পথশিশু

ফাইল ছবি

জান্নাতুল ফেরদৌস, বয়স মাত্র ৯ মাস তার। কী সুন্দর দেখতে! পরিচয়ে সে একজন পথশিশু। মায়ের কোলে বসে বসে পথের লোকেদের দেখছে। মাঝেমধ্যে হাত নেড়ে নেড়ে কী যেন বলছে। অস্পষ্ট ভাষা তার। বাংলা শেখার ব্যর্থ চেষ্টা করছে।
আদনানের খুব মায়া লেগেছে শিশুটির জন্য। সে তার কাছে গেল। শিশুটির মাকে জিজ্ঞাসা করল, আচ্ছা, ওর বাবা কোথায়?
হেসে হেসে উত্তর দিল, মইরে গেছে। গত মাসের ২৫ তারিখে।
মনে হচ্ছে, তার স্বামী মরে যাওয়াতে সে খুশি হয়েছে। বন্দী খাঁচা থেকে মুক্তি পেয়েছে।
এত ছোট একটা শিশু নিয়ে এভাবে পথে বসেছেন কেন?
কী আর কমু কন, জামাইডা মইরে যাওয়ার পর থেইক্কা রাস্তায় বইছি। আগে দিনকাল বালাই কাটছিল। তয় হেয় মইরা যাওয়াতে বালাই অইছে। বিয়ের প্রত্তম প্রত্তম খুব ভালোবাসত। পেটে বাচ্চা আওয়ানের পর থেইক্কা হেয় আমারে খালি মারধর করত। আমগো বস্তির এক ছেমরির লগে পিরিত কইরা বাইগ্গে গেছে। এর জন্যই কইছি, হেয় মইরে গেছে। হি হি।

কী অবলীলায় মেয়েটা তার জীবনের সংক্ষিপ্ত এক কালো অধ্যায় বর্ণনা করল। আদনানের মন ভীষণ খারাপ হলো। এত সুন্দর একটা বাচ্চা রেখে কি কেউ পালিয়ে যায়! দুনিয়াতে এত পাষাণ মানুষ থাকতে পারে!

এই মেয়ের বয়স কত হবে—বাইশ বা তেইশ। বস্তিতে থেকেও মেয়েটার কত স্বপ্ন ছিল স্বামীকে নিয়ে। কিন্তু জীবন কাকে কোথায় এনে দাঁড় করায়!

বেশ আগ্রহ নিয়ে আদনান অনেকক্ষণ কথা বলল। আদনানের বড্ড জানতে ইচ্ছা করে মানুষের জীবন। জীবনের গল্প। গল্পগুলো দুঃখের হলেও সুখের। কোনো স্ত্রীই চাইবে না তার স্বামী অন্য কারও সঙ্গে অবৈধ সম্পর্ক রাখুক। কক্ষনো না।

আশপাশের মানুষগুলো বড় বড় চোখ করে তাকিয়ে আছে। কেউ হয়তো তাদের সঙ্গে দু–একটা কথা বলে না। কাছে আসে না। তার মনে হলো, এ–ও হতে পারে!

সে ঘড়ি কিনতে যাচ্ছিল। গতকালও গিয়েছিল। দাম অনেক চেয়েছিল। পকেটে অত টাকা ছিল না, তাই কিনতে পারেনি সে। আজ বেশ কিছু টাকা নিয়ে এসেছে। ঘড়ি কিনবে বলে কিন্তু তার ইচ্ছা করছে না।
শুধু দূর থেকে পিচ্চিটাকে দেখতে ইচ্ছা করছে। ইশ্, কতটুকু বাচ্চা, পুতুলের মতো দেখতে, কী সুন্দর খেলছে। একা একা। তাদের সামনে দিয়ে মানুষ হাতির মতো হনহন করে হেঁটে যাচ্ছে। সবাই ব্যস্ত। ব্যস্ত শহর। যে যার মতো চলছে। কাউকে দেখার ফুরসতটুকুও যেন তাদের নেই।

আদনান ঘড়ি না কিনে শিশুটির কাছে ফিরে এল। শিশুটি মাড়ি বের করে হাসছে। এখনো তার দাঁত ওঠেনি। কিছুদিন পর উঠবে হয়তো। মায়ের বুকের স্তন মুখে দেওয়ার সময় দুয়েকটা কামড়ও বসিয়ে দেবে। মা ব্যথায় কুঁকড়ে উঠবে। বাচ্চাটি সামনের দুই দাঁত বের করে হাসবে। সেই হাসি দেখতে ইচ্ছা করছে আদনানের।

আজ তার পকেট গরম। দিলটাও তার নরম। পুরো টাকা শিশুটার হাতে দিল। ওর কচি নাক টিপে একটুখানি আদরও করল।

ওর মা কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে গেছে। এত টাকা একসঙ্গে কেউ হয়তো দেয়নি।
আদনান ল্যাম্পপোস্টের আলো গায়ে মেখে হাঁটছে। শিশু ও তার মা আদনানের চলে যাওয়া দেখছে। হাতে ঘড়ি নেই। কয়টা বাজে, কে জানে! ক্যাম্পাসের গেট হয়তো বন্ধ হয়ে গেছে। সে হাঁটছে আর মনে মনে বলছে, ‘আজ আরবি মাসের ষোলো তারিখ। আকাশে পূর্ণ চাঁদ। রাতটা আজ হেঁটে হেঁটেই কাটাব। যখন ক্লান্ত হব, তখন পত্রিকা বিছিয়ে চাঁদের দিকে তাকিয়ে রাস্তার এক পাশে পথশিশুদের মতো ঘুমিয়ে পড়ব।