টেকসই বেড়িবাঁধ চায় উপকূলের মানুষ

পাউবো বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে কোটি কোটি টাকা ব্যয়ে নতুন বেঁড়িবাঁধ নির্মাণ করেছে। তবে তীর সংরক্ষণ না করায় ইয়াসের মতো ঘূর্ণিঝড়ে নতুন সেই বাঁধে ভাঙন ধরেছে। এলাকাবাসীর দাবি তীরে পাথরের ব্লক না ফেললে বড় ঝড়ে এই বাঁধ টিকবে না। বানীশান্তা বাজার এলাকায়
ছবি: উত্তম মণ্ডল

দেশের অন্তত ৩৫ শতাংশ মানুষের বাস সমুদ্র–উপকূল অঞ্চলে। প্রতিবছর তাদের কেউ না কেউ হারাচ্ছে ঘর, হারাচ্ছে ফসলের জমি, হারাচ্ছে জীবন ও জীবিকা। সমুদ্রের লবণাক্ততায় তলিয়ে যাচ্ছে তাদের স্বপ্ন। এভাবেই সমুদ্র–উপকূল অঞ্চলের অন্তত দুই কোটি মানুষের জীবন আজ গভীরভাবে সংকটাপন্ন ও বিপন্নপ্রায়। সিডরের ক্ষত কাটিয়ে উঠতে না উঠতেই এল আইলা, আইলার ক্ষতচিহ্ন মুছতে না মুছতেই এল মহাসেন। তারপর আম্পান। বছর না গড়াতেই এবার ইয়াস। প্রকৃত বাস্তবতা হলো, একটি ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের আঘাতচিহ্নের ওপর আছড়ে পড়ছে আরেকটি আঘাতের চিহ্ন! এত দুর্যোগ কীভাবে সইবে এসব মানুষ! কীভাবে কাটবে তাদের জীবন! কীভাবে ঘুরে দাঁড়াবে তারা?

আকাশে ঘনকালো মেঘ, সাগরে লঘুচাপ কিংবা নিম্নচাপ, পূর্ণিমা কিংবা অমাবস্যায় এ অঞ্চলের মানুষের জীবনে নেমে আসে গভীর সংকট। আমরা জানি, বিশ্বে পরিবেশদূষণের কারণ অন্য কেউ, অন্য কোনো দেশ; কিন্তু ফলাফল ভোগ করতে হয় বাংলাদেশ ও বাংলাদেশের মানুষকে। সম্প্রতি ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস, আকস্মিক বন্যা, মৌসুমি বন্যা, নদীভাঙন, লবণাক্ততা, খরা ও অকালবৃষ্টি বাংলাদেশের নিয়মিত প্রাকৃতিক দুর্যোগে পরিণত হয়েছে। জার্মানভিত্তিক গবেষণা সংস্থা জার্মানওয়াচের বৈশ্বিক জয়বায়ু ঝুঁকি সূচক ২০১৯-এ বাংলাদেশকে সপ্তম ঝুঁকিপূর্ণ দেশ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। আমরা জানি, বাংলাদেশের ৬০ শতাংশ ভূমির উচ্চতা সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে মাত্র ৫ মিটার। গবেষণা বলছে, বাংলাদেশের সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা আগামী ৬০ বছরে আরও প্রায় ১ দশমিক ৫ ফুট বৃদ্ধি পাবে, যা আমাদের উপকূলীয় অঞ্চল, তথা সমগ্র বাংলাদেশকে অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলবে।

গত ২৬ মে ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের প্রভাবে উপকূলীয় ১৯ জেলার ৯টি ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। মৃত্যুবরণ করেছে অন্তত সাতজন। সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত জেলাগুলো হলো বরগুনা, পটুয়াখালী, ভোলা, বরিশাল, পিরোজপুর, ঝালকাঠি, বাগেরহাট, খুলনা ও সাতক্ষীরা। ইয়াসের প্রভাবে চার কিলোমিটার বেড়িবাঁধ সম্পূর্ণ নষ্ট হয়ে গেছে।

আংশিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে আরও অন্তত ৯১ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ। বেড়িবাঁধ ভেঙে অথবা বাঁধ উপচে লোনাজলে প্লাবিত হয়েছে অন্তত ৬৮২টি গ্রাম ও ৫০টিরও বেশি চরাঞ্চল। ঘরবন্দী হয়ে পড়েছে কয়েক লাখ মানুষ।

চট্টগ্রামের আনোয়ারায় বিভিন্ন জায়গায় বেড়িবাঁধে ভাঙন শুরু হয়েছে। উপজেলার ফকিরহাট এলাকায়
ছবি: প্রথম আলো

২০২০ সালের ২০ মে আম্পানে খোলপেটুয়া নদীর বাঁধ ভেঙে সাতক্ষীরার আশাশুনি উপজেলার শ্রীউলা ইউনিয়নের প্রায় সব কটি গ্রাম তলিয়ে যায়। সম্প্রতি দীর্ঘ ১০ মাসের প্রচেষ্টায় সেনাবাহিনী বাঁধ নির্মাণ করেছে। এ দীর্ঘ সময়ে এ অঞ্চলের মানুষ ঘরবাড়ি ছেড়ে পাড়ি জমিয়েছে অন্যত্র। প্রতাপনগর ইউনিয়নের রাশেদার গল্পটা খুব করুণ। স্বামী নেই। সন্তানেরাও যে যার মতো ছেড়ে গেছে। নদীতে রেণুপোনা ধরে চলে তাঁর সংসার। আম্পানে রাশেদার সব ভেসে গিয়েছিল। গত দুই মাস হলো তিনি নিজের ভিটেতে ফিরেছেন। ভাঙা ঘর সোজা করেছেন। এবার আঘাত করেছে ইয়াস। কথায় কথায় রাশেদার কাছে জানা গেল, নিম্নচাপ ছাড়াও এখন এই অঞ্চলে অমাবস্যায় ও পূর্ণিমায় নদীর জল উপচে লোকালয়ে প্রবেশ করছে। তাঁর ধারণা, বড় কোনো ঘূর্ণিঝড় হলে এই পুরো এলাকা সাগরে বিলীন হয়ে যেতে পারে।

আমাদের বেড়িবাঁধগুলো ষাটের দশকে নির্মিত। তৎকালীন জনজীবনের নিরাপত্তা ও কৃষি সুরক্ষার জন্য উপকূলীয় অঞ্চলে নির্মিত হয়েছিল এসব বেড়িবাঁধ। দৈর্ঘ্যে এই বাঁধ ৫ হাজার ৭৫৭ কিলোমিটার, যার একটি মোটা অংশ আজ দুর্বল ও ভঙ্গুরপ্রায়। কার্যত, এই দীর্ঘ সময়ে ওই সব বেড়িবাঁধের কোনো উন্নয়ন হয়নি, তবে কখনো কখনো প্রচুর অর্থ অপচয় হয়েছে। অন্যদিকে, নদীতে জমেছে প্রচুর পলি। বাঁধ ক্ষয়ে গেছে, বেড়েছে পানির উচ্চতাও। এ কারণে ওই পুরোনো বাঁধ দিয়ে এখন অতিরিক্ত জলোচ্ছ্বাস আটকানো অত্যন্ত কঠিন হয়ে পড়েছে।

সার্ক আবহাওয়া গবেষণাকেন্দ্র এক সমীক্ষায় বলছে, ২০৭০ সাল নাগাদ দেশে গড় তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাবে ২ দশমিক ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস। অন্য আরেকটি গবেষণা বলছে, ২০৫০ সালের মধ্যে আমাদের ১৭ শতাংশ ভূমি হারিয়ে যাবে এবং এ সময়ে আমরা ৩০ শতাংশ খাদ্য উৎপাদন সক্ষমতা হারাব। ২০৫০ সালের মধ্যে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পাবে। শুধু এই একটি কারণে দারিদ্র্য মানুষের সংখ্যা বাড়বে প্রায় ২ দশমিক ৫ কোটি। আরও দুঃখজনক খবর হলো, প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে ২০০৪ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের ৪৭ লাখ মানুষ গৃহহীন হয়েছে।

মধুমতী নদীর ভাঙন রক্ষা বাঁধের একটি অংশ ধসে পড়েছে। বাঁধ ধসের জন্য অপরিকল্পিত বালু উত্তোলনকে দায়ী করছেন স্থানীয় লোকজন। সম্প্রতি মাগুরার মহম্মদপুরের ঝামা বাজার এলাকায়
ছবি: প্রথম আলো

পরিসংখ্যান বলছে, বিগত ৩০ বছরে বাংলাদেশে ২৩৪টি বিভিন্ন ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগ আঘাত হেনেছে। এতে অন্তত দুই লাখ মানুষ প্রাণ হারিয়েছে। এই সময়ে পানিতে লবণাক্ততার পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়েছে প্রায় ২৬ শতাংশ। অন্যদিকে, উপকূলীয় অঞ্চলে প্রতিবছর ৫ শতাংশ লবণাক্ততা বৃদ্ধি পাচ্ছে, যা ক্রমাগত দেশের মধ্যাঞ্চলের দিকে প্রবেশ করছে। ইতিমধ্যে দেশের প্রায় ২৪০ কিলোমিটার অভ্যন্তরে প্রবেশ করছে লবণাক্ততা। অন্যদিকে, প্রত্যক্ষ হিসাবেও প্রাকৃতিক দুর্যোগে অর্থনৈতিক ক্ষতির পরিমাণ বর্ণনাতীত। শুধু সিডরেই ক্ষতি হয়েছে জিডিপির অন্তত ৩ শতাংশ, যা আজও পূরণ করা সম্ভব হয়নি।

সম্প্রতি ইয়াসের কিছু ছবি আমাদের চোখ ভিজিয়ে দিয়েছে। বিবেকের দরজায় প্রচণ্ড আঘাত করেছে। অসংখ্য স্থানে বুক দিয়ে বাঁধ বাঁচানোর চেষ্টা করেছে সাধারণ মানুষ। পিঠ দিয়ে উত্তাল ঢেউ থামানোর চেষ্টা করেছে তারা। কোথাও কোথাও মানুষের প্রচেষ্টা সফল হয়েছে। এ যাত্রায় কোনো কোনো এলাকায় হয়তো বেঁচে গেছে বেড়িবাঁধ। তলিয়েও গেছে বিস্তীর্ণ এলাকা। এসব বাঁধ অধিকাংশ সময়ই স্বেচ্ছাশ্রমে মেরামত করা হয়। এভাবে আর কত দিন! এই ভাঙা-গড়ার খেলা আর কত দিন দেখতে হবে উপকূলীয় অঞ্চলের মানুষকে? টেকসই বেড়িবাঁধ নির্মাণে সরকারের আন্তরিকতার প্রচণ্ড অভাব আজ তাদের এ অনিশ্চিত জীবনের দিকে ঠেলে দিয়েছে। বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের তথ্য বলছে, বাংলাদেশের মোট ১৬ হাজার ২৬১ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ আছে। এর মধ্যে উপকূলীয় অঞ্চলের সাড়ে পাঁচ হাজার কিলোমিটার বেড়িবাঁধের অবস্থা অত্যন্ত ভঙ্গুর, নাজুক। জন্মগতভাবে এ অঞ্চলের মানুষ বন্যা মোকাবিলা করতে করতে আজ ক্লান্ত। তারা এখন আর ত্রাণ চায় না, চায় পরিত্রাণ, চায় স্থায়ী ও টেকসই বেড়িবাঁধ। তারা আর বুক দিয়ে বাঁধ বাঁচাতে চায় না, চায় সরকার তাদের বেড়িবাঁধ বেঁধে দিক। বাঁধগুলো স্থায়ীভাবে রক্ষণাবেক্ষণ করুক। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি পাওয়ায় উপকূলীয় বেড়িবাঁধগুলো ১৫ থেকে ২০ ফুট উঁচু করা এখন সময়ের দাবি হয়ে উঠেছে।

প্রাক্কলন বলছে, দেশের উপকূলীয় অঞ্চলের বাঁধ নির্মাণের জন্য ৫০ থেকে ৭০ হাজার কোটি টাকা প্রয়োজন। এ অর্থ যদি আগামী পাঁচ বছর একটি প্রকল্পের আওতায় ব্যয় করা হয়, তাহলে হয়তো ১০ থেকে ১৫ হাজার কোটি টাকা বার্ষিক বরাদ্দ দিয়ে সেটা করা সম্ভব হবে। ফলে, আমরা খুব করে চাই, আসন্ন বাজেটে উপকূলীয় অঞ্চলের মানুষের জন্য বিশেষ বরাদ্দ রাখা হোক। এই অঞ্চলের মানুষের জীবন স্থায়ীভাবে বিনষ্ট হওয়ার আগে বেড়িবাঁধগুলো বিনির্মাণ করা হোক।

পদ্মার ভাঙন দেখা দিয়েছে রাজবাড়ীর দৌলতদিয়া ফেরিঘাট এলাকায়। শুক্রবার থেকেই ভাঙন এলাকায় জরুরি ভিত্তিতে বালুভর্তি জিও ব্যাগ ফেলা শুরু করে বিআইডব্লিউটিএ। দৌলতদিয়া, ৫ জুন
ছবি: এম রাশেদুল হক

সাগরের উত্তাল ঢেউ পিঠ দিয়ে বেশিক্ষণ ঠেকানো অসম্ভব। ৫ থেকে ১০ ফুট জলোচ্ছ্বাস বুক দিয়ে ঠেকানো একেবারে অসম্ভব। ফলে, আজই সরকারকে টেকসই বাঁধের কথা ভাবতে হবে। দেশের ৩৫ শতাংশ ঝুঁকিপূর্ণ মানুষের কথা ভাবতে হবে। দেশের অন্তত দুই কোটি অতি ঝুঁকিপূর্ণ মানুষের কথা ভাবতে হবে। আমরা বিশ্বাস করি, প্রতিটি ঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে দক্ষিণাঞ্চলের জান ও মালের যে বিপুল ক্ষতি হয়, তার অতিক্ষুদ্রাংশ দিয়ে এই অঞ্চলে টেকসই বেড়িবাঁধ নির্মাণ করা সম্ভব।

*লেখক: উমর ফারুক, শিক্ষক, অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড ইনফরমেশন সিস্টেমস বিভাগ, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুর