মারব চাবুক ছুটবে ঘোড়া

ঘোড়দৌড় প্রতিযোগিতা হয়ে গেল ঠাকুরগাঁওয়ের রুহিয়া থানার নবগঠিত ২২ নম্বর সেনুয়া ইউনিয়নবাসীর উদ্যোগে
ছবি: লেখক

একেবারে চোখের সামনে ঘটে গেল ঘটনাটা! শুষ্ক মৌসুমে গ্রাম এলাকার দারুণ এক বিনোদন। বাঁক নেওয়ার মুখে দুটো ঘোড়ার মধ্যে ধাক্কা লেগে, জকিসহ ৪ নম্বর (আলীতাজ) ঘোড়াটি উল্টে পড়ল মাঠে। বাকিরা কিন্তু কেউ থামল না ওদের জন্য।

সবাই দুরন্ত গতিতে উইনিং পোস্ট পেরিয়ে যাওয়ার চেষ্টায়। গ্রামের খালি ধানখেতে বসেছে, শত বছরের গ্রামবাংলার ঐতিহ্যবাহী ঘোড়দৌড় প্রতিযোগিতার জমজমাট আসর। গ্রামের সব বয়সী মানুষেরা দর্শক। প্রতিযোগিতামূলক এ খেলা শুধু ঘোড়াকে নিয়ে নয়, সঙ্গে যেন মেলাও জমে ওঠে।

গ্রামাঞ্চলে ঘোড়দৌড়ের এমন আয়োজন কমে গেলেও ঠাকুরগাঁওয়ের রুহিয়া থানার নবগঠিত ২২ নম্বর সেনুয়া ইউনিয়নবাসীর উদ্যোগে ঘোড়দৌড়-২০২১ প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয়। ঠাকুরগাঁও সদরের রুহিয়া থানাধীন নবগঠিত ২২ নম্বর সেনুয়া ইউনিয়ন পরিষদের পশ্চিম পাশে, বিমল মার্কেটসংলগ্ন ধানখেতে আয়োজন করা হয় ঘোড়দৌড়ের। আয়োজক বলতে ইউনিয়নবাসীর নামে কমিটি করা হয়, তাঁদের মিলিত চেষ্টায় সম্পন্ন হয় ঘোড়দৌড়। মাস তিনেক আগেই শুরু হয় প্রচার। ঘোড়া, জকি আর ঘোড়া–পালকদের অতিথি হিসেবে বরণ করে নেন ইউনিয়নবাসী।

দৌড় চলাকালে গ্রামে অতিথির সমাদরে ছিলেন ঘোড়দৌড়ে অংশ নেওয়া লোকজন। এক একটি দলে পাঁচটি ঘোড়া। অংশগ্রহণকারী প্রথম প্রতিযোগী ঘোড়ার জন্য পুরস্কার হিসেবে ছিল টেলিভিশন, দ্বিতীয় প্রতিযোগীর জন্য রাইস কুকার। পরে সব বিজয়ী ঘোড়া নিয়ে হয় চূড়ান্ত পর্ব। সেখানে প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্থান নির্ধারণ হয়।

ঘোড়দৌড়ের শেষ পর্বে শেষ প্রতিযোগিতায় জয়ীদের নিয়ে চলে জয়োল্লাস।
২৫টি ঘোড়া অংশ নেয় সেনুয়ার ঘোড়দৌড়ে। কে প্রথম হলো, সেটা খেয়াল রাখতে দর্শকসারির সামনে কমিটি নিয়োজিত স্বেচ্ছাসেবক। তাঁরা নির্ধারণ করেন প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয়। মাঠে দেখা গেল ‘পাওয়ার হাউস’, ‘রাজা’, ‘বাদশা’ কিংবা ‘বাংলার বাঘ’–এর।

দৌড়ের ঘোড়ার আছে এমন বাহারি সব নাম। ঘোড়দৌড়ের প্রতিযোগিতায় দর্শক গ্রামের সব বয়সী মানুষ।

গ্রামের ধানখেতই এখন যেন খেলার মাঠ। মাঠের মধ্যে বাঁশ পুঁতে গোলাকার একটি জায়গা চিহ্নিত করা। মানুষজনও গোল হয়ে বসা, কেউবা দাঁড়িয়ে। দৃষ্টি সবার একদিকেই। তুমুল করতালিতে শুরু হলো দৌড়। মাঠের মাঝখান দিয়ে চলছে ঘোড়া।

চলা নয়, এ তো প্রাণপণ ছোটা। পিঠে জকি, থামলেই চাবুকের ঘা। ছুটছে ঘোড়া, ঘুরে ঘুরে। তারপর বাড়তে থাকে গতি। এরই নাম ঘোড়দৌড়।

২২ নম্বর সেনুয়া ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সহসাধারণ সম্পাদক আশরাফুল ইসলাম বলেন, ইউনিয়নবাসীর অর্থসহায়তা থেকেই প্রতিযোগিতার খরচ মেটানো হয়। খরচ বলতে ঘোড়ার মালিকদের বাসস্থান ও খাওয়াদাওয়ার ব্যবস্থা করা। তিনি বলেন, ‘আমরা ছোট থাকতে বাপ-দাদার আমলে যেভাবে ঘোড়দৌড় দেখছি, ঠিক সেইভাবেই করছি।

এইটা একটা ঐতিহ্য, আমরা চাই ঐতিহ্যবাহী এই ঘোড়দৌড় যুগে যুগে হোক।’
দৌড়ে অংশ নিতে এসেছে সাদা, কালো, লাল, চিত্রা হরেক রঙের ঘোড়া। কিন্তু এসব ঘোড়াকে কেউ ‘ঘোড়া’ বলে ডাকে না। স্বভাব আর চরিত্রভেদে নাম থাকে নানা রকম। ‘পাওয়ার হাউস’, ‘রাজা’, ‘বাদশা’ কিংবা ‘বাংলার বাঘ’সহ নানা নামে তাদের পরিচিতি।

ঘোড়দৌড়ে মাইকে একটি ঘোড়ার নাম শুনে চমকে উঠলাম। ঘোড়ার নাম নাকি ‘আলীরাজ’! পঞ্চগড় জেলার দেবীগঞ্জ উপজেলাধীন লক্ষ্মীরহাট ইউনিয়ন থেকে আসা ‘আলীরাজ’ ঘোড়ার জকি ও মালিক রনি জানান, দর্শকদের নজর কাড়তেই নায়ক আলীরাজের নামে এই নামকরণ। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এসব ঘোড়ার নামকরণ আগে জনপ্রিয় যাত্রাপালা, বাংলা সিনেমা বা সাহসী কোনো চরিত্রের নামে নামকরণ করা হতো।

ঘোড়দৌড় প্রতিযোগিতায় সদর উপজেলাসহ বগুড়া, নীলফামারী, পঞ্চগড় থেকে ২৫ জন খেলোয়াড় তাঁদের নিজ নিজ ঘোড়া নিয়ে প্রতিযোগিতায় অংশ নেন। গ্রুপ ভাগ করে খেলা অনুষ্ঠিত হয় এবং তিনটি গ্রুপ এ, বি, সি–এর ১ম, ২য় ও ৩য় স্থানকারীদের নিয়ে ফাইনাল খেলা অনুষ্ঠিত হয়। প্রতিযোগিতায় প্রথম হয়েছে পঞ্চগড়ের বোদা উপজেলার পাঁচপীর থেকে আসা (পাওয়ার হাউস) ঘোড়ার মালিক রেজা এবং দ্বিতীয় হয়েছে বগুড়া থেকে আসা (রাজা) ঘোড়ার মালিক লেবু।

পরে খেলা শেষে বিজয়ীদের মধ্যে পুরস্কার বিতরণ করেন অতিথিরা। ঘোড়দৌড় দেখতে আসা আনারুল ইসলাম বলেন, ‘এমন আয়োজনে হাজারো দর্শকের উপস্থিতিতে আবেগ আপ্লুত হয়েছি। আয়োজকদের মধ্যে মো. রবিউল আলম রবি (সাধারণ সম্পাদক সেনুয়া ইউনিয়ন আওয়ামী লীগ) বলেন, ভবিষ্যতেও আরও বড় পরিসরে এ প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হবে।

ঘোড়দৌড় প্রতিযোগিতায় গেস্ট অব অনার হিসেবে উপস্থিত ছিলেন ঠাকুরগাঁও সদর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও ১৪ নম্বর রাজাগাঁও ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. মোশারুল ইসলাম সরকার, প্রধান অতিথি ছিলেন রুহিয়া থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি পার্থ সারথি সেন। রুহিয়া আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আবু সাঈদ বাবু, প্রভাত কুমার সিংহ, ১৪ নম্বর রাজাগাঁও ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মো. খাদেমুল ইসলাম সরকার প্রমুখ অতিথি ছিলেন।