রুহিয়ার ভাষাসংগ্রামী ফজলুল করিমের বর্ণাঢ্য জীবন

ভাষাসংগ্রামী ফজলুল করিম
ছবি: সংগৃহীত

স্কুলজীবন থেকেই ফজলুল করিমের রাজনীতিতে হাতেখড়ি। নিজেকে তৈরি করেছিলেন সাম্যবাদী চিন্তায়। তিনি বাংলা ভাষা ও বাংলাদেশের মানুষকে অন্তর দিয়ে ভালোবেসেছিলেন। ১৯৫২ সালের বাংলা ভাষা আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন। ভাষা আন্দোলনের নেতৃত্ব দিতে গিয়ে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সাবেক প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ঠাকুরগাঁওয়ের ভাষাসৈনিক দবিরুল ইসলাম সঙ্গে তিনি কারাবন্দী হন। দিনাজপুর কারাগারে তাঁর ওপর নির্মম নির্যাতন চালানো হয়। তৎকালীন ঠাকুরগাঁও বালক উচ্চবিদ্যালয়ের প্রাক্তন ও অধ্যয়নরত ছাত্ররাই মূলত আন্দোলনের মূল ভূমিকা পালন করেন।

১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনের সময় দিনাজপুর সুরেন্দ্র নাথ কলেজের (বর্তমানে যা সরকারি কলেজ) মোজাফফর নামক জনৈক ছাত্রনেতা ঠাকুরগাঁও মহকুমায় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটি গঠনের লক্ষে একদিন সন্ধ্যায় ঠাকুরগাঁও বালক উচ্চবিদ্যালয়ের টিনশেড মুসলিম হোস্টেলে আসেন। সেখানে হোস্টেলের দুই নম্বর কক্ষে বসে দশম শ্রেণির ছাত্রদের নিয়ে সভা করেন। সভায় বিদ্যালয়ের সে সময়ের প্রাক্তন ছাত্র আলহাজ ফজলুল করিমকে সভাপতি ও দুই নম্বর কক্ষের আবাসিক ছাত্র মনসুর আলম মজিবুর রহমানকে সাধারণ সম্পাদক করে ২১ সদস্যবিশিষ্ট একটি রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটি গঠন করেন। এরপর থেকে বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে ঠাকুরগাঁওয়ে মিছিল, সমাবেশ, পিকেটিং, পোস্টারিং প্রচারের মধ্য দিয়ে জোরদার সংগ্রাম শুরু হয়। ২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় ছাত্রমিছিলে পুলিশের গুলিবর্ষণের ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে ঠাকুরগাঁওয়ের ছাত্ররা লাগাতার সাত দিন হরতাল পালন করেন। সেই হরতালে শুধু ডাক্তারখানা ছাড়া সব ধরনের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান, এমনকি খাবার হোটেল পর্যন্ত বন্ধ ছিল। সে সময় মাইকের ব্যবস্থা না থাকায় হাতে লেখা পোস্টারের মাধ্যমে আন্দোলনের প্রচার চালাতেন ছাত্ররা। সেই প্রচারের মাধ্যমে ভাষার দাবিতে সব শ্রেণি-পেশার মানুষ আন্দোলনে অংশগ্রহণ করে প্রতিবাদ জানাতেন।

ফজলুল করিম ১৯২৭ সালের ২ মার্চ তৎকালীন বৃহত্তর দিনাজপুরের ঠাকুরগাঁও মহকুমার রুহিয়া ইউনিয়নের কানিকশালগাঁও গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। বাবা নইমউদ্দীন আহমদ ও মা সতিজান নেসা। ১৯৪৬ সালে ফজলুল করিম ঠাকুরগাঁও হাইস্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাস করেন। এরপর ১৯৫০ সালে কলকাতা ইসলামিয়া কলেজ থেকে বিএ পাস করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি হলেও পড়ালেখা শেষ না করে ঠাকুরগাঁওয়ে ফিরে রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে ঠাকুরগাঁওয়ে তিনি গ্রেপ্তার হয়ে জেলে যান। ১৯৬২ সালের হামিদুর রহমান শিক্ষা কমিশনের বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছেন। ১৯৬৬ সালে ছয় দফা আন্দোলন ঠাকুরগাঁওয়ে ছড়িয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে তিনি অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের প্রাক্কালে ঠাকুরগাঁওয়ে আন্দোলনের কেন্দ্রবিন্দু ছিলেন মো. ফজলুল করিম। ১৯৭০ ও ১৯৭৩ সালের নির্বাচনে ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলা নিয়ে গঠিত দিনাজপুর-৩ (বর্তমান ঠাকুরগাঁও-১) আসন থেকে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ থেকে নির্বাচিত সংসদ সদস্য ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধে ৬ নম্বর সেক্টরের সিভিল অ্যাডভাইজার হিসেবে তিনি দায়িত্ব পালন করেন। সেই সঙ্গে ১৯৭১ সালের ঠাকুরগাঁও এলাকার মুক্তিযুদ্ধের সংগ্রাম কমিটির আহ্বায়ক ছিলেন। ১৯৭৫ সালে তিনি দিনাজপুর জেলা গভর্নর নিযুক্ত হন। সমাজসেবায় অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন তিনি।

ঠাকুরগাঁও সরকারি বালিকা উচ্চবিদ্যালয়, রিভার ভিউ হাইস্কুল ও ঠাকুরগাঁও সরকারি মহিলা কলেজ প্রতিষ্ঠায় ফজলুল করিমের অবদান গুরুত্বপূর্ণ। ঠাকুরগাঁও ডায়াবেটিক হাসপাতাল প্রতিষ্ঠায় তাঁর বিশাল অবদান রয়েছে। দীর্ঘদিন তিনি ঠাকুরগাঁও ডায়াবেটিক সমিতির সভাপতি ছিলেন। ঠাকুরগাঁওয়ের সদর হাসপাতাল, শিবগঞ্জ এয়ারপোর্ট নির্মাণে ভূমিকা রাখেন। বিশেষ করে শহরের আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় তাঁর বলিষ্ঠ ভূমিকা ছিল স্মরণযোগ্য। ক্রীড়াজগতেও অবাধে বিচরণ করেছেন, ফুটবল খেলতেন। ঠাকুরগাঁও নাট্য সমিতির সম্পাদক ও শেষে সভাপতি ছিলেন। ফজলুল করিম ২০১৫ সালের ৯ জানুয়ারি ঠাকুরগাঁওয়ে মৃত্যুবরণ করেন।