির মাধুরী। অবাক জ্যোৎস্নায় কচি ধানের শিষের চিবুকে লেগে থাকা ফসলের নব্য দুধেল ঘ্রাণ—গাঙের ঘোলা জলে বেদনা , অন্তঃক্ষরণ যার সঙ্গে কবি অতিসূক্ষ্ম মেলবন্ধন ঘটাতে সক্ষম হয়েছেন তাঁর কবিতার পাঠকদের মধ্যে । তাঁর কলমের কালিতে বারবার বেজে ওঠে লাঙলের কঠিন ফলায় উগলে দেওয়া কঠিন মাটির যন্ত্রণায় মিশে থাকা বিষের ভায়োলিন; যার বিরহী সুর ডেকে আনে কেবলই হাহাকার, তবু এমন শস্যের বনে বুক পেতে দেন কবি অকপটে -
কোনো দিন শুনবে না কেউ।

জেনে যাব ঋণমুক্ত, আমাদের কাঙ্ক্ষিত পৃথিবী এল।
ভরা শস্যের প্রান্তরে যদি মৃত্যু হয় তবে আর দুঃখ কিসে!
জেনে যাব, শেষ হলো বেদনার দিন- ফসল ফলেছে মাঠে,
আমাদের রক্তে শ্রমে পুষ্ট হয়েছে এ শস্যের প্রতিটি সবুজকণা। (ফসলের কাফন)।

রূপসী বাংলার কবি জীবনানন্দ দাশের পর কবি রুদ্র মুহাম্মদ শহিদুল্লাহর কবিতায় বাংলার মধুর রূপ ও ধারা খুঁজে পাওয়া যায়। চাবুকে দাবড়ানো ফেলা আসা শৈশবকে ডিঙিয়ে কৈশোরকে বরাবরই তাঁর কবিতায় বয়ে নিয়ে গেছেন কবি। ব্যক্তিজীবনে অতিকাছের কিছু বন্ধু, মধ্যরাত অবধি আড্ডা দেওয়া, কাউকে কিছু না বলে হুটহাট উধাও হয়ে যাওয়া, সবার অগোচরে স্টেশন থেকে স্টেশনের সাইরেনে পুনশ্চ ফিরে আসা তার কোন কাব্য নিয়ে ক্রমাগত জীবনের নানান ঘাত- প্রতিঘাতে তুলে এনেছেন মুক্তিসংগ্রামের ইতিকথা, ব্যক্তি চিন্তাধারা, রাজনীতি, সমাজ বা অতিসূক্ষ্ম বিশেষণে কবি লিখেছেন,
উন্নয়নের রাজনীতি চর্চা করে উন্নয়ন করেছে যারা ক্যাশ,
ব্যক্তিগত চেকনাই, লাবণ্য শোভন মেদ স্বাস্থ্য সমাচার,
কোথায় তাহারা? জনতা জানতে চায় এর প্রকাশ্য বিচার।
মায়েদের চোখ ভেজা, এখনো বোনের মুখে কৃষ্ণপক্ষ রাত,
অনুজের রক্তের ভেতর পুড়ছে এখনো কোন এক লরি,
কোনো এক শুল্কহীন শ্রীমতী পাজেরো জিপ, দীপ্তিময় ক্রলিং !! (বিচারের কথা কেউ বলছেনা)।

কবি বারবার প্রেমে পড়েছেন, আঘাত পেয়েছেন, তবুও আবার প্রেমে পড়েছেন। রুদ্রের কবিতার শরীরজুড়ে থাকে বিস্তর এক বেদনা, কাতর প্রেম যার আঘাতে ক্ষতবিক্ষত হওয়া তাঁর শরীর বেয়ে ঝরে পড়া নোনা রক্তের স্রোতোধারা, যার কান্নার রোল তার অগণিত পাঠক হৃদয় আজও আপন আরশিতে বয়ে বেড়ায় নিয়তই। রুদ্রের কবিতা মানেই এক উন্মাদনা—অপেক্ষার প্রহর ফুরালেও থেকে যায় তার আকণ্ঠ; যে আকণ্ঠ কলিকুল প্রস্ফুটিত হওয়ার প্রাক্কালের, যে আকণ্ঠ এক বর্ষা বৃষ্টির জন্য, চৈত্রের পুড়ে যাওয়ার খরস্রোতা তৃষিত নদীর হয়তো যে আকণ্ঠ রেখেছেন তিনি তার চলে যাওয়ার বিদায়ক্ষণে-
মাধবী কাল চ’লে যাবে।

ওর হাতে ফুলগুলো তুলে দিয়ে বললাম
তুমিও কি ফুল হয়ে ঝরে যাবে?
ও নির্বাক উদাসীন।
ওর কাকের পাখার মতো কালো চোখ
মুহূর্তে জলে ভ’রে এল
মৃদু কাঁপলো পাপড়িগুলো !! (মাধবীর অবিশ্বাস্য স্মৃতি)
এভাবেই কবি জীবনকে খুঁড়ে গেছেন অতল থেকে অতলে, আর জীবনের পাওয়া না-পাওয়ার অন্তিম আচ্ছাদনের শেষ হিসেবে কবি লিখেছেন—
কোনো দিন এইসব মানুষেরা ফিরবে না আর...
যে রাখাল উদাস দুপুরে তার বাঁশির সুবাস ছড়াত বাতাসে
সে আর ফিরবে না ।
যে নারী সিঁথায় সিঁদুরের স্নিগ্ধ প্রেমে এঁকেছিল মুগ্ধ নীড়
সে আর ফিরবে না...(স্বজনের শুভ্র হাড়)।
আজ বাংলা সাহিত্যের ক্ষণজন্মা ক্লেদাক্ত কুসুমের কবি রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহর প্রয়াণ দিবস। কবির আত্মার প্রতি রইল সহস্র বিনম্র শ্রদ্ধা আর ভালোবাসা, ভালো থেকো কবি...
*লেখক: ইমতিয়াজ আহমেদ