বাংলাদেশের সন্তানেরা সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়তে জানে

পদ্মা সেতু
ফাইল ছবি

অন্যের বাঁচাকে সার্থক করে তোলার মধ্যে নিজের অন্তর্নিহিত সুখটাকে উপলব্ধি করা যায়। পূর্ব পাকিস্তানের অধিকার আদায়ে বাঙালিরা সচেষ্ট ছিল। নিজের পাওনাটুকু থেকে বঞ্চিত না করার চেষ্টায় ছিল। তাই আজ আমরা তোমাদের জন্য বিজয়ের মালা গাঁথি! শুনতে পাই বিজয়ের জয়ধ্বনি। বিজয়গাথার মধ্যে নিহিত থাকে স্বপ্নের বারতা। তাই বিজয়ের আনন্দও শুরু হয় এক অনন্য প্রত্যাশায়। বাংলাদেশের অর্জিত স্বাধীনতা এক অনন্য অধ্যায়ের সূচনা করে। মানুষের মনে আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটে রক্তে ভেজা অর্জিত স্বাধীনতার গৌরবে। বাঙালির চেতনায় জেগেছিল বলেই ১৯৪৮ সালে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর উর্দু ঘোষণার প্রতিবাদে দেশ জেগে উঠেছিল। লাহোর রেজল্যুশন স্টেটস–এর ‘এস’ আকৃতির অবয়বটাকে জোরজবরদস্তিমূলকভাবে বিলোপ করার মধ্যে মুক্তিকামী বাঙালি মানুষ কোনো সান্ত্বনা খুঁজে পায়নি। তাই আমাদের মুক্তিকামী মানুষের মধ্যে স্বাধীনতার স্পৃহা জেগেছিল। সে ক্ষেত্রে ছয় দফা আন্দোলন বাঙালি জাতিকে জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের প্রেরণায় উদ্বুদ্ধ করে। পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ পরাধীনতার আস্তাকুঁড়ে থেকে নিজেদের দূরে রাখতে সচেষ্ট হয়। বাঙালি জাতির মুক্তির সনদ ছয় দফা আন্দোলনের অন্যতম পুরোধা ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।

কিন্তু কর্তৃত্ববোধের সুষ্ঠু রূপায়ণ পশ্চিম পাকিস্তানিরা ভালোভাবেই তৈরি করে নিয়েছিল। পূর্ব পাকিস্তানকে (বর্তমান বাংলাদেশ) শোষিত শ্রেণিতে পরিণত করেছিল। শোষিতরা সমাজে নিষ্পেষিতই থেকে যায়। সে জন্যই পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী শোষক শ্রেণি হওয়ার স্বপ্নে বিভোর ছিল। কারণ, শোষক ও শোষিত শ্রেণির মধ্যে দ্বন্দ্ব হলে শোষকদের জয়ী অবশ্যম্ভাবী। পশ্চিম পাকিস্তানের কাছে পূর্ব পাকিস্তান চিরকাল অবহেলিত ছিল। প্রতিনিয়ত পূর্ব পাকিস্তানকে শোষণ-বঞ্চনা, নিপীড়ন সহ্য করতে হয়েছিল। সেই নিপীড়িত জনগণ এবং গুরুত্বহীন জনপদের এক গর্বিত নেতা ছিলেন সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। যার অস্তিত্বে ছিল সর্বত্র বাঙালিয়ানা। বস্তুত বাংলার ঐক্য ও সংহতির শিল্পিত প্রতীক, প্রাজ্ঞ ও দৃঢ়চেতা এক জননেতা। তিনি একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম দেশের স্বপ্ন এঁকেছিলেন। তাই স্বাধীন বাংলাদেশের ভিতও রচনা করেছিলেন। কিন্তু ১৯৭৫ সালে তাঁর নৃশংস হত্যাকাণ্ড জাতিকে স্তিমিত করে দিয়েছিল। নিস্তব্ধতার আঁধারে ঢেকে গিয়েছিল পুরো দেশ।

আনোয়ার হোসেনের তোলা এই ছবিটি হয়ে উঠেছে আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ ও বিজয়ের প্রতীক। ১৯৭১–এ এটি তোলা হয়েছিল ঢাকার দোহারের একটি গ্রাম থেকে

ভঙ্গুর দেশ নিয়ে নব্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত দেশ ‘বাংলাদেশ’ নামক দেশটির যাত্রা শুরু। এখন সে দেশটিই উন্নয়নের টিকা নিতে পারে। পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফ প্রধান ইমরান খান প্রতিশ্রুতি দিলেন, তাঁকে ভোট দেওয়া হলে পাকিস্তানকে সুইডেন বানাবেন। প্রতিক্রিয়ায় সে দেশের প্রবীণ সাংবাদিক, নৃতাত্ত্বিক ও উন্নয়নকর্মী জায়গাম খানকে এক বাক্যে বলতে শুনি, ‘আমরা সুইডেনের মতো হতে চাই না। আল্লাহর দোহাই, অনুগ্রহ করে আমাদের বাংলাদেশের মতো করে দেন। (নেহি, মুঝে বাংলাদেশ বনা দো।)’

অর্থনীতির চাকা সচল নয় বরং বিপর্যস্ত অর্থনীতির করুণ দশায় পূর্ব পাকিস্তানকে দাঁড় করিয়ে রেখেছিল পশ্চিম পাকিস্তান। স্বাধীনতা–পরবর্তী সময়ে যে দেশটি অর্থনৈতিক মুক্তির শঙ্কায় ছিল সে দেশটিকে উন্নয়নের মডেল হিসেবে গণ্য মানেই বাংলাদেশের উন্নয়নে আত্মবিশ্বাস আরও বাড়িয়ে তোলা! যে দেশটি পূর্ব পাকিস্তানের অর্থনৈতিক তথা সংস্কৃতির ওপর আঘাত করতে পিছপা হয়নি সে দেশটিকে (বাংলাদেশ) পাকিস্তানের অনুসরণ করতে বলা মানেই তো একাত্তরের মধুর প্রতিশোধ! সেখানে উন্নয়নের স্পৃহা সমাজের সব মানুষের অবদানকে বিমোহিত করে। বাদ যায়নি গ্রামের দামাল ছেলেদের পরিশ্রমও।

অন্যের দ্বারা নিষ্পেষিত হয়েও যে দেশটি খাদের কিনারা থেকে আস্তে আস্তে উন্নতির ধাপে এগিয়ে চলে সে সোনার বাংলা দেশটিকে নিয়ে আজ আমরা গর্ব করতে পারি। স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছরে যে দেশটি সুন্দর ভুবনকে আঁকড়ে ধরে রেখেছে সেটি বহু কষ্টে অর্জিত আমাদের সোনালি অর্জন। সে অর্জনটুকু গায়ের দামাল ছেলেদের যেমন হাত রয়েছে, ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র হাতে গড়া গার্মেন্টস কিংবা তৈরি পোশাকশিল্পের অবদানও অমলিন থেকে যায়। আমরাই আমাদের দেশটাকে সুন্দর করে গড়তে জানি। সুন্দর সংস্কৃতির অবদানে নিজের দেশটিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার প্রত্যয়ে স্বাধীনতা অর্জন করি। সেখানেই আমরা খুঁজে পাই বাঙালিদের আত্মিক বন্ধন। তাই আমরা সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের স্বীকৃতি লাভ করে স্থায়ী উন্নয়নের যুগে প্রবেশ করেছি। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে লিঙ্গগত বিভাজন দূর করা হয়েছে। উন্নত করা হয়েছে পানি সরবরাহ এবং স্যানিটেশনের খাত। বাংলাদেশে প্রাথমিক বিদ্যালয় পার করে মাধ্যমিকে ভর্তির হার প্রশংসনীয় বলা চলে। টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের প্রত্যয়ে দেশ এগিয়ে চলে।

দরিদ্রতার হ্রাস-বৃদ্ধির সঙ্গে দেশের উন্নয়নের সম্পর্ক চিরায়ত। দারিদ্র্য বিমোচনে আমাদের দেশ সফলতার সঙ্গে এগিয়ে যাচ্ছে। দেশের সার্বিক উন্নয়নের ধারা বজায় রেখে আজকের এই বাংলাদেশকে আমরা কাছে পেয়েছি। অগ্রগতির জন্য অগ্রগণ্য সব ক্যাটাগরিতে এক বিস্ময়করই বলা চলে। যুদ্ধবিধ্বস্ত ভঙ্গুর অর্থনীতিকে সচ্ছলতার সোপানে টেনে নিয়ে আসা আমাদের অর্থনীতিতে ইতিবাচক ধারণাই তৈরি করে। করোনার সময়ে ব্যবসা-বাণিজ্যের ওপর বিরূপ প্রভাব পড়লেও প্রবাসীদের প্রেরিত রেমিট্যান্স দেশকে আরও সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে নিয়ে আসে। এলডিসি থেকে বের হওয়ার সক্ষমতা ২০১৮ সালে অর্জন করে। জিডিপিতে দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে প্রশংসনীয় পর্যায়ে এগিয়ে যাচ্ছে।

যাদের মাথা রাখার মতো ঠাঁই ছিল না এমন ৬৯ হাজার ৯০৪টি ভূমিহীন ও গৃহহীন পরিবারকে জমিসহ ঘর দিয়েছে বর্তমান সরকার। মুজিব বর্ষে এমন প্রশংসনীয় উদ্যোগের জন্যই নির্বিঘ্নে রাত্রি যাপন করছে এসব ভূমিহীন ও গৃহহীন পরিবার।
বিশ্বায়নে ক্রমেই বেড়ে চলেছে প্রযুক্তির হাতছানি। অনেক আশা-নিরাশার দোলাচলে দেশ সামনের দিকে এগিয়ে চলছে। ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণে আমরাও পিছিয়ে নেই। সে ক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট শ্রেষ্ঠত্বের দাবিদারই বলা চলে। করোনা মোকাবিলায় ভারত থেকে সঠিক সময়ে টিকা পাওয়া ভালোবাসার হৃদ্যতাই প্রকাশ করে। দুই দেশের সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্কের জন্যই এ অভূতপূর্ব সাফল্য। এটি বর্তমান সরকারের সফলতার অন্যতম দিক। বলতেই পারি, দেখে যাও হেনরি কিসিঞ্জার, আমাদের দেশের ঈশ্বর পাটনীর সন্তানেরা আজ সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন দেখে, উন্নয়নে এগিয়ে চলে। আমাদের দেশের ক্রিকেটাররা এখন টেস্ট খেলায় জিততে জানে। কখনোবা বিশ্বকাপ জেতার স্বপ্নে বিভোর থাকে। প্রতিনিয়ত টিমটা জ্বলে ওঠার জন্য দুহাত তুলে সবাই প্রার্থনারত থাকে।

কাঙ্ক্ষিত স্বাধীনতার আশা আমাদের বাঁচতে শিখায়, নব উদ্যমে এগিয়ে চলার সাহস জোগায়। গভীর মমত্ববোধের মিশেলে প্রিয় দেশটাকে স্বাচ্ছন্দ্যে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার প্রত্যয় ব্যক্ত করি। তাই পদ্মা সেতুর মতো বিশাল কর্মযজ্ঞেও দুঃসাহসিক কাজে অগ্রসর হই। স্বপ্নের পদ্মা সেতু দুই পারের জীবনযাত্রার আবহকে চিরকাল পথচলার মেলবন্ধন তৈরি করে দেবে। হৃদয়ে ধারণ করি দেশের উপার্জিত সোনালি অর্জন। সব প্রতিকূলতাকে পেছনে ফেলে পরম মমতায় আগলে রেখে যারা দেশটাকে সুবর্ণজয়ন্তীর দ্বারপ্রান্তে নিয়ে এসেছে তাদের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করি। তা না হলে পরাধীনতার গ্লানি থেকে মুক্ত হয়ে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর বারতায় উন্মুখ হতে পারতাম না।
আস্তে আস্তে আমাদের প্রিয় দেশমাতৃকা সফলতা বয়ে নিয়ে আসবে। উন্নতির আবহে নিজেকে রাঙিয়ে নেবে। বাঙালির চেতনাধারায় দেশটিকে বৈচিত্র্যময়তায় রূপদান দেবে।
* লেখক: অনজন কুমার রায়, ব্যাংক কর্মকর্তা ও লেখক