সড়ক যেন মৃত্যুর নয়, নিরাপদে পদক্ষেপ জরুরি

নিরাপদ সড়কের দাবিতে ছাত্রছাত্রীদের আন্দোলন
ফাইল ছবি

সড়ক মানে মৃত্যুর মিছিল, এই মৃত্যুর মিছিল নিয়ে জাতি খুবই উদ্বিগ্ন। সড়ক দুর্ঘটনা এখন নিত্যনৈমিত্তিক বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রতিবছর ঈদ, পূজাসহ অন্যান্য সামাজিক উৎসব এলে সড়কে প্রাণহানির সংখ্যা বেড়ে যায়। সড়ক দুর্ঘটনা আমাদের জীবনে এক আতঙ্ক। নিরাপদ সড়ক আমরা সবাই চাইছি, কিন্তু পরিবহনের সঙ্গে যাঁরা জড়িত, তাঁরা চাইছেন কি না সন্দেহ আছে। যদি চাইতেন, তাহলে প্রতিদিন এত সড়ক দুর্ঘটনা হতো না। ঘর থেকে গাড়িতে যাওয়ার উদ্দেশে বের হলে মনে হয় যে আর বাড়ি ফিরব কি না সন্দেহ থাকে। প্রতিবছর ২২ অক্টোবর জাতীয় নিরাপদ সড়ক দিবস পালন করে থাকি। কিন্তু সরকারের এ দিবস অনুমোদনের পেছনে যে কারণ ছিল, অধিকাংশে তার প্রতিফলন দেখতে পাওয়া যায় না। কারণ, সড়ক দুর্ঘটনায় প্রতিবছর হাজারো লোক নিহত হচ্ছে। সড়ক দুর্ঘটনার খবর প্রতিদিন আমাদের আহত, ক্ষতবিক্ষত করে চলছে।

সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণহানি শুধু একটি পরিবারে গভীর শোক ও ক্ষত সৃষ্টি করে না, আর্থিকভাবেও পঙ্গু করে ফেলে ওই পরিবারকে। কোনো কোনো দুর্ঘটনায় পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তির মৃত্যু পরিবারকে পথে বসিয়ে ফেলে, যার ক্ষতি কোনোভাবেই পুষিয়ে নেওয়া যায় না। এ কারণে ওই পরিবারের যে কী করুণ পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়, তা বলে শেষ করা যাবে না। আর যারা পঙ্গু হয়ে যায়, তাদের পরিবারকে আজীবন এর বোঝা বহন করে চলতে হয়। গণমাধ্যমে জানতে পারি, সড়ক দুর্ঘটনার কারণে বছরে বাংলাদেশের জিডিপির গড়ে শতকরা দেড় ভাগ ক্ষতিগ্রস্ত হয়, যা পাঁচ হাজার কোটি টাকার সমান। গত ১৫ বছরে সড়ক দুর্ঘটনায় আমরা হারিয়েছি ৫৫ হাজার মানুষ। আর দুর্ঘটনার কারণে মামলার সংখ্যা ৭৫ হাজারের বেশি। কিন্তু বিচার তেমন বেশি কার্যকর হয়নি।

সড়ক দুর্ঘটনার ৫৩ শতাংশ ঘটে অতিরিক্ত গতিতে গাড়ি চালানোর কারণে। আর ৩৭ শতাংশ চালকদের বেপরোয়া মনোভাবের কারণে দুর্ঘটনা ঘটে। অর্থাৎ ৯০ শতাংশ দুর্ঘটনা ঘটে চালকের বেপরোয়া মনোভাব ও গতির কারণে। আর ১০ শতাংশ সড়ক দুর্ঘটনা জন্য প্রতিযোগিতার মনোভাব ও পদযাত্রীর অসাবধানতা দায়ী। জাতীয় মহাসড়কগুলোয় সড়ক দুর্ঘটনার প্রায় ৫০ শতাংশই ঘটে থাকে। সড়কে ফিটনেসবিহীন অনেক গাড়ি চলমান, যা সড়ক দুর্ঘটনার জন্য অনেকাংশে দায়ী। সড়ক দুর্ঘটনার অন্য কারণগুলোর মধ্যে আরও রয়েছে ট্রাফিকবিধি লঙ্ঘন করে অতিরিক্ত বোঝাই ও চালকদের ওভারটেকিং, বিরতিবিহীন লম্বা সময় ধরে গাড়ি চালানো, ছোট গাড়ির চালক বিশেষ করে মোটরসাইকেলচালকদের মধ্যে সতর্কতার অভাব, দূরপাল্লার সড়ক ও জনবহুল এলাকায় ট্রাফিক আইন লঙ্ঘন এবং দেশের বিভিন্ন জায়গায় সড়কের বেহাল অবস্থা।

এ ছাড়া চালকের লাইসেন্স পাওয়ার প্রক্রিয়ায় দুর্বলতা এবং তাঁদের প্রাতিষ্ঠানিক প্রশিক্ষণের অভাবে সড়ক দুর্ঘটনা হয়ে থাকে। নতুন সড়ক পরিবহন আইনের সুযোগ নিচ্ছে পরিবহনমালিক, শ্রমিক ও চালকেরা। চালকেরা বেপরোয়া গতিতে গাড়ি চালাতে ভয় পান না। এর বলি হচ্ছে মানুষ এবং ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে দেশের অর্থনীতি। লাইসেন্সবিহীন চালকের সংখ্যা কম নয়, এটাও একটি কারণ সড়ক দুর্ঘটনার। দুর্ঘটনা কমানোর জন্য পরিবহনের সঙ্গে যাঁরা জড়িত, তাঁদের কোনো কার্যকর পদক্ষেপ দেখছি না। বিশেষ করে, নিরাপদ সড়ক নিশ্চিত করার জন্য দৃশ্যমান কোনো তৎপরতা নেই। পুলিশ মাঝেমধ্যে গাড়ি থামিয়ে শুধু মাদক আছে কি না, তা চেক করে থাকে। কিন্তু সড়কে বেপরোয়া গতি নিয়ন্ত্রণ ও শৃঙ্খলা আনার চেষ্টা করা হচ্ছে না। এ করণে সড়ক দুর্ঘটনা ও প্রাণহানি দুটিই বেড়ে চলছে।

সড়ক দুর্ঘটনা বন্ধে দেশের সব বাস টার্মিনালসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থানে সড়ক নিরাপত্তাসংক্রান্ত ভিডিওচিত্র প্রদর্শন করা উচিত। এর পাশাপাশি পরিবহনমালিক, চালক, যাত্রী ও পথচারীদের সচেতন করার লক্ষ্যে লিফলেট, পোস্টার ও স্টিকার বিতরণ করতে হবে। সড়ক যেন মৃত্যুর নয়, বরং নিরাপদে পদক্ষেপ জরুরি। সড়কে নিরাপত্তার স্বার্থে নতুন এবং যুগোপযোগী আইন প্রণয়ন করতে হবে, যাতে গাড়ি চালকেরা বেপরোয়া গতিতে গাড়ি চালাতে ভয় পায়। পরিবহনের সঙ্গে জড়িত সবার জন্য প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে, যাতে মানুষের জীবনের মূল্য, পেশাগত দায়িত্ব সম্পর্কে ধারণা লাভ করতে পারে। এ ছাড়া দালাল বা তদবিরের মাধ্যমে ড্রাইভিংয়ের ভুয়া লাইসেন্স দেওয়া বন্ধ করতে হবে।

দুর্ঘটনা ঘটলে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে দ্রুত তদন্তের প্রতিবেদন প্রকাশ করে দোষী ব্যক্তিদের শাস্তি বাস্তবায়ন করতে হবে। সমাজের যে শ্রেণির মানুষই দুর্ঘটনার শিকার হোক না কেন, প্রত্যেক মানুষ আমাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু কোনো একটি দুর্ঘটনার দৃষ্টান্তমূলক বিচার হয়েছে কি না, আমার জানা নেই। আর বিচারহীনতার সংস্কৃতি, আইনের দুর্বলতা কারণে সড়কে মৃত্যুর মিছিল কমছে না; বরং সড়ক দুর্ঘটনা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এই শোচনীয় অবস্থা থেকে দেশবাসীকে রক্ষা করার জন্য সরকার আইনের সংশোধনপূর্বক তা প্রয়োগের মাধ্যমে সড়কে নিরাপদ ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনতে পারে। এ ছাড়া পুলিশের আইনের বিষয়ে আরও বেশি তৎপর হতে হবে। নাগরিক হিসেবে আমাদেরও দায়িত্ব রয়েছে। সড়ক দুর্ঘটনার জন্য শুধু চালকরাই যে দায়ী তা নয়, রাস্তার পাশের দোকান ও স্কুল প্রতিষ্ঠা, অনেক সময় যাত্রী, পথচারী, শিশুদের দৌড়ে রাস্তা পার হওয়াও দায়ী। আইন কার্যকর করার ক্ষেত্রে সরকার আরও কঠোর হবে বলে বিশ্বাস করি।

* সাবেক সভাপতি, শিক্ষক সমিতি, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়, ত্রিশাল, ময়মনসিংহ। [email protected]