শুভ জন্মদিন, স্যার

হুমায়ূন আহমেদ

সকাল সকাল অফিসে এসেই চাকরিটা হারালাম! প্রভিডেন্ট ফান্ড, গত দুই মাসের কিছু কনভেনিয়েন্স বিল আর চলতি মাসের ১২ দিনের বেতন নিয়ে বেরিয়ে এলাম অফিস থেকে। সোজা চলে গেলাম মিষ্টির দোকানে। চারটা মতিলাল লাড্ডু দিয়ে উদ্‌যাপন করলাম কর্মহীন সময়ের। প্রথমবারের মতো আজ টিপসও দিলাম।

সুভাস কান্তি নামে আমার এক সহকর্মী ছিলেন। ভদ্রলোক বলতেন, ‘বুঝলেন ভাই, যেদিন মন মিজাজ অইত্যধিক খারাপ থাকবে, পকেটে টাকার জোর থাকবে না তেমন, সেদিন উড়াধুরা চলবেন, টাকা উড়াইবেন।’

আমার মন খারাপ নেই, তাই উনার কথা মানার কোনো যুক্তি আপাতত দেখছি না। উড়াধুড়া কীভাবে চলতে হয় সেটা বুঝতে পারছি না, তাই চুপচাপ হাঁটা দিলাম, আর ওড়াবার মতো খুব বেশি টাকাও পকেটে নেই। তাই আপাতত চুলগুলো উড়িয়ে হাঁটছি।
একটা সময় এসে বসলাম সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের একটা বেঞ্চিতে। বার্ধক্যের ভারে নুয়ে পড়া লোকদের আশ্রয়স্থলই নাকি এমন পার্ক, আঠা লেগে থাকা বেঞ্চগুলো। আপাতত কাজকর্ম নেই। তাই ক্ষণিকের জন্য নিজেকে প্রবীণই ভেবে নেওয়া যাক। হঠাৎ এক ভদ্রলোকের প্রশ্নে চমকে উঠলাম।

‘ভাই সাহেব, চাকরি হারাইলেন?’
কিছুই বুঝে উঠতে পারলাম না! ৪০-৫০ হবে হয়তো বয়স, আধপাকা চুল মাথায়, লম্বাটে মুখের আদলে একটা চশমা ঝুলিয়ে রেখেছেন নাকের ডগায়। একনাগাড়ে বলতেই থাকলেন...
‘শুনেন ভাই, অবাক হবার কিছু নেই। ভাবতেছেন কীভাবে জানলাম আপনার কথা? আপনি আইজ নতুন, কিন্তু আমি প্রতিদিনই দেখি আপনার মতো বেশ কয়েকজন। পরথমে আইসা ভয়ে ভয়ে বসে, তার কাছে মনে হয়, আশেপাশের সবাই তার দিকে তাকাই আছে, কিছুক্ষণ পর বসা থেকে হালকা আধশোয়া হয়ে থাকা, অকারণে পা নাড়াতে থাকা, তারপর আবার উঠে বসা, দুই হাতের উপর ভর দিয়া কাঁধ দুইটা উচা কইরা দিয়া মাথা নামায়া রাখা। চোখ মেলে রাখলে এসব দেখা যায় না, দেখতে হয় চোখ বন্ধ করে।’

আসেন চা খাই।
আমিও মন্ত্রমুগ্ধের মতো তার সঙ্গে উঠে গেলাম। একটা গাছের নিচে গিয়ে বসলাম। ফ্লাস্ক হাতে হেঁটে বেড়ানো একটা ছেলেকে ডাক দিলেন। দুজন চা খেলাম, সাথে একটা করে বেলা বিস্কুট। চা খাওয়া শেষে বললেন, চলেন আপনার বিহাইন্ড দ্য সিন দেখাই। কিছুই বুঝলাম না। তাও– হেঁটে গেলাম। নিয়ে গেলেন পার্কের মধ্যেই পুকুরের ধারে কিছুটা জংলা টাইপ অন্ধকার জায়গায়। কিছুটা ভয় পেলাম। তখনই বললেন, ভাই সাহেব, চাকরির শেষ কটা টাকা পকেটে, এইটা কেড়ে নেবার মতো লোক আমি না।

আশ্বস্ত হলাম, কিছুটা অবাকও!
যাই হোক জলাশয়ের ধারে ওই জংলায় ঢাকা জায়গায় গিয়ে দেখি জলাশয় থেকে পানি তুলে ওখানেই চা বানানো হচ্ছে আর কিছুক্ষণ পরপর ফ্লাস্ক হাতে লোকজন এসে চা ভরে নিয়ে যাচ্ছে। দেখে আমার বমি আসতে লাগল। এবার প্রথমবারের মতো উনাকে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘আপনি এটা আগে থেকেই জানতেন, এরপরও আমাকে এই চা খাওয়ালেন কেন? আর আপনিই বা কেন খাচ্ছেন?’

‘ভাই সাহেব, জানলেই অভ্যাস বদলাইতে হবে, এমন তো কোনো কথা নাই। ঘুষ খাওয়া অন্যায় জাইনাও তো অনেকে ঘুষ খায়; সিগারেট খেলে ক্ষতি হয় জাইনাও তো আপনি পকেটে সিগারেট নিয়া ঘুরতাছেন। এদের চা খাইলেও ক্ষতি নাই, বেচা বিক্রি হইব, এই পকেটের টাকা ওই পকেটে যাইব, দুনিয়া চলতে থাকব। দ্যেন ভাই সাহেব একটা সিগারেট দ্যেন, বুদ্ধির গোড়ায় একটু ধোঁয়া দিই...’
সিগারেট হাতে নিয়ে আইজ আসি বলে চলে গেলেন ভদ্রলোক।

পাঁচ টাকায় একটা জাতীয় দৈনিক হাতে নিয়ে আমি আবারও আরেকটা বেঞ্চিতে গিয়ে বসলাম। পাতা মেলে ধরতেই এক কোনায় ছোট্ট একটা কলাম চোখে পড়ল—
বেশ কয়েক দিন ধরে এক রহস্যমানবের দেখা মিলছে রাজধানী ঢাকায় ও তার আশপাশের এলাকায়। প্রত্যক্ষদর্শীদের বিবরণে জানা যায়, লোকটির বয়স চল্লিশ থেকে পঞ্চাশোর্ধ্ব হবে, মাথায় আধাপাকা চুল, উষ্কখুষ্ক, লম্বা গড়নের মুখাবয়ভ। অনেকটা ভবঘুরে ধরনের, তবে লোকটির হাসি অনেক মায়াবী, শিশুসুলভ। তিনি মাঝেমাঝেই নাকি নিজেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক (খণ্ডকালীন) দাবি করে থাকেন। অনুসন্ধানে জানা গেছে, প্রখ্যাত লেখক হুমায়ূন আহমেদের মিসির আলি চরিত্রের সাথে বেশ মিল এই রহস্যমানবের।

অনেকেই মনে করছেন, স্বয়ং হুমায়ূন আহমেদ স্যারই মিসির আলি চরিত্রে এখনো ঘুরে বেড়ান এই শহরে, চন্দ্রভুক রাতে, রাজপথের ঝুম বৃষ্টিতে, প্রচণ্ড রোদে নীলক্ষেত ট্রাফিক সিগন্যালে!

শুভ জন্মদিন শ্রদ্ধেয় হুমায়ূন আহমেদ স্যার! ভালো থাকুন ওপারে, মাঝে মাঝে জ্যোৎস্না হয়ে নেমে আসবেন এই ধুলোর পৃথিবীতে।