বৈধতা ছাড়া কীভাবে চলছে স্পিডবোট?

দুর্ঘটনায় দুমড়েমুচড়ে যাওয়া সেই স্পিডবোট
ফাইল ছবি

মাদারীপুরের শিবচরে ৩ মে নৌ দুর্ঘটনায় স্বামী আরজু মিয়া ও দেড় বছরের সন্তান ইয়ামিনকে হারিয়ে আদুরি বেগমের বুকফাটা আর্তনাদ এবং মা-বাবা–বোনদের লাশ দেখে ৯ বছরের মিমের চিৎকার করে কান্না ও আহাজারি দেখে কারোরই হৃদয় ভরাক্রান্ত না হয়ে পারেনি। কিছু কিছু দুর্ঘটনা এমন মর্মান্তিক ও হৃদয়বিদারক, যা দেখতে এবং শুনতে খুবই কষ্ট হয়। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আদুরি বেগমের আহাজারি ও ৯ বছরের মিমের চিৎকার পুরোটা দেখার ক্ষমতাও হারিয়ে ফেলেছি।

স্বজন যে হারায়, সে–ই বোঝে স্বজন হারানোর যন্ত্রণা! যার চলে যায়, সে–ই বোঝে বিচ্ছেদের কত ব্যথা, কত যন্ত্রণা! আমরা দুদিন পরই হয়তো এসব ভুলে যাব, অন্য খবরের নিচে চাপা পড়ে যাবে আদুরি বেগম ও মিমের আর্তনাদ। কিন্তু তাঁদের আজীবন বুকে বয়ে চলতে হবে স্বজন হারানোর যন্ত্রণা।
বাংলাদেশে সড়ক ও নৌ দুর্ঘটনা একটা স্বাভাবিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। যেন কারও কোনো দায় নেই, কোনো কিছু করারও নেই। সব দায় শুধু যাঁরা মারা গেছেন, তাঁদের স্বজনদের!

পদ্মায় স্পিডবোটডুবিতে মাতা–পিতা ও দুই বোন হারিয়ে অলৌকিকভাবে বেঁচে যায় শিশু মিম। দুর্ঘটনার পর নদীতে একটি ব্যাগ ধরে ভাসছিল সে। এ সময় নৌ–পুলিশের সদস্যরা তাকে উদ্ধার করে। শিশু মিম শুধু জানে তার মা, বাবা, বোনেরা কেউ বেঁচে নেই। মাঝেমধ্যেই মা মা বলে কেঁদে ওঠে সে। কান্নারত অবস্থায় মিম বলে, ‘আমরা দাদুবাড়ি যাচ্ছিলাম। দাদা মারা গেছেন। তাঁকে দেখতে। আমার আর কেউ নেই।’ কাঁদতে কাঁদতে শিশুটি বলে, ‘সাহ্‌রি খাওয়ার পর তারা ঢাকা থেকে শিমুলিয়ায় আসে। এরপর স্পিডবোটে ওঠে। স্পিডবোট অনেক দ্রুত চলছিল। তখন তারা তিন বোন ভয়ে কান্নাকাটি করছিল।’

সরকার নৌপথের উন্নয়নে হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করলেও এই খাতে নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর উদাসীনতা, দায়িত্বে অবহেলাসহ নানা কারণে নৌপথের যাত্রীদের নিরাপত্তা উপেক্ষিত থাকছে। হিসাব করে দেখা যাবে, আমাদের দেশে প্রতিবছর সড়ক দুর্ঘটনা আর জলপথ দুর্ঘটনায় করোনার চেয়ে কয়েক গুণ বেশি মানুষ প্রাণ হারায়। কিন্তু এর জন্য কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হয় না। আমরা বুঝি না, আর কত রক্ত লাগবে এ দেশে নিরাপদ গণপরিবহন ব্যবস্থার জন্য?
সড়কপথ, নৌপথ সবখানেই আজ বেপরোয়া দক্ষ ও অদক্ষ চালক। কার আগে কে যাবে, এটা যেন একটা স্বভাবে পরিণত হয়েছে। বেপরোয়া গতি ও অতিরিক্ত যাত্রী বহনের কারণে পদ্মায় প্রায়ই দুর্ঘটনার শিকার হয় স্পিডবোট। পদ্মায় স্পিডবোটে যাত্রী বহনে কোনো বৈধতা না থাকলেও এত চোখ এড়িয়ে এটি কীভাবে চলে, সংবাদমাধ্যমকে সে উত্তর দিতে পারেননি বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ), পুলিশ ও নৌ–পুলিশের কর্তাব্যক্তিরা।

করোনাভাইরাসের সংক্রমণ রোধে চলছে লকডাউন, সঙ্গে কালবৈশাখীর আশঙ্কা। এরই মধ্যে ধারণক্ষমতার কয়েক গুণ যাত্রী নিয়ে চলে স্পিডবোট। এমনকি যাত্রীদের লাইফজ্যাকেটও দেওয়া হয় না। এ দেশে কবে সঠিক নিয়ম হবে সবকিছুর? কবে আমরা অর্থলাভের আশা ত্যাগ করে মানুষ হিসেবে সভ্য হব? অনিয়মের বেড়াজালে আর কত প্রাণের বিসর্জন হলে আমরা শান্ত হব? কার কাছে আছে এর উত্তর ও সমাধান?

বছরের পর বছর অবৈধ পন্থায় এসব স্পিডবোট অতিরিক্ত যাত্রী নিয়ে চলাচল করছে, প্রশাসন বরাবরই নীরব দর্শকের ভূমিকায় ছিল। এই অব্যবস্থাপনার জন্য দায়ী যাঁরা, তাঁদের জবাবদিহি কোথায়?

লকডাউনে যানচলাচল বন্ধ থাকার পরও কেন এমন দুর্ঘটনা? এ প্রশ্নের জবাবে মাদারীপুরের জেলা প্রশাসক রহিমা খাতুন গণমাধ্যমকে বলেন, ‘স্পিডবোটটি মুন্সিগঞ্জ থেকে ছেড়ে বাংলাবাজারে আসে। তারা নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে স্পিডবোট ছাড়ে। এসব বিষয়ে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’ এ ছাড়া ফরিদপুর অঞ্চলের নৌ–পুলিশ সুপার মো. আবদুল বারেক বলেন, ‘লকডাউন কার্যকর থাকায় স্পিডবোট চলাচল সম্পূর্ণ বন্ধ। যে স্পিডবোট চলে, তা বাংলাবাজার ঘাট থেকে চলে না। এগুলো চলে শিমুলিয়া ঘাট থেকে। আমাদের এ পারের (বাংলাবাজার) ঘাটে লকডাউন কার্যকর আছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘পদ্মায় স্পিডবোটে যাত্রী বহনে কোনো বৈধতা নেই। তবু কেন চলাচল করছে, এমন প্রশ্ন করা হলে তিনি উত্তর এড়িয়ে যান।’

স্পিডবোটগুলো মনে হয় মঙ্গল গ্রহ থেকে বুধ গ্রহে যাতায়াত করত! বা হয়তো ইসরায়েল অথবা রাশিয়ার তৈরি, যা রাডারকেও ফাঁকি দিতে সক্ষম! তাই এত বছরেও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের চোখে পড়েনি! দুর্ঘটনা ঘটার পর সবেমাত্র স্যাটেলাইটের মাধ্যমে কর্তৃপক্ষ জানতে পেরেছে! প্রকৃত বাস্তবতা হলো, শত শত স্পিডবোট বছরের পর বছর চলছে কর্তৃপক্ষকে ‘খুশি’ করেই। স্পিডবোটগুলো কারও চোখ এড়িয়ে চলে না। বরং সত্যিটা হলো, যাদের এসব দেখার কথা, তারা অর্থের প্রলোভনে ‘সরল’ বিশ্বাসে; চক্ষুদ্বয় বন্ধ করে ছিলেন। সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যু, নৌ দুর্ঘটনায় মৃত্যু, ভবনধ্বসে মৃত্যু, আবাসিকে রাসায়নিক গোডাউনে অগ্নিকাণ্ড—এসব দেখতে দেখতে আমরা ক্লান্ত। খুব কষ্ট হয় এসব সংবাদ শুনতে। এটাই আমাদের অব্যবস্থাপনার ‘প্রিয়’ বাংলাদেশ। দেখার দায়িত্ব যাঁদের, তাঁদের চরিত্রের সঙ্গে আমাদের দেশের বহুল প্রচলিত বাংলা সিনেমাগুলোর শেষ (পরিস্থিতি মোটামুটি স্বাভাবিক হলে পুলিশ এসে হাজির হওয়া) দৃশ্যের মিল রয়েছে। তাঁরা, কোনো ঘটনা ঘটার পর তার পোস্টমর্টেম করেন।

বিআইডব্লিউটিএর শিমুলিয়া ঘাটের সহকারী পরিচালক (নৌ নিরাপত্তা ও ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা বিভাগ) মো. শাহাদাত হোসেন বলেন, লকডাউন চলার সময় এখান থেকে স্পিডবোটটি কীভাবে ছেড়ে গেল, এটা সবারই প্রশ্ন। এত সকালে স্পিডবোট চলার বিষয়ে আমরা কেউ বলতে পারছি না। স্পিডবোটের কোনো নিবন্ধন নেই। তাই তারা ইচ্ছেমতো চলছে। এগুলো চলাচলে আমাদের কঠোর নির্দেশনা দেওয়া আছে। কিন্তু নৌ–পুলিশ ও কোস্টগার্ড এগুলো নিয়ন্ত্রণ করবে। তারা নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে আমাদের পক্ষে কী আর করা! এ ছাড়া মাদারীপুরের পুলিশ সুপার গোলাম মোস্তফা রাসেল বলেন, ‘পদ্মা নদী দিয়ে যে নৌযানে যাত্রী পরিবহন করে, তাদের অনুমোদনের বিষয়গুলো নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় দেখে। আমরা যাত্রীদের নিরাপত্তা দেওয়ার জন্য কাজ করি। কোনো অবৈধ নৌযান চলাচল করে থাকলে সংশ্লিষ্ট দপ্তর আমাদের সহযোগিতা চাইলে আমরা তাদের পাশে থাকি। তারপরও স্পিডবোটে যেহেতু যাত্রী পরিবহনের অনুমোদন নেই, আমরা বিষয়টি নিয়ে কাজ করব।’

প্রতিটি দুর্ঘটনার পরই দেখা যায়, নানামুখী কর্তৃপক্ষ নানা কথা বলে। এমন অনেক ঘটনায় কেউ কেউ একে অপরকে দোষারোপ করে। এ ছাড়া ঘটনা ঘটার পরই দেখা যায়, সেই বাহন ও চালকের লাইসেন্স নেই। অতিরিক্ত যাত্রী বহন করেছে। কিন্তু তার আগে কোথায় থাকেন দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা? দুর্ঘটনা ও জানমাল হানির পরই কর্তৃপক্ষের ঘুম ভাঙে।

মাদারীপুরের শিবচরে বালুবাহী বাল্কহেডের সঙ্গে স্পিডবোটের সংঘর্ষে ২৮ জনের প্রাণহানির ঘটনার পর বেঁচে থাকা আদুরি বেগম অভিযোগ করেন, চালক ঠিকমতো স্পিডবোট চালাতে পারছিলেন না। ওই নৌ দুর্ঘটনায় স্বামী আরজু মিয়া ও দেড় বছরের সন্তান ইয়ামিনকে হারিয়ে আদুরি বেগম বলেন, ‘শিমুলিয়া ঘাট থাইকা গাদাগাদি কইরা স্পিডবোট ছাড়েন চালক। যাত্রার শুরু থিকাই এলোমেলো স্পিডবোট চালাচ্ছিলেন। শুরুতে একবার বোটটি উল্টে যাচ্ছিল। চালকের কারণেই আইজ আমার স্বামী-সন্তান হারাইলাম।’

এক দিকে লকডাউন, অন্য দিকে কালবৈশাখীর ভরা মৌসুম। এরই মধ্যে ১২-১৪ জন যাত্রী ধারণক্ষমতার স্পিডবোটে লাইফজ্যাকেটবিহীন ৩০-৩৫ জন যাত্রী কীভাবে ওঠানো হলো? কারা এ স্পিডবোট চালান? কারা এ অবৈধ কারবার নিয়ন্ত্রণ করেন? অনিয়ম এবং দায়িত্বে অবহেলার জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে শাস্তির আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি। লকডাউনের মধ্যেও এত বেশিসংখ্যক যাত্রী নিয়ে স্পিডবোট চলাচলের জন্য ঘাট ইজারাদার, নৌ–পুলিশ, কোস্টগার্ড, বিআইডব্লিউটিএ ও সমুদ্র পরিবহন অধিদপ্তর কেউ দায় এড়াতে পারেন কি? তাই সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীল কর্মীদের বিরুদ্ধে অবহেলার অভিযোগে হত্যা মামলা হওয়া উচিত কি না, সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে ভেবে দেখতে হবে। আমরা বলতে চাই, নিহত প্রত্যেক ব্যক্তির পরিবারকে ২০ লাখ এবং আহত ব্যক্তিদের ৫ লাখ টাকা করে ক্ষতিপূরণ দেওয়া হোক।
স্পিডবোটের অনুমতি কীভাবে, কোথা থেকে মেলে, তা দিবালোকের মতো স্পষ্ট। এখানে রয়েছে টাকার বাণিজ্য। এদের পেছনে রয়েছেন অনেকেই, যাঁরা সিন্ডিকেট করে ইচ্ছেমতো যাত্রী ওঠায় ইচ্ছেমতো ভাড়া নির্ধারণ করে। বড় ধরনের দুর্ঘটনার সঙ্গে জীবনহানি না হলে কর্তৃপক্ষের টনক নড়ে না। এত বড় অনিয়ম বছরের পর বছর চলছে, সরকারি কোনো সংস্থার তদারকি ছিল কি? আজ এত মানুষ মারা যাওয়ার পর প্রশাসনের ঘুম ভেঙেছে। এখন কে এই মৃত্যুর দায় নেবে? প্রাণহানি না হলে অনিয়ম কখনোই চোখে পড়ে না কর্তৃপক্ষের।

যাঁরা মারা গেছেন, তাঁদের প্রতি সম্মান রেখেই বলছি, একটা স্পিডবোটে কীভাবে ৩২-৩৪ জন যাত্রী উঠতে পারে? জীবনের মূল্য কি এতই কম আমাদের? এমনিতে করোনা, তারপর আবার এত ছোট একটা নৌযানে কীভাবে ৩০-এর অধিক মানুষ উঠতে পারে? আমরা নিজেরাই কবে সচেতন হব? নিয়মশৃঙ্খলা কী জিনিস, আমাদের শিখতে হবে। রাষ্ট্রঘোষিত নিয়মশৃঙ্খলা কতটুকু মানছি আমরা? যাঁরা এভাবে গাদাগাদি করে যাত্রী ওঠান, তাঁরা তো অবশ্যই দোষী। কিন্তু যাঁরা ওঠেন, তাঁরা কি একটুও বিবেচনা করবেন না? আমরা কেন সচেতন হই না? কেন ছোট একটা বোটে এত লোক উঠতে হবে? আমাদেরও সচেতন হওয়া জরুরি। জীবনের কোনো ক্ষতি হলে আমারই হবে। আমরা জেনেশুনে অতিরিক্ত যাত্রী হয়ে উঠছি। তাই আমাদের সচেতন হতে হবে।
যাঁরা উঠেছিলেন, তাঁদের কেউ জোর করে ওঠায়নি। তাঁরাই কীভাবে উঠলেন? স্পিডবোটওয়ালারা তো টাকার জন্য পারলে ৫০ জন নিতে চাইবেন। কিন্তু যাত্রীরা দেখে-শুনে-বুঝে কেন উঠবে? যাঁরা বুঝে-শুনে মরণফাঁদে পা দেয়, তাদের পরিণতি কীভাবে ভালো আশা করা যায়?