মাওলানা ভাসানী ও তাঁর সংস্কৃতি ভাবনা

মজলুম জননেতা মাওলানা ভাসানী

মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন সাবেক ছাত্র ও বর্তমানে শিক্ষকতা করার সুবাদে মাওলানা ভাসানীর পুণ্যভূমি সন্তোষে দীর্ঘ ১২ বছর কাটিয়েছি। বিভিন্ন সময়ে মাওলানা ভাসানীকে নিয়ে পড়ালেখা ও ভাসানীর সংস্পর্শে থাকা ব্যক্তি অথবা ভাসানীর বিভিন্ন ঐতিহাসিক নিদর্শন থেকে মাওলানা ভাসানীকে কিঞ্চিৎ চেনা ও জানার সুযোগ হয়েছে। তিনি ছিলেন উদারপন্থী প্রগতিশীল চিন্তা-চেতনার অনুসারী, ধর্মীয় সংকীর্ণতা, গোঁড়ামি বা কুসংস্কারবিরোধী একজন মানুষ। মূলত কৃষক-শ্রমিকসহ সমাজের আপামর জনসাধারণের সঙ্গে মিশে যাওয়ার চিরাচরিত গুণ থেকে তিনি সে সময় বাংলার সামাজিক, আর্থসামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট বুঝতে সক্ষম হয়েছিলেন। আজকের লেখায় আমি মূলত মাওলানা ভাসানীর সাংস্কৃতিক ভাবনা এবং এই সাংস্কৃতিক ভাবনার মাধ্যমে তিনি কীভাবে দরিদ্র মেহনতি মানুষের জন্য আন্দোলন করেছেন, সমাজ পরিবর্তনের স্বপ্ন দেখেছিলেন, তার তাৎপর্য তুলে ধরার চেষ্টা করেছি।

মাওলানা ভাসানীর ভাবনায় সব সময় থাকত বিভিন্ন সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব, লেখক, সাহিত্যিক, কবি, বিজ্ঞানী, বুদ্ধিজীবীদের চিন্তা ও দর্শন। তাঁর বিভিন্ন বক্তব্য ও আলোচনায় পাওয়া যেত তার প্রতিফলন। ১৯৫৪ সালে সুইডেনের স্টকহোমে বিশ্বশান্তি সম্মেলনের ভাষণে তিনি বলেছিলেন, ‘বন্ধুগণ, বিগত দেড় শ বছর সুইডেনের মহান অধিবাসীরা যুদ্ধ থেকে নিজেদের সম্পূর্ণরূপে নির্লিপ্ত রাখতে পেরেছেন। আজ সেই দেশের মাটিতে বিশ্বশান্তি সম্মেলনে বক্তৃতা দেওয়ার সৌভাগ্য হওয়ায় আমি নিজেকে গৌরবান্বিত মনে করছি। আমি শ্রদ্ধা জানাই সেই মহান বৈজ্ঞানিক আইনস্টাইনকে, যিনি আমরণ সংগ্রাম করেছেন যুদ্ধের বিরুদ্ধে। আমি অভিনন্দন জানাই বিশ্ব সাহিত্যিক জর্জ বার্নার্ড শকে, যিনি ছিলেন বিশ্বশান্তি আন্দোলনের অন্যতম প্রধান উদ্যোক্তা। আমি শ্রদ্ধা জানাই বৈজ্ঞানিক জুলিও কুরিকে, যাঁর জীবনের একমাত্র সাধনা মানবতাকে হানাহানি ও রক্তারক্তি থেকে মুক্তি দিয়ে পৃথিবীর বুকে শাশ্বত শান্তির নির্মল পরিবেশ সৃষ্টি করা। আমি শ্রদ্ধা জানাই সোভিয়েত ইউনিয়নের কালজয়ী ঔপন্যাসিক ইলিয়া ইরেনবুর্গকে, যাঁর অমর লেখনী আজ নিয়োজিত মানুষে মানুষে ভ্রাতৃত্ববোধ ও চিরস্থায়ী মৈত্রী স্থাপনের কাজে।’ তাঁর এই বক্তব্য থেকে অনুমান করা যায় তিনি বিখ্যাত ব্যক্তিদের প্রতি অনুরক্ত ছিলেন এবং তাঁদের সম্মান করতেন।

মাওলানা ভাসানী সারা জীবনই ছিলেন মেহনতি মানুষের পক্ষে আর আমাদের সমাজে মেহনতি-বঞ্চিত মানুষের পক্ষে কথা বলাই মানে তাঁকে বলা হয় বিদ্রোহী। তাই অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী মাওলানা ভাসানীকে তুলনা করেছিলেন বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের সঙ্গে। তিনি তাঁর এক প্রবন্ধে বলেন, ‘মওলানা সমগ্র জীবনভর বিদ্রোহী ছিলেন, যেমন বিদ্রোহী ছিলেন কাজী নজরুল ইসলাম। একজন রাজনীতিতে, অপরজন সাহিত্যে। মানুষের বঞ্চনা তাঁরা উভয়ে দেখেছেন, ক্ষমতা ছিল না উপলব্ধিকে অবদমিত করেন, তাই আবেগের উদ্বেলিত শক্তিকে নিজেদের মধ্যে ধারণ করে তাঁরা অসাধারণ হয়ে উঠেছেন। তাঁদের পটভূমিতে ও প্রস্তুতিতে অকিঞ্চিৎকরতা ছিল। স্বাভাবিক ছিল তাঁদের পক্ষে সংখ্যাহীন মানুষের স্রোতে একটি সংখ্যা হয়ে যাওয়া। তাঁরা তা হননি। আবেগ তাঁদের অসামান্য করলো, করলো সাহসী, করলো বিদ্রোহী, করলো বিপ্লবী।’ ৩ সেপ্টেম্বর ১৯৭৬ সাপ্তাহিক ‘হক-কথা’য় প্রকাশিত প্রবন্ধ থেকে জানা যায়, মাওলানা ভাসানী কবি কাজী নজরুল ইসলামের ভক্ত ছিলেন এবং খুব সমাদর করতেন।

অপর দিকে, সংগীতের প্রতি মাওলানা ভাসানীর ছিল গভীর টান। কাগমারী সাংস্কৃতিক সম্মেলনে তিনি দেশ-বিদেশের সব বিখ্যাত সংগীতশিল্পীকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। সৈয়দ ইরফানুল বারী তাঁর লেখা ‘আমার ভালোবাসা মওলানা ভাসানী’ বইয়ে বলেছেন, ‘রাজনৈতিক ও সমাজ সংস্কারের কাজে তিনি গানকে অতীব গুরুত্ব দিয়ে থাকতেন। তাঁর সম্মেলন কিংবা সভায় গান বরাবরই থাকত। প্রায়ই তিনি প্রখ্যাত গায়ক মুকুন্দ দাসের কথা বলতেন। মাইক ছাড়া তিনি গান গাইতেন এবং লক্ষাধিক লোক রাতভর একঠাঁই বসে মুকুন্দের গান শুনত। এ ছাড়া তিনি ছিলেন কবিগানের খুব সমঝদার। কবিয়াল রমেশ শীলের কথা বলে তিনি গর্ববোধ করতেন। ভাষা আন্দোলনে নূরুল আমিনের গুলি ছোড়া কিংবা তাঁর আমলে লবণের ক্রাইসিস পত্র-পত্রিকায় জোর প্রচার হলেও এই দেশের শতকরা ৯০ জন নিরক্ষর মানুষ ঘটনা প্রবাহের আলোকে রচিত গানে গানে প্রভাবিত হয়েছে।’

মওলানা ভাসানী যে শুধু সাংস্কৃতিক ব্যক্তিবর্গের সমাদর করতেন, কদর করতেন, ব্যাপারটা সে রকম নয়। বিপরীতভাবে বাংলাদেশ, ভারতবর্ষসহ পৃথিবীর বিখ্যাত কবি, সাহিত্যিক, শিল্পীরাও মাওলানা ভাসানীর সাংস্কৃতিক ভাবনায় মুগ্ধ ছিলেন। মাওলানা ভাসানীর সঙ্গে তাঁদের নিয়মিত যোগাযোগ ছিল। তাঁরা বিভিন্ন সময় মাওলানা ভাসানীর জ্ঞান ও গুণের প্রশংসা করতেন। ’৭০-এর ২৩ নভেম্বর তিনি পল্টনের জনসভায় স্লোগান দেন, ‘স্বাধীন পূর্ব পাকিস্তান জিন্দাবাদ’। শামসুর রাহমান কবিতা লিখলেন, ‘হায়, এ কি মন্ত্র জপলেন মওলানা ভাসানী’। কবিতাটি পাঠ করে আমার কাছে মনে হয়েছে একজন কবি কারও প্রতি কত অনুরক্ত হলে এভাবে কবিতা লিখে ফেলতে পারেন। সেই কবিতার কিছু পঙ্‌ক্তি আমাকেও আলোড়িত করেছে। কবি শামসুর রাহমান লিখেছেন, ‘মানুষ শিল্পী, কবি, দেশী কি বিদেশী সাংবাদিক, খদ্দের, শ্রমিক, ছাত্র, বুদ্ধিজীবী, সমাজসেবিকা, নিপুণ ক্যামেরাম্যান, অধ্যাপক, গোয়েন্দা, কেরানী, সবাই এলেন ছুটে পল্টনের মাঠে, শুনবেন দুর্গত এলাকা প্রত্যাগত বৃদ্ধ মৌলানা ভাসানী কি বলেন’। আসলে ১৯৭০-এ দক্ষিণ বাংলায় প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের ফলে মাওলানা ভাসানী স্বাধীন পূর্ব পাকিস্তানের দাবি উত্থাপন করেন, সেদিনকার জনসভায় মওলানা ভাসানীর ভাষণটি ছিল অত্যন্ত হৃদয়স্পর্শী। দক্ষিণ বাংলায় বিরাট জনপদ সফরের পর ভাসানী বললেন, সেখানে একটি ঘুঘু পাখিও আমি দেখিনি। তিনি পাকিস্তানি শাসকদের চরম অবহেলার কথা বলতে গিয়ে বলেন, ওরা কেউ আসেনি।

কাগমারী সম্মেলনের ৬০ বছর পূর্তি উপলক্ষে বিশিষ্ট প্রাবন্ধিক ও লেখক সৈয়দ আবুল মকসুদের ‘কাগমারী সম্মেলন: মওলানা ভাসানীর পূর্ব বাংলার স্বাধিকার ও সাম্রাজ্যবাদবিরোধী সংগ্রাম’ বইটি পড়লে বোঝা যায় মাওলানা ভাসানীর সাংস্কৃতিক ভাবনা ও সাহচর্য কত বিস্তৃত ছিল। প্রখ্যাত লেখক সৈয়দ আবুল মকসুদকে বলা হয় ভাসানীর জীবনীকার, কারণ এ পর্যন্ত ভাসানীকে নিয়ে তিনি লিখেছেন পাঁচটি বই। ‘কাগমারী সম্মেলন: মওলানা ভাসানীর পূর্ব বাংলার স্বাধিকার ও সাম্রাজ্যবাদবিরোধী সংগ্রাম’ বইটিতে সৈয়দ আবুল মকসুদ সংস্কৃতি সম্মেলনের প্রস্তুতি পর্ব, অতিথিদের আমন্ত্রণ, ভারতীয় অতিথিরা, সম্মেলনে পঠিত প্রবন্ধ, আলোকিত নারী সমাবেশ, চিত্রশিল্পীদের সমাবেশ, সংগীতশিল্পী দল, পেশাজীবীদের অংশগ্রহণ, শিল্পী কামরুল হাসানের আঁকা ধূমকেতুর কার্টুন, ওবায়দুল্লাহ মাতৃসেবা ও শিশুমঙ্গল কেন্দ্র এবং সর্বোপরি দুর্লভ সব আলোকচিত্রের চমৎকার বর্ণনা দিয়েছেন।

আন্তর্জাতিক সাংস্কৃতিক সম্মেলন সিদ্ধান্ত গ্রহণের পর ভাসানী তাঁর ঘনিষ্ঠ দেশের খ্যাতিমান কবি, শিল্পী, সাহিত্যিক ও সংস্কৃতিসেবীদের পরামর্শ নেন। এ থেকে প্রতীয়মান হয় যে মাওলানা ভাসানী সাংস্কৃতিক ব্যক্তিবর্গের পরামর্শ কি গভীরভাবে গ্রহণ করতেন।

আসলে কাগমারী সম্মেলনটি নামে সাংস্কৃতিক সম্মেলন হলেও সেখানে অর্থনীতি, ভূমিব্যবস্থা, কৃষি, রাসায়নিক শিক্ষা, ভাষা, শিক্ষা, সাহিত্য, নারীসহ সবকিছু নিয়ে আলোচনা হয়েছে। তবে একটি সাংস্কৃতিক সম্মেলন কীভাবে শাসন, শোষণ, নির্যাতন, নিপীড়ন, সাম্রাজ্যবাদ, পরাধীনতার বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তোলার সূতিকাগার হতে পারে, মাওলানা ভাসানী সেটাই দেখিয়েছেন। সৈয়দ আবুল মকসুদ বলেছেন, ‘কাগমারী সম্মেলনকে সাংস্কৃতিক সম্মেলন বলে অভিহিত করা হলেও এর রাজনৈতিক তাৎপর্য বিশাল এবং জাতির জীবনে সেই সম্মেলনের অভিঘাত হয়েছিল সুদূরপ্রসারী। কাগমারী সম্মেলন থেকেই মওলানা ভাসানী বাংলাদেশের মানুষকে প্রত্যক্ষভাবে সাম্রাজ্যবাদবিরোধী চেতনায় উদ্বুদ্ধ করেন। কাগমারী সম্মেলনের ভেতর দিয়ে একটি অসাম্প্রদায়িক বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনার প্রকাশ ঘটে এবং সাম্প্রদায়িক মুসলিম জাতীয়তাবাদীরা দুর্বল ও জনবিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।’ আবুল মকসুদের বইয়ে লেখা পশ্চিমবঙ্গের লেখক অন্নদাশঙ্কর রায়ের একটি বক্তব্য আমার অনেক ভালো লেগেছে। অন্নদাশঙ্কর জানান, ‘ভারত থেকে যাঁরা ওই সম্মেলনে যোগ দিয়েছিলেন, তাঁদের কাছে তিনি যতটুকু শুনেছেন, তাতে তার মনে হয়েছে, এমন একটি সাংস্কৃতিক আয়োজন অবিভক্ত বাংলায় আগে ও পরে অথবা কখনো হয়নি।’ তাঁর এই বক্তব্য থেকেই বোঝা যায়, একটি সাংস্কৃতিক সম্মেলন কত বৃহৎ হতে পারে এবং সারা পৃথিবীর সাংস্কৃতিক ব্যক্তিসহ গণ্যমান্য ব্যক্তিত্বদের কীভাবে মিলনমেলায় বেঁধেছিল। এই সম্মেলনে শুধু ভারতবর্ষ থেকেই নয়, ইউরোপ, আমেরিকা, চীনসহ অনেক দেশের বিখ্যাত ব্যক্তি উপস্থিতি ছিলেন। কাগমারী সম্মেলনের এক ফাঁকে মাওলানা ভাসানী গ্রামের পথে হাঁটতে হাঁটতে ঔপন্যাসিক তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়কে বলেছিলেন, ‘পূর্ব বাংলা একদিন স্বাধীন হবেই। ১২ বছরের মধ্যে পূর্ব বাংলা পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন হবে।’ আজকের স্বাধীন বাংলা ভাসানীর সেই উচ্চারণের বাস্তব ফসল।

কবি, সাংবাদিক, সোহরাব হাসান মাওলানা ভাসানীর সাংস্কৃতিক চিন্তা বর্ণনা করতে গিয়ে আক্ষেপ করে বলেছেন, বাংলাদেশে রাজনীতি ও সংস্কৃতির স্রোতোধারা এক মোহনায় মেশার উদাহরণ খুব বেশি নেই। ব্যতিক্রম ছিল বাহান্ন, উনসত্তর ও একাত্তর, যেখানে জনগণ ছিলেন ‘নায়ক’। আন্দোলন-সংগ্রামের উত্তাল সেই সময়ে রাজনীতি ও সংস্কৃতির মেলবন্ধন ঘটেছিল। স্বাধীনতার পর আশির দশকে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনেও ছাত্র-তরুণদের পর লেখক-বুদ্ধিজীবী-সংস্কৃতিসেবীরাই প্রথম রাজপথে নেমে এসেছিলেন। আমার কাছেও মাওলানা ভাসানীর সাংস্কৃতিক সম্মেলনের সাফল্য দেখে মনে হয়েছে, একটি রাজনৈতিক দলের সম্মেলনে যদি সংস্কৃতি চর্চার সর্বোচ্চ বিকাশ ঘটে তাহলে হয়তো আমরা একটি ধর্মনিরপেক্ষ, মৌলবাদ ও জঙ্গিবাদ মুক্ত, মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ, বাঙালি জাতীয়তাবাদের আদর্শে উজ্জীবিত বাংলাদেশ বিনির্মাণ করতে সক্ষম হব।

  • লেখক: সহকারী অধ্যাপক, ক্রিমিনোলজি অ্যান্ড পুলিশ সায়েন্স বিভাগ, মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সন্তোষ, টাঙ্গাইল