পরোক্ষ নয় প্রত্যক্ষ উপায়ে করোনা টিকার ব্যবস্থা হোক

করোনা পরীক্ষার নমুনা সংরক্ষণ করছেন এক স্বাস্থ্যকর্মী
ফাইল ছবি

করোনা মহামারিতে অচল সারা বিশ্ব। সবাই শুধু টিকা নিয়ে চিন্তা করছে, কখন টিকা পাবে, কীভাবে প্রয়োগ হবে, এসব নিয়ে যত পরিকল্পনা মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে বিভিন্ন দেশের জনগণের। কোন দেশ কখন পাবে, তা নিয়ে সব দেশের সরকার এবং সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ কাজ করছে। দেশের জনগণের জন্য অনেক দেশ সরাসরি টিকা উদ্ভাবনকারী দেশের সঙ্গে চুক্তি করে সংশ্লিষ্ট সরকার টিকার ব্যবস্থা করছে। আমাদেরও উচিত উদ্ভাবনকারী দেশ যেমন যুক্তরাজ্য, চীন ও রাশিয়ার সঙ্গে সরাসরি চুক্তি করে টিকার ব্যবস্থা করা। কারণ, আমাদের দেশের কিছু ওষুধ কোম্পানি রয়েছে, যাদের শক্তিশালী ল্যাব আছে, যেখানে টিকা তৈরি করা সম্ভব। এ ছাড়া করোনার টিকা রপ্তানির নামে আরেক দেশের নানা সিদ্ধান্ত আমাদের সরকারকে বিভিন্নভাবে বিব্রত করছে, যা কোনোভাবে কাম্য নয়। সে ক্ষেত্রে সরকারি বা বেসরকারি পর্যায়ে এসব চুক্তি করে আমাদের নিজেদের দেশে উৎপন্ন করতে পারলে অন্য দেশের ওপর নির্ভরশীল হওয়ার প্রয়োজন হয় না। সে ক্ষেত্রে টিকা পাওয়া এবং প্রয়োগ করা সহজ হতো। আমি মনে করি, সরকার ওষুধ কোম্পানি বা বেসরকারি প্রশাসনকে এ বিষয়ে উৎসাহ বা প্রণোদনা দিতে পারে। যাতে তারা উৎসাহ পেয়ে এই কাজে উদ্বুদ্ধ হতে পারে।

বাংলাদেশে কারা টিকা পাবে, তার একটি নীতিমালা প্রণয়ন করা হয়েছে। যেখানে ১৮ বছর বয়সের নিচের কাউকে টিকা দেওয়া হবে না। এ ছাড়া গর্ভবতী নারী ও বেশি ঝুঁকিপূর্ণ রোগীদের টিকা দেওয়া হবে না। ফলে প্রায় অর্ধেক মানুষ টিকার আওতায় আসবে। কারা টিকা পাবে, তার একটি তালিকা প্রণয়নের কাজ জাতীয় কমিটি কর্তৃক চলমান। করোনাভাইরাস মোকাবিলায় বেসরকারি হাসপাতালগুলো এগিয়ে এসেছিল। কিছু বাদে অন্যদের ভূমিকাও ছিল সন্তোষজনক। সেভাবে করোনার টিকা আনতে বেসরকারি পর্যায়ে কার্যকরী পদক্ষেপ নিলে আমরা সাধারণ নাগরিক অনেক বেশি উপকৃত হতাম। কারণ, বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে একটি চুক্তির অধীনে প্রায় অর্ধেক মানুষকে টিকা দেওয়া সময়সাপেক্ষ ও কঠিন। তাই আমার মতে, বিকল্প উপায়ে টিকার অনুমোদন নিয়ে যুক্তরাজ্য বা চীনের টিকা দেশে তৈরি করতে পারলে অনেক ভালো হতো। প্রতিবছর সাড়ে ৩ কোটি ডোজ টিকা দেওয়ার অভিজ্ঞতা রয়েছে আমাদের। ফলে প্রতি মাসে যে ৫০ লাখ করে টিকা আসবে, সেটার ব্যবস্থাপনা খুব একটা কঠিন হবে না। এমনকি বেশি এলেও কোনো সমস্যা হবে না।

সেরাম ইনস্টিটিউট পুনেভিত্তিক প্রতিষ্ঠান। অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার করোনার টিকা প্রকল্পের অন্যতম অংশীদার এই প্রতিষ্ঠান। সেরাম ইনস্টিটিউট ‘কোভিশিল্ড’ নামে ভারতে এই টিকা উৎপাদন করেছে। যদিও বাংলাদেশের বেক্সিমকো এবং ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউটের মধ্যে একটি চুক্তির অধীনে তিন কোটি করোনাভাইরাসের টিকা পাওয়া যাবে এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার কাছ থেকে যে পরিমাণ টিকা পাওয়ার আশা রয়েছে, সব মিলিয়ে তার পরিমাণ হবে ৪ কোটি ৯০ লাখ ডোজ। একটি ডোজের ২৮ দিন পর আরেকটি ডোজ দিতে হবে।

সরকার নিজস্ব অর্থায়নে এই টিকা ক্রয় করবে। টিকা উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে পরিবহন খরচসহ আমাদের দেশে আনতে প্রতি ডোজের দাম ধরা হয়েছে ৫ ডলারের আশপাশে। নিয়মানুযায়ী অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রেজেনেকা, আমেরিকা, ইংল্যান্ডসহ সাতটি দেশ অনুমোদন দিলে সেটি যেকোনো দেশ ব্যবহার করতে পারবে। ইতিমধ্যে ইংল্যান্ড এই টিকার অনুমোদন দিয়েছে।

বর্তমানে চীন, রাশিয়া ও যুক্তরাজ্য টিকা দেওয়া শুরু করেছে। আমরা কবে পাব, তা নিয়ে অনেক তথ্য রয়েছে। টিকার একমাত্র সমাধান এই মহামারি থেকে পরিত্রাণের উপায়। পৃথিবীতে অনেক দেশে সাধারণ মানুষকে কোভিডের টিকা দেওয়া শুরু হয়েছে। গত বছরের মার্চ মাসে বাংলাদেশে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ শুরু হয়, তখন অন্যদের মতো আমি নিজেই বেশ উদ্বিগ্ন ছিলাম। এর কয়েক মাস পরে জীবনযাত্রা যখন স্বাভাবিক হতে শুরু করে, তখন সেই ভয় কেটেছে।

বিশ্বের প্রথম দেশ হিসেবে যুক্তরাজ্য গত ২ ডিসেম্বর ফাইজার-বায়োএনটেকের করোনার টিকা ব্যবহারের অনুমোদন দেয়। ২০২০ সালের ৮ ডিসেম্বর দেশটিতে এই টিকার প্রয়োগ শুরু হয়। পরে যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, বাহরাইন, সৌদি আরব, ইউরোপীয় দেশগুলোসহ বিশ্বের আরও কয়েকটি দেশ ফাইজার-বায়োএনটেকের টিকার অনুমোদন দিয়ে তার প্রয়োগ শুরু করে। এ ছাড়া ভারতের ওষুধ নিয়ন্ত্রক কর্তৃপক্ষ গত শুক্রবার ওই টিকা ব্যবহারের অনুমোদন দেয়। ফলে এই অনুমোদনের খবরে বেক্সিমকোর শেয়ারের ব্যাপক মূল্যবৃদ্ধি হয়েছে। কারণ, বাংলাদেশের বেক্সিমকো এবং ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউটের মধ্যে একটি চুক্তি রয়েছে যে তিন কোটি টিকা দেবে ভারত। ভারতের যুক্তরাজ্যর সঙ্গে টিকা প্রকল্পে অংশীদারত্ব রয়েছে বিধায় তারা এই সুযোগ পেয়েছে। আমরাও এভাবে অন্য দেশের সঙ্গে অংশীদারত্বের ভিত্তিতে টিকা উৎপন্ন করতে পারতাম। এখনো সেই সুযোগ রয়েছে।

আমরা এভাবে টিকার অনুমোদন নিয়ে নিজেরা টিকার প্রয়োগ করতে পারলে খুবই ভালো হতো। এতে অন্য তৃতীয় দেশ বা ভায়া হয়ে টিকা ক্রয়ের প্রয়োজন হতো না। ফলে আমাদের দরকার অনুযায়ী মানুষকে টিকার প্রয়োগ করা যেতে পারত। করোনার টিকা নিয়ে অন্যান্য দেশের সঙ্গে যোগাযোগ করা উচিত সরকারের, যাতে আরও দ্রুত টিকা আনার ব্যবস্থা করা হয়। প্রধানমন্ত্রী যেভাবে করোনা মোকাবিলায় কাজ করছেন, তা খুবই প্রশংসনীয় এবং তাঁর নিকট কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি। আমার বিশ্বাস, সরকারপ্রধান অন্যান্য ইস্যুর মতো টিকার ব্যবস্থাপনায় সফল হবেন।

  • লেখক: সাবেক সভাপতি-শিক্ষক সমিতি, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়, ত্রিশাল, ময়মনসিংহ। [email protected]