শিক্ষাব্যবস্থার হাইওয়েতে গাড়ি চলবে কবে

১৪ মাস ধরে স্কুল কলেজ বন্ধ
ফাইল ছবি

করোনা মহামারির প্রভাবে প্রায় ১৪ মাস ধরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ। গত ১৪ মাসে কয়েক দফায় স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় খুলে দেওয়ার তারিখ ঘোষণা করা হলেও দফায় দফায় সেটি পিছিয়েছে। সব মিলে প্রায় পৌনে চার কোটি ছাত্রছাত্রীর শিক্ষাজীবন এখন বিপর্যস্ত।
করোনাভাইরাসের সংক্রমণ শুরুর পর থেকেই ব্যবসা-বাণিজ্য, স্বাস্থ্য, জীবিকা ও অর্থনীতির ক্ষয়ক্ষতি কমাতে বিভিন্ন ব্যবস্থা নিয়েছে সরকার। তবে মহামারির সব ক্ষতি আর্থিক নয়। কিছু ক্ষতি তার চেয়েও বেশি। করোনায় শিক্ষার ক্ষতি হয়েছে সবচেয়ে বেশি। এর প্রভাব দীর্ঘমেয়াদি এবং অত্যন্ত সুদূরপ্রসারী। আমরা বিষয়টি অনুধাবন করতে পারছি কি না, ভাবনার বিষয় সেটাই।

আমাদের পুরো শিক্ষাব্যবস্থা প্রধানত চার রকমের বিপর্যয়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। প্রথমত, শ্রেণিকক্ষে পাঠদানের সুযোগ পাচ্ছেন না শিক্ষকেরা। এই ক্ষতি কমাতে অনলাইন শিক্ষা কার্যক্রম ও রেডিও, টিভিভিত্তিক শিক্ষা কার্যক্রম চালুর চেষ্টা করেছিল সরকার। কিন্তু মাত্র ৫৬ শতাংশ শিক্ষার্থী এসব দূরশিক্ষণ কার্যক্রমের সঙ্গে যুক্ত হতে পেরেছে বলে ব্র্যাকের একটি জরিপে উঠে এসেছে। গণসাক্ষরতা অভিযানের জরিপে এ সংখ্যা মাত্র ৩০ শতাংশ। তা ছাড়া, টেলিভিশনের একপক্ষীয় শিক্ষাব্যবস্থায় প্রশ্ন করার কোনো সুযোগ নেই। এ কারণে শিক্ষার্থীরা এতে আগ্রহ হারাচ্ছে।

দ্বিতীয়ত, শ্রেণিকক্ষভিত্তিক মূল্যায়ন, পরীক্ষাভিত্তিক মূল্যায়নসহ শিক্ষার্থীদের সব ধরনের মূল্যায়নই থমকে গেছে। গত শিক্ষাবর্ষে প্রাথমিক থেকে উচ্চমাধ্যমিক পর্যন্ত শিক্ষার্থীরা বিনা মূল্যায়নে পরবর্তী শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হয়েছে। উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার (এইচএসসি) মতো গুরুত্বপূর্ণ পাবলিক পরীক্ষা নিতে পারেনি সরকার। ফলে পাবলিক পরীক্ষায় ‘অটো প্রমোশন’–এর পথে হাঁটতে হয়েছে।

শিশুদের পড়াশোনা চলছে বাসায়
ফাইল ছবি

চলতি বছরেও প্রায় একই অনিশ্চয়তায় পড়েছে পরীক্ষার্থীরা। সংক্ষিপ্ত সিলেবাস প্রণয়নের মাধ্যমে ৬০ দিন ক্লাস করিয়ে এসএসসি এবং ৮৪ দিন ক্লাস করিয়ে এইচএসসি পরীক্ষা নেওয়ার পরিকল্পনা করেছিল শিক্ষা মন্ত্রণালয়। কিন্তু করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের কারণে সে পরিকল্পনা ভেস্তে যেতে বসেছে। এর আগে জুন-জুলাইয়ে এসএসসি এবং সেপ্টেম্বর অক্টোবরে এইচএসসি পরীক্ষা নেওয়ার প্রাথমিক সিদ্ধান্তের কথা আমরা জেনেছিলাম। কিন্তু করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের কারণে তাও সম্ভব হচ্ছে না, সেটি নিশ্চিত করেই বলা যায়।

এ অবস্থায় দুটি পরীক্ষা দুই মাস পেছানোর পরিকল্পনা করছে আন্তশিক্ষা বোর্ড কর্তৃপক্ষ। ফলে, এ বছরেও শিক্ষার্থীদেরকে মূল্যায়ন করা সম্ভব হবে কি না, সেটি নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না। পরিস্থিতি বিবেচনায় টানা দ্বিতীয় বছরের মতো অটো প্রমোশনের সিদ্ধান্ত আসতে পারে। এটি পুরো শিক্ষাব্যবস্থায় দীর্ঘমেয়াদি নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।

আপাতত সীমিত পরিসরে হলেও সংক্রমণ কম, এমন কিছু অঞ্চলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়ার চিন্তা করতে হবে। অন্তত কিছু অঞ্চলে শুরু করতে পারলে শিক্ষার্থীদের স্কুলে যাওয়ার অভ্যাসটা ফিরে আসবে। তাদের মনঃসামাজিক বিকাশও ধীরে ধীরে শুরু হবে।

তৃতীয়ত, করোনার প্রভাবে পুরো শিক্ষাপঞ্জি এলোমেলো হয়ে গেছে। শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যসূচি নিয়মমাফিক অনুসরণ করা সম্ভব হচ্ছে না। সংক্ষিপ্ত পাঠদানের সিলেবাস তৈরি করা হলেও শ্রেণি কার্যক্রম শুরু না হওয়ায় সেটিও অনুসরণ করা সম্ভব হচ্ছে না। এর সঙ্গে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ভর্তি পরীক্ষা থমকে আছে প্রায় এক বছর ধরে। পরিস্থিতি বিবেচনায় শুধু এ বছর না, ভবিষ্যতেও এর প্রভাব মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করবে।

চতুর্থত, দীর্ঘদিন ধরে ছেলেমেয়েরা শ্রেণিকক্ষের লেখাপড়ার বাইরে থাকায় তাদের মনঃসামাজিক বিকাশ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। করোনায় শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়া, শিশুশ্রম, বাল্যবিবাহ এবং শিশু ও মাতৃমৃত্যুর হার বাড়ছে বলেই প্রতীয়মান হচ্ছে। যখন স্কুল তথা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান একসময় খুলবে, তখন অনেক শিক্ষার্থী আর স্কুলে নাও ফিরতে পারে। দীর্ঘদিনের পাঠদান বিরতির কারণে এদের একটি অংশ ঠিকমতো পড়াশোনা না পারা ও না বোঝার পরিস্থিতিতে পড়বে। আর আরেকটি অংশ সম্ভাব্য দারিদ্র্যের কশাঘাতে নিপতিত হয়ে মা–বাবার সঙ্গে কাজে ভিড়ে যাবে। এমনকি বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়েও অনেক শিক্ষার্থী আর ক্যাম্পাসে নাও ফিরতে পারেন।

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বুয়েট) ভর্তি পরীক্ষা শুরুর আগে পড়াশোনা করছেন পরীক্ষার্থীরা
প্রথম আলো ফাইল ছবি

দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো নেতিবাচক কারণে কিছুদিন ধরে গণমাধ্যমের শিরোনামে উঠে এলেও তাদের শিক্ষা কার্যক্রম স্থবিরই রয়ে গেছে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বিভিন্ন বর্ষের আটকে থাকা পরীক্ষা নেওয়ার কার্যক্রম সীমিত পরিসরে শুরু হলেও বর্তমানে এটিও বন্ধ রয়েছে। দায়সারাভাবে অনলাইন ক্লাস নেওয়া হলেও কোনো পরীক্ষা নিতে না পারায় শিক্ষার্থীরা সেশনজটের সম্মুখীন হয়েছেন।

সেশন জট কমাতে বারবার বিশ্ববিদ্যালয় খুলে পরীক্ষা নেওয়ার দাবি জানাচ্ছেন শিক্ষার্থীরা। তাঁদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বেশ কিছু পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় আটকে থাকা পরীক্ষাগুলো অনলাইনে সম্পন্ন করার উদ্যোগ নিচ্ছে। তবে শিক্ষার্থীদের একটি বড় অংশকেই এটি খুশি করতে পারছে না। গত এক বছরে যথাযথভাবে অনলাইন ক্লাসের ব্যবস্থা করতে ব্যর্থ হওয়া প্রতিষ্ঠানগুলো দ্রুততম সময়ের মধ্যে কীভাবে অনলাইন পরীক্ষার আয়োজন করবে, সেটি আসলে চিন্তারই বিষয়।

অন্যদিকে, অনলাইনে পাঠদানে বৈষম্যও আছে। শহরের সচ্ছল পরিবারের শিক্ষার্থীরা এমনিতেই পড়াশোনায় এগিয়ে থাকে। করোনা পরিস্থিতিতে তারা ক্লাস ও পরীক্ষার সুযোগ পাচ্ছে অনলাইনে। গ্রামের নিম্নবিত্ত পরিবারের শিক্ষার্থীরা সে সুযোগ পাচ্ছে না। উপযুক্ত ডিভাইসের অভাব এবং গ্রামে ইন্টারনেটের ধীরগতি ও কাভারেজ সংকটের ফলে গ্রামের বেশির ভাগ শিক্ষার্থী অনলাইন শিক্ষা কার্যক্রমের বাইরে রয়েছে। এই বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থীকে অনলাইন পরীক্ষায় আওতায় আনা বেশ কষ্টসাধ্য ব্যাপার। এ বিষয়ে সরকারের কোনো পদক্ষেপ আমাদের চোখে পড়ছে না।

গত ১৪ মাসে পরীক্ষামূলকভাবে দেশের অনেক খাত খুলে দেওয়ার চেষ্টা করা হলেও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে কোনো ঝুঁকিই নেওয়া হয়নি। প্রশ্ন থেকে যায়, দীর্ঘদিন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখার পরও দ্বিতীয় ঢেউ কেন এল? এতে সহজেই ধারণা করা যায়, করোনার নতুন সংক্রমণ বা দ্বিতীয় ঢেউ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কিত নয়। সাম্প্রতিক কালে ইউনেসকো-ইউনিসেফ পরিচালিত বৈশ্বিক গবেষণাও একই কথা বলছে। বরং তারা প্রমাণ পেয়েছে, বন্ধ থাকার কারণে শিক্ষার্থীরা যতখানি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, প্রতিষ্ঠান খোলা থাকার জন্য স্বাস্থ্যগত দিক থেকে ততখানি বিপর্যস্ত তারা হতো না। কাজেই স্বাস্থ্যঝুঁকি বিবেচনায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখায় করোনা সংক্রমণ লাগামের মধ্যে এসেছে—এমন কথা বলার কোনো বৈজ্ঞানিক ভিত্তি প্রতিষ্ঠিত হয়নি।

আপাতত সীমিত পরিসরে হলেও সংক্রমণ কম, এমন কিছু অঞ্চলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়ার চিন্তা করতে হবে। অন্তত কিছু অঞ্চলে শুরু করতে পারলে শিক্ষার্থীদের স্কুলে যাওয়ার অভ্যাসটা ফিরে আসবে। তাদের মনঃসামাজিক বিকাশও ধীরে ধীরে শুরু হবে। স্বায়ত্তশাসিত বিশ্ববিদ্যালয়গুলো স্বাস্থ্যবিধি মেনে শিক্ষা কার্যক্রম শুরু করার কথা বিবেচনা করতে পারে। সরকারের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে যত দ্রুত সম্ভব ১৮ বছরের ঊর্ধ্বের সব শিক্ষার্থীর সুরক্ষার জন্য টিকার ব্যবস্থা করতে হবে। এরপর পর্যায়ক্রমে দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দিতে হবে।

করোনার কারণে বন্ধ রয়েছে স্কুল-কলেজ
প্রথম আলো ফাইল ছবি

করোনার কারণে শিক্ষার দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতি হচ্ছে—এটি মাথায় নিয়ে কয়েক বছরের জন্য শিক্ষা উদ্ধার কর্মসূচি হাতে নিতে হবে। শিক্ষার্থীদের ক্ষতি পোষাতে ভবিষ্যতে শ্রেণিকক্ষের পাশাপাশি অনলাইন কার্যক্রম যুগপৎ চালু রাখা যেতে পারে। সে ক্ষেত্রে এমন মিশ্র পদ্ধতির শিক্ষাব্যবস্থার জন্য যত দ্রুত সম্ভব অবকাঠামো নির্মাণে জোর দিতে হবে। অত্যাবশ্যকভাবে দেশের সব অঞ্চলের জন্য উচ্চগতির ইন্টারনেট এবং সব পরিবারের শিক্ষার্থীর জন্য ডিজিটাল সামগ্রী নিশ্চিত করতে হবে। এসব কাজে শিক্ষা, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি এবং অর্থ খাতের সমন্বিত কাজ করা জরুরি।

বিভিন্ন খাতে সরকার প্রণোদনার ঘোষণা করেছে। শিক্ষা খাতেও সরকারকে প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করতে হবে। শিক্ষার ক্ষতি সহজে চোখে দেখা যায় না। শিক্ষা খাতে বিনিয়োগ করলেও ফল পেতে সময় লাগবে। শিক্ষার ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়ার জন্য সবার সম্মিলিত, সর্বাত্মক প্রচেষ্টা ও প্রয়োজনীয় বিনিয়োগসহ রাষ্ট্রের যথাযথ পদক্ষেপের কোনো বিকল্প নেই। এখনই সঠিক ব্যবস্থা না নিলে শিক্ষা খাতের এত দিনের অর্জন ধূলিসাৎ হতে খুব বেশি সময়ের প্রয়োজন হবে না।

*লেখক: অনিক আহমেদ, প্রাবন্ধিক