শুভ জন্মদিন প্রকৃতিকন্যা

‘সুরমা গাঙের পাড় বাড়ি, শাহজালালের উত্তরসূরি, কথায় কথায় বেটাগিরি, আমরা হক্কল সিলটি, আমরা হক্কল সিলটি’—সিলেটি ভাষায় সিলেটের জনপ্রিয় এই আঞ্চলিক গানের সুরে আমিও বলি আমরা হক্কল সিলটি।

সিলেট, কারও কাছে আধ্যাত্মিক নগরী, কারও কাছে চায়ের দেশ, কেউবা বলেন দ্বিতীয় লন্ডন, কারও চোখে প্রকৃতিকন্যা। এ রকম ভিন্ন ভিন্ন নামে দেশ–বিদেশে সিলেটের পরিচিতিরও আছে যথেষ্ট যৌক্তিকতা। সে ইতিহাস লিখতে গেলে লম্বা হয়ে যাবে। যা–ই হোক, সিলেটকে যে যা–ই বলে ডাকেন, আমার কাছে সিলেট একটা আবেগের নাম, হৃদয়ের আস্থার রাজধানী। স্বপ্ন পূরণের শহর। ভালোবাসার এই সিলেটের আজ জন্মদিন। অনেক উত্থান–পতনের পর ১৭৮২ সালের ৩ জানুয়ারি জন্ম নিয়েছিল সিলেট।

সিলেট–সম্পর্কিত বিভিন্ন থেকে জানা যায়, ১৮৭৪ সাল পর্যন্ত সিলেট জেলা ছিল ঢাকা বিভাগের অন্তর্ভুক্ত। ওই বছরেই ১২ সেপ্টেম্বর ভারতে নবসৃষ্ট আসাম প্রদেশের সঙ্গে সিলেটকে সংযুক্ত করা হয়। সিলেট পৌরসভা গঠিত হয় ১৮৭৮ সালে। ১৯৪৭ সালের আগপর্যন্ত (১৯০৫-১৯১১) পর্যন্ত বঙ্গভঙ্গ সময়ের কালটুকু বাদ দিয়ে সিলেট আসামেরই অংশ ছিল। ১৯৪৭ সালে ভারত বিভক্তির সময় গণভোটের মাধ্যমে সিলেট জেলা তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়। ১৯৮৩-৮৪ সালে প্রশাসনিক পুনর্গঠনের সময় বৃহত্তর সিলেট জেলাকে ৪টি নতুন জেলায় (সিলেট, সুনামগঞ্জ, হবিগঞ্জ ও মৌলভীবাজার) বিভক্ত করা হয়। ১৯৯৫ সালের ১ আগস্ট সিলেট দেশের ষষ্ঠ বিভাগ হিসেবে মর্যাদা পায়।

প্রাণের শহর সিলেটের নামকরণের ও রয়েছে মজার সব ইতিহাস। বিখ্যাত মুসলিম পরিব্রাজক আল-বিরুনী তাঁর ‘কিতাবুল হিন্দ’ নামক গ্রন্থে সিলেটকে ‘সিলাহট’ নামে উল্লেখ করেন। খ্রিষ্টপূর্ব চতুর্থ শতকের ঐতিহাসিক এরিয়ান লিখিত বিবরণীতে এই অঞ্চলের নাম ‘সিরিওট’ বলে উল্লেখ আছে। চীনা পরিব্রাজক হিউয়েন সাং তাঁর ভ্রমণকাহিনিতে এ অঞ্চলের নাম ‘শিলিচতল’ বলে উল্লেখ করেছেন। তুর্কি সেনাপতি ইখতিয়ার উদ্দীন মুহম্মদ বখতিয়ার খলজী দ্বারা এ দেশে মুসলিম শাসনের সূত্রপাত ঘটলে মুসলিম শাসকেরা তাঁদের দলিলপত্রে ‘শ্রীহট্ট’ নামের পরিবর্তে ‘সিলাহেট’, ‘সিলহেট’ ইত্যাদি নাম লিখেছেন বলে ইতিহাসে প্রমাণ মেলে। আর এভাবেই শ্রীহট্ট থেকে রূপান্তর হতে হতে একসময় সিলেট নামটি প্রসিদ্ধ হয়ে উঠেছে বলে ঐতিহাসিকেরা ধারণা করেন। এ ছাড়া বলা হয়, একসময় সিলেট জেলায় এক ধনী ব্যক্তির একটি কন্যা ছিল। তার নাম ছিল শিলা। ব্যক্তিটি তাঁর কন্যার স্মৃতি রক্ষার্থে একটি হাট নির্মাণ করেন এবং এর নামকরণ করেন শিলার হাট। এই শিলার হাট নামটি নানাভাবে বিকৃত হয়ে সিলেট নামের উৎপত্তি হয়। আবার সুলতানি আমলে এই অঞ্চলকে জালালাবাদ বলে ডাকা হতো।

নয়নাভিরাম প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, সমৃদ্ধ ইতিহাস, ঐতিহ্য, বৈচিত্র্যপূর্ণ সংস্কৃতি, দৃষ্টিনন্দন জীবনাচার সিলেটের প্রতি দেশি-বিদেশি পর্যটকদের বরাবরই মন কাড়ে। দাঙ্গা–হাঙ্গামা, চাঁদাবাজি তুলনামূলক কম, সুশৃঙ্খল প্রাকৃতিক পরিবেশ ইত্যাদি কারণে বাংলাদেশের অন্য যেকোনো অঞ্চল থেকে বসবাসের জন্য সিলেটকে সবচেয়ে নিরাপদ মনে করা হয়।

মুঘলদের সঙ্গে যুদ্ধ, নানকার বিদ্রোহ, ভাষা আন্দোলন, সর্বোপরি মুক্তিযুদ্ধে এ জেলার অবদান অপরিসীম। দেশে আসা রেমিট্যান্সের সিংহভাগই আসে সিলেটের মানুষের কাছ থেকে। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের স্বর্গরাজ্য সিলেটের মানুষের আতিথেয়তা বরাবরই মুগ্ধ করার মতো। জনশ্রুতি আছে, সিলেটের মানুষ দেয় বেশি, কম নেয়।

ভালোবাসার, ভালো লাগার প্রাণের সিলেট, অম্লান থাকুক লাল–সবুজের হৃদয় হয়ে। শুভকামনা, শুভেচ্ছা, প্রিয় প্রকৃতিকন্যা।

তথ্যসূত্র: আদি সিলেটের কথা, সিলেটের ইতিবৃত্ত, সিলেটের ইতিহাস, বাংলা তথ্য বাতায়ন।

লেখক: আশরাফ আহমেদ, শিক্ষার্থী, এমসি কলেজ সিলেট