বাংলা ভাষার দুরবস্থা

আমি বাংলায় গান গাই
আমি বাংলার গান গাই
আমি আমার আমিকে চিরদিন এই বাংলায় খুঁজে পাই...

প্রতুল মুখোপাধ্যায়ের সুর ও লেখায় এ গানটিতে বাংলা ভাষার প্রতি বাঙালি জাতির গভীর মমত্ববোধ ও ভালোবাসা প্রকাশ পেয়েছে। যুগ যুগ ধরে এ গান শুধু বাঙালি গেয়েই আসছে, তবে বাংলা ভাষাকে আমরা অন্তরে সত্যিই কি জায়গা দিতে পেরেছি? পেরেছি কি এ ভাষার যথাযথ মর্যাদা ও সম্মান অক্ষুণ্ন রাখতে?

সভ্যতা ও সংস্কৃতি বিকাশে, তথ্যপ্রযুক্তির ব্যাপক অগ্রগতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে ক্রমাগত কমেছে সঠিক উচ্চারণে বাংলা ভাষার ব্যবহার। বেড়েছে বিদেশি শব্দের ব্যবহার। আজকাল নিম্নবিত্ত থেকে মধ্যবিত্ত, মূর্খ থেকে সমাজের উচ্চশিক্ষিত সবাই চায় কথার মাঝখানে একটু ইংরেজি বলতে। অথচ কেউ চায় না শুদ্ধ করে বাংলা বলতে।

বাংলা আর ইংরেজির সংমিশ্রণে আজকাল প্রতিনিয়ত বাংলিশ ভাষার প্রচলন বাড়ছে। ফলে বাংলা ভাষা হারাচ্ছে তার নিজস্ব স্বকীয়তা। সকালে ঘুম থেকে ওঠা থেকে রাতে ঘুমাতে যাওয়ার আগমুহূর্ত পর্যন্ত প্রতিনিয়ত আমরা বাংলা ভাষার অপব্যবহার করছি। এর কিছুটা আমরা জেনেশুনে করছি, কিছুটা আবার অজান্তেই। রেডিও, টেলিভিশনে আজকাল প্রায়ই আধুনিকতার নামে বাংলাকে ভিন্নভাবে উপস্থাপন করা হচ্ছে। তারকাদের কথার মাঝখানে শুধু বাংলা খোঁজা যেন আজকাল অমাবস্যার চাঁদের মতো। রেডিওর জকিদের বাংলা ভাষার উচ্চারণভঙ্গি, বিদেশি ভাষার সংমিশ্রণে প্রতিনিয়ত নানা সমালোচনা হয়। আর সালাম, বরকত, রফিক, শফিউর, জব্বারসহ অসংখ্য শহীদের প্রাণের বিনিময়ে অর্জিত বাংলা ভাষা কাঁদে। অথচ এ ভাষার জন্য বাংলা মায়ের দামাল ছেলেরা তাদের বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দিয়েছে। ভাষা আন্দোলনের ৬৮ বছর পার করেছি অথচ এখনো কোথাও বাংলা ভাষার প্রকৃত মর্যাদা নেই।

বাংলা ভাষা আজ বিপদগ্রস্ত। বাংলা ভাষার কেন এমন করুন পরিণতি ভবিষ্যতে কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে—এমন প্রশ্নের জবাবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক জাকিয়া সুলতানা মুক্তা বলেন, ‘বাংলা আমাদের মায়ের ভাষা, মাতৃভাষা। অথচ বাংলা ভাষাকে প্রাপ্য মর্যাদাটুকু দিতে আমরা কার্পণ্য করছি। অফিস, আদালত, বিভিন্ন সরকারি–বেসরকারি প্রতিষ্ঠান কিংবা আমাদের নিত্যদিনের কার্যক্রমে আমরা বাংলার চেয়ে ইংরেজিকেই বেশি প্রাধান্য দিচ্ছি।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমরা বিদেশি ভাষার বিরোধী নই, তবে যেখানে যতটুকু প্রয়োজন ঠিক ততটুকুই যেন ব্যবহার করি। আমরা বিদেশি ভাষা শিখব অবশ্যই বাংলাকে তার প্রাপ্য সম্মান আর মর্যাদা দিয়ে। কারণ, যে মাতৃভাষায় পারদর্শী না, সে ভিনদেশি কোনো ভাষায়ও পারদর্শী হবে না। মাতৃভাষাকে তার কাঙ্ক্ষিত মর্যাদা বা সম্মান দিতে হলে অফিস–আদালতসহ সর্বত্র বাংলা ভাষার ব্যবহার বাড়াতে হবে। যে ভাষাকে ভালোবেসে সালাম বরকত রফিক জব্বার জীবন উৎসর্গ করেছে, সে ভালোবাসাটুকু বর্তমান তরুণ প্রজন্মকে ধারণ করতে হবে। বাংলা ভাষার প্রতি যে আমাদের বাঙালিদের একটা ভালোবাসা আবেগ জড়িয়ে আছে, সেটা যেন শুধু দিবসকেন্দ্রিক না হয়। শুধু ২১ ফেব্রুয়ারি বা আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস এলেই শুধু আমরা বাংলার প্রতি মমত্ববোধ দেখাব না। আমাদের এ মমত্ববোধ যেন বছরজুড়েই থাকে।’

এ প্রসঙ্গে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক ড. শামীমা সুলতানা বলেন, ‘বাংলা ভাষাটা আসলে আমাদের অনেক কষ্টের বিনিময়ে অর্জিত, এটা আমাদের অস্তিত্ব সংশ্লিষ্ট। পৃথিবীতে একমাত্র বাঙালিরাই শুধু নিজ মাতৃভাষা রক্ষার জন্য জীবন দিয়েছে। সুতরাং বাংলা ভাষাকে যথাযথ সম্মান ও মর্যাদা প্রদর্শন করা উচিত। এটা রাষ্ট্রীয়ভাবে দেখানো দরকার,পারিবারিকভাবে দেখানো দরকার, ব্যক্তিগতভাবেও দেখানো দরকার। আর সেটার চর্চাটা শুরু হবে পরিবার থেকে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে। আজকাল আমরা আধুনিকতার নামে বিদেশি ভাষার প্রতি বেশি গুরুত্ব দিচ্ছি। চারদিকে একটা অসুস্থ প্রতিযোগিতা দেখা যাচ্ছে। আজকালকার ছেলেমেয়েরা ভালো চাকরি পাওয়ার আশায়, বিদেশে উচ্চশিক্ষা লাভের আশায় বিদেশি ভাষার প্রতি গুরুত্ব দিচ্ছে বেশি। এ যেন এক অসুস্থ প্রতিযোগিতা হয়ে দাঁড়িয়েছে চারদিকে। এটা থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে। আমরা বিদেশি ভাষা শিখব, তবে সেটা মাতৃভাষাকে অবজ্ঞা করে না। এটা আমাদের মায়ের ভাষা, এটাকে আগে ভালোভাবে রপ্ত করে নিতে হবে। আমরা যদি উন্নত বিশ্বের দিকে তাকাই, জাপান, চীন, জার্মানি, ফ্রান্স তারা কিন্তু প্রত্যেকেই নিজ ভাষা ও সংস্কৃতির প্রতি অত্যন্ত যত্নশীল।’

অধ্যাপক ড. শামীমা সুলতানা আরও বলেন, ‘আজকাল বিশেষ করে এমএফ রেডিওতে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে আমরা দেখি, বাংলা ভাষাকে বিভিন্ন বিকৃত রূপে উপস্থাপন করা হচ্ছে। তারা কথা বলছে বাংলা ভাষাতেই, কিন্তু তাদের উচ্চারণভঙ্গি থাকে ইংরেজি ভাষার মতো। তারা মনে করে, এটাই তাদের স্মার্টনেস। তাদের বোঝাতে হবে যে বাংলা আমাদের মাতৃভাষা, বাংলাকে অবজ্ঞা করলে মাকে অবজ্ঞা করা হয়। শুদ্ধ করে বাংলা বলেও আধুনিকতা দেখানো যায়।’

তরুণ প্রজন্মের উদ্দেশ্য ড.শামীম সুলতানা বলেন, কেউ যদি নিজেকে উপস্থাপন করতে চায়, সেটা তার মাতৃভাষাতেও সুন্দরভাবে উপস্থাপন করা যায়। আমরা ইংরেজি ভাষা শিখব তবে নিজ মাতৃভাষাকে অবজ্ঞা করে না। যেকোনো জাতি যদি তার দেশকে, দেশের মাতৃভাষাকে শ্রদ্ধা না করে, সে জাতি কখনোই মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারবে না। তাই তরুণ প্রজন্মের প্রতি আমাদের উদাত্ত আহ্বান থাকবে, আমরা আমাদের মাতৃভাষা তথা বাংলাকে তার যথাযথ সম্মান ও মর্যাদা দেব।’

  • লেখক: মো. রাশিদুল ইসলাম, ফিশারিজ অ্যান্ড মেরিন বায়োসায়েন্স বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, গোপালগঞ্জ