শ্রমজীবী এক মানবী হাজেরা বেগম

ছবি: লেখক

ক্লান্ত শরীরে তপ্ত দুপুরে বেচাবিক্রির মধ্যেই পদচারী-সেতুর নিচে ঘুমিয়ে পড়েছেন হাজেরা বেগম। ঘুমন্ত মানুষটাকে ডাকতে খুব খারাপ লাগছিল বলে সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। আমার পায়ের আলতো আওয়াজেই ঘুম ভেঙে গেল পরিশ্রান্ত হাজেরা বেগমের। ১ মে বিশ্ব শ্রমিক দিবস। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ছেয়ে গেছে মেহনতি মানুষকে নিয়ে করা বন্ধুদের নানান স্ট্যাটাসে। আমি লকডাউনের যথাযথ রীতি মেনেই বের হলাম। অনেক দিন ধরেই ভাবছিলাম, হাজেরা খালার সঙ্গে একটু কথা বলব। বলেই এসেছিলাম খালা, একদিন আমাকে একটু সময় দিয়েন।

হাজেরা বেগম উঠে বসলেন। অনুমতি চেয়ে নিলাম তাঁকে নিয়ে লেখা কোনো কাগজে ছাপা হলে তাঁর  আপত্তি আছে কি না? বললেন, না, কোনো সমস্যা নেই তাঁর। আমরা কথা শুরু করলাম। ঠিক কথা বা গল্প নয়, একজন মানুষ সম্পর্কে রীতিমতো জানতে চাওয়া।

শুরুতেই জানতে চাইলাম
কটা ডাব বিক্রি করলেন আজ?
কাল ১৬০ টাকা বেচছিলাম। আজ এ পর্যন্ত একটাও বেচতে পারি নাই।
কত করে বিক্রি করেন এক একটা ডাব?
ছোট গুলান ৭০/৮০, আর বড়গুলা ৯০ টাকা।
ডাব কোথা থেকে আনেন?
কাউরান (কারওয়ান) বাজার থ্যা।
কত টাকা করে কেনেন পাইকারি?
খালা, আনি তো ধরেন ৬৫ টাকা করে।
আর বড়গুলো?
গড়পড়তা সব ৬৫ কইরাই আনি। পাঁচ টাকা কইরা লাভ না রাখলে চলে না খালা।
লাভ কেমন থাকে দিন শেষে?
বেচাকেনা অইলে বালোই থাকে, তাও ৩০০/৪০০। কোনো কোনো দিন ৫০০ টাকাও অয়।

আপনার স্বামী কোথায়?
মইরা গেছে।
কত দিন হলো মারা গেছেন উনি ?
প্রায় ১২ বছর ।
ছেলেমেয়ে আছে?
আছে এক পোলা। কিলাস এইটে পড়ে।
আপনাকে কাজে সাহায্য করে ছেলে?
হ্যাঁ করে। এসব আনে নেয় আবার বসে আমার সাথে। আমি তো একা পারি না। বয়স অইচে না।
কী হয়েছিল আপনার স্বামীর?
হাজেরা বেগম কথা বলেন না। চুপ করে থেকে বলেন, জানি না।
কী হয়েছিল স্বামীর আপনি জানেন না? সন্দেহ দানা বাঁধে। তাই আবারও জিজ্ঞেস করি, খালা নাকে ফুল নেই কেন আপনার?
স্বামী আছে তয় আমার লগে থাহে না।
বিয়ে করেছে আরেকটা?
হ্যাঁ। পোলাডার বয়স যহন চার বছর, তহন আমারে রাইখা চইলা গেছে।
খালা আপনি এত সুন্দর দেখতে। অল্প বয়সে নিশ্চয়ই আরও সুন্দরী ছিলেন। এই আপনাকেও ছেড়ে চলে যাওয়া যায়! কিছু বলেননি?

না গো খালা কী বলুম। যে আসল নারী সে কখনো স্বামীরে খারাপ কয় না। আর যে আসল নারী না সেই স্বামীর নামে বদনাম করে। আমারে তার ভালো লাগে নাই তাই ছাইরা গেছে। আমি কেমনে জোর করে ধইরে রাখুম কন।

রাস্তায় বসে ডাব বিক্রি করা একজন অক্ষরজ্ঞানহীন হাজেরা বেগমও জানেন ভালোবাসা ফুরিয়ে গেলে, মায়া-মমতা কমে এলে কাউকে আর জোর করে ধরে রাখা যায় না। আসলে ভালোবাসা বড় দায়, বড় ঝুঁকি। এ ভার সবাই বইতে পারে না।
সেই অভিমান থেকেই হাজেরা বেগম সবাইকে বলেন, তাঁর স্বামী মৃত এবং বাঙালি নারীরা জীবিত স্বামীর চিহ্নস্বরূপ নিজের শরীরে বয়ে বেড়ান একটা নোলক বা নাকফুল। কিন্তু বুকের ভেতর এতটাই অভিমান জমে পাহাড় হয়েছে হাজেরা বেগমের যে স্বেচ্ছায় খুলে ফেলেছেন সেই নাকফুল। হায়রে বোকা নারী, এতে কী আসে-যায় চলে যাওয়া মানুষটার? হয়তো সে দিব্যি আছে। প্রতিশ্রুতি আজকাল বাজারের সবচেয়ে সস্তা পণ্য।

ছবি: লেখক

প্রসঙ্গ পাল্টিয়ে জানতে চাইলাম,
ছেলেকে লেখাপড়া শেখাতে চান?
হ্যাঁ। আমার ছেলে কয়, মা আমি লেখাপড়া করুম। তারপর বড় হয়ে চাকরি করে তোমারে আর কাজ করতে দিব না। তোমারে তহন বসায়ে বসায়ে খাওয়াব। আমার ছেলেডা খুব ভালো গো খালা। দেখতেও মাশা আল্লাহ অনেক সুন্দর।
হাজেরা বেগম যখন ছেলের অভয়ের কথা বলছিলেন, তখন আনন্দে তাঁর চোখের কোনে চিকচিক করছিল। মানুষ তো আশা নিয়েই বাঁচে। স্বপ্ন দেখে ভালোভাবে বেঁচে বর্তে থাকার।
শুধু ডাব বেচে সংসার চলে?
বিকেলে পিঠা বানাই। এখানে আমি ২৭ বছর ধইরা থাহি। এহন তো রোজা, তাই পিঠার ব্যবসা বন্ধ। খুব ইচ্ছা করছিল কাউরান বাজার থেইকা তালশাঁস কিনা আনি। কিন্তু খালা তালশাঁস কাটার দা তো আমার নাই। যে দা আছে, এইডা দিয়া ডাবই ভালো কইরা কাটা যায় না। একটা দা অইলে খুব ভালো অইতো।
মাথার ওপর এই যে রঙিন ছাতা, নিজে কিনেছেন?
হ্যাঁ, খুব তাপ লাগে, তাই গেল বছর ১২০০ টাকা দিয়া এই ছাতাডা কিনছি। বলেই একটা তৃপ্তির হাসি দিলেন।
এই যে একা একজন মেয়ে হয়ে ছেলেকে নিয়ে দিনরাত পরিশ্রম করে যাচ্ছেন, সবটা ফুরিয়ে যায় নাকি কিছু জমান?
নাহ। যা জমাইছিলাম দুজন মিলে ব্যবসা কইরা সে (স্বামী) সব নিয়া চইলা গেছে।
ঘর ভাড়া কত দিতে হয়?
সাত হাজার টাকা ঘরভাড়া দেওন লাগে। আমার পোলাডার জন্য দোয়া কইরেন খালা। যেন সে মানুষ অইতে পারে।

হাজেরা বেগম একজন একা নারী। যুদ্ধ করে চলেছেন জীবনের সাথে অহর্নিশ। থেমে যাননি, হেরে যাননি। কারও বাসায় কাজ করবেন, এমনটাও আত্মসম্মানে লেগেছিল বলে পঞ্চগড়ের মেয়ে হাজেরা বেগম তাই ফেলে যাওয়া স্বামীর স্মৃতি আগলে বসে না থেকে একাই লড়ে যাচ্ছেন একমাত্র ছেলেকে নিয়ে। আমাদের প্রত্যকেরই জীবনের বাঁক জীবনের গল্প বড় অদ্ভুত। মা-বাবা এখনো বেঁচে আছেন হাজেরা বেগমের। বছর তিনেক আগে একবার ঘুরে এসেছেন গ্রামের বাড়ি থেকে। দেখে এসেছেন মা-বাবাকে।
এমন হাজার-লাখ হাজেরা বেগম ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছেন আমাদের এই সমাজে, এই শহরেরই অলিতে গলিতে। তাঁদের জন্য দেশ-রাষ্ট্র হয়তো ভাবছে কিংবা ভবিষ্যতে ভাববে। একজন হাজেরা বেগমকেও যেন আর অজানা কারণে প্রতারিত না হতে হয়, তেমন একটা আইন হোক না পাস। স্বামী-সন্তান নিয়ে আনন্দে বাঁচুক ছোট্ট এই ফড়িংয়ের জীবন।

*লেখক: রোজিনা রাখী, সিনিয়র এক্সিকিউটিভ, স্টেট ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ