মানবহিতৈষী লুকাস মারান্ডী

লুকাস মারান্ডী
ছবি : সংগৃহীত

১৯৭১ সালে এ মাসে সমগ্র জাতি এক সাগর রক্তের বিনিময়ে মুক্তির স্বাদ লাভ করে। মানবহিতৈষী লুকাস মারান্ডী জীবনের পুরোটা সময় মানুষের সেবা করে কাটিয়েছেন। ১৯৭১ সালে যুদ্ধের সময় মানুষের দুঃখ-দুর্দশার কথা ভেবে তাঁদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন তিনি। মানুষের সেবার কাছে তিনি নিজের জীবনকে তুচ্ছ মনে করেছেন। আর তাই তো তাঁকে প্রাণ দিতে হয়েছে পাকিস্তানি হানাদারদের হাতে।

১৯২২ সালের ৪ আগস্ট মাথিয়াস মারান্ডী ও মারিয়া কিস্কুর প্রথম সন্তান হিসেবে বেনীদুয়ার (দিনাজপুর) গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন লুকাস মারান্ডী। পিতা মাথিয়াস মারান্ডী ছিলেন একজন ধর্মপ্রচারক এবং মাতা মারিয়া কিস্কু। লুকাসের পরিবার ছিল সাঁওতাল। জন্মের কিছুদিন পর লুকাস মারান্ডীকে ধর্মরীতি অনুযায়ী খ্রিষ্টধর্মে দীক্ষা দেওয়া হয়।

লুকাস মারান্ডীর প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাজীবন শুরু হয় বেনীদুয়ার মিশন প্রাইমারি স্কুলে। তিনি ১৯৩৪ সালে দিনাজপুর সাঁওতাল মিডল স্কুলে (বর্তমানে সেন্ট ফিলিপ্স বোর্ডিং স্কুল) ভর্তি হন। প্রবেশিকা পাশের পর দক্ষিণ দিনাজপুরের সেন্ট আলবার্ট সেমিনারীতে দর্শনশাস্ত্রে অধ্যয়ন শুরু করেন। পরবর্তী সময়ে ঐশীতত্ত্ব অধ্যয়নের উদ্দেশ্যে তাকে ইতালি পাঠানো হয়। ঐশীতত্ত্ব বিষয়ে অধ্যয়ন শেষ করে লুকাস মারান্ডী দেশে ফিরে আসেন এবং ১৯৫৩ সালের ১ ডিসেম্বর দিনাজপুর ক্যাথিড্রালে যাজক হিসেবে অভিষিক্ত হন। লুকাস মারান্ডী তাঁর সাঁওতাল ২০ সম্প্রদায়ের ধর্ম প্রশিক্ষক হিসেবেও কাজ করেন এবং সাঁওতালি নেতা মনোনীত হন। যাজক হিসেবে লুকাস মারান্ডীর প্রথম কর্মস্থল ছিল বর্তমান দিনাজপুরের ঘোড়াঘাট উপজেলার মরিয়মপুর মিশন। এ মিশনে থাকাকালে তিনি সমাজে ন্যায় প্রতিষ্ঠা এবং নিম্নবর্গের অধিকার রক্ষার জন্য কাজ করেন।

পরে লুকাস মারান্ডী সেন্ট ফিলিপ্স বোর্ডিংয়ের দায়িত্ব পান। ১৯৬৫ সালে লুকাস মারান্ডী দিনাজপুর মিশনের অন্তর্বর্তীকালীন পরিচালকের দায়িত্ব নেন। কিন্তু ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের কারণে সেখানে দায়িত্ব পালনে অসুবিধা দেখা দিলে তাঁকে অস্থায়ী যাজক হিসেবে ঠাকুরগাঁওয়ের রুহিয়াতে নিয়োগ দেওয়া হয়। যাজকীয় দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি তিনি রুহিয়া এলাকার কৃষির উন্নতির জন্য দক্ষ নেতা নির্মাণের প্রয়াস চালান। এ উদ্দেশ্যে তিনি রুহিয়ায় একটি ছোট বোর্ডিং স্কুল চালু করেন।

১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর রুহিয়া মিশনারিতে শরণার্থীরা আশ্রয় নেয়। লুকাস মারান্ডী এই অসহায় মানুষদের আশ্রয়ণ ও খাবার সংস্থানের ব্যবস্থা করেন। তাঁর প্রেরণায় অনেক আদিবাসী যুবক প্রত্যক্ষ যুদ্ধে যোগ দেন। এ ছাড়া তিনি গোপনে আহত মুক্তিযোদ্ধাদের ওষুধ ও চিকিৎসাসেবা দান করেন। ১৯৭১ সালের ১২ এপ্রিল মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য ওষুধপথ্য সংগ্রহের উদ্দেশ্যে লুকাস মারান্ডী ঠাকুরগাঁওয়ের রুহিয়া থেকে সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতের গয়াডাঙ্গা মিশনে এবং পরের দিন ইসলামপুর মিশনে যান। দেশে ফিরে আসা বিপজ্জনক হলেও লুকাস মারান্ডী অসহায় মানুষদের পাশে দাঁড়ানোর জন্য রুহিয়াতে ফিরে আসেন। দেশে ফিরে তিনি দেখতে পান রুহিয়ার জনগণ ভারতের শরণার্থীশিবিরগুলোর উদ্দেশে পালাতে শুরু করেছে।

এ সময়ে ফাদার লুকাস মারান্ডীর কাছে সংবাদ পৌঁছায় যে দিনাজপুরের চারটি মিশনারি পরিত্যক্ত ঘোষণা করা হয়েছে। তাঁকেও রুহিয়া মিশন ছেড়ে যাওয়ার জন্য সতর্ক করা হয়। পরে ফাদার মারান্ডী তাঁর মিশনারির লোকজন নিয়ে দেশত্যাগের সিদ্ধান্ত নেন। সঙ্গীদের নিয়ে নাগর নদ অতিক্রম করে ভারতীয় সীমান্তে পৌঁছান। পরে ফাদার মারান্ডী একাই মিশনারিতে ফিরে আসেন।

১৯৭১ সালের ২১ এপ্রিল পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর একটি গাড়ি মিশনের সামনে এসে থামে এবং চারজন সৈন্য গাড়ি থেকে নামে। ফাদার লুকাস মারান্ডী চা-বিস্কুট সহকারে তাদের আপ্যায়িত করেন। পাকিস্তানি সৈন্যদের সন্দেহ ছিল মিশনের অভ্যন্তরে মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয় দেওয়া হতে পারে। সৈন্যরা মিশনে তল্লাশি করে প্রথমে চলে যায় এবং তিন ঘণ্টা পর আবার ফিরে আসেন। পাকিস্তানি সৈন্যরা ফাদারকে মিশনের বাইরে নিয়ে যায় এবং তাঁর ওপর অত্যাচার চালায়। একপর্যায়ে তারা বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করে।

শহীদ ফাদার লুকাস মারান্ডীর মৃতদেহ ভারতের ইসলামপুর মিশনে নিয়ে সমাহিত করা হয়। ফাদার লুকাস মারান্ডী ছিলেন তৎকালীন দিনাজপুর অঞ্চলের প্রথম দেশীয় যাজক। রুহিয়া মিশনে তাঁর স্মরণে স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করা হয়েছে। দিনাজপুর শহরের দক্ষিণে শহীদ ফাদার লুকাস মারান্ডীর নামে একটি সড়কের নামকরণ হয়েছে। বেনীদুয়ার মিশনে প্রতিবছর ২১ এপ্রিল ফাদার লুকাস মারান্ডী স্মরণে একটি ফুটবল টুর্নামেন্টের আয়োজন করা হয়। রুহিয়ায় তাঁর নামে একটি বিদ্যালয় করা হয়েছে—‘রুহিয়া শহীদ ফাদার লুকাস উচ্চবিদ্যালয়।’

  • আপেল মাহমুদ, রুহিয়া, ঠাকুরগাঁও