নির্বিকার সমাজ ও আমাদের দুঃস্বপ্ন

ধর্ষণ
প্রতীকী ছবি

হয়তো নিষ্প্রভ সমাজের বীভৎসতার চেহারা দেখে আমার এক বন্ধু লিখেছে, ‘আজকাল আর আফসোস হয় না কন্যাসন্তান নেই বলে, বরং সৌভাগ্যবতী বলেই মনে হয়।’
কথাটির মধ্যে ভাবগাম্ভীর্যের কমতি ছিল না। তার হতবিহ্বল মলিন চেহারাটা কল্পনা করেছি। হয়তো সমাজ থেকে হারিয়ে ফেলেছে ভরসার শেষ আশ্রয়স্থল। হতাশাগ্রস্ত জীবনবোধের মধ্যেই অসহায়ত্বের চাহনি। শঙ্কিত চিত্তে নিমজ্জিত হয়ে আসে আঁধারের ঘনঘটা। ভাবি, ভাগ্যবিধাতা এভাবেই আমাদের লজ্জিত করল!

হয়তো সে তুলে ধরতে চেয়েছে একটি নিষ্ঠুর সমাজের একাংশের বাস্তবতা, যে সমাজে অবলীলায় ঘটে যায় ধর্ষণের মতো নিকৃষ্ট কিছু ঘটনা।

জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেকই নারী। অসমতার এই পৃথিবীতে অর্ধেক আকাশ মেঘে ঢাকা থাকলে আলোকিত জগৎ অপ্রকাশিতই থেকে যাবে। বুঝেই নিতে হয়, অবক্ষয়ে নিমজ্জিত মানুষগুলো আসলে এই স্বার্থপর নিষ্ঠুর সমাজেরই উৎপাদন। তাই সেই নিষ্ঠুর মানুষগুলো থেকে শিষ্টাচারসম্মত আচরণ সব সময় সমাজ নাও পেতে পারে।

নির্মম পরিহাসে সমাজের এসব মানুষ রং বদলায়। সভ্য সমাজের মাঝে দু-একজন নিষ্ঠুরতার ডাক দিতেই পারে। তারপরও আমাদের একটা ইচ্ছা থাকে, সে ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটাতে চাই ইতিবাচক ঘটনার মধ্য দিয়ে।

সমাজ আমাদের উত্তরণের পথ দেখায়। কখনো পিছপা হওয়ার বিমুখতা শেখায় না। মনের মাঝে জেগে থাকা ঈপ্সিত স্বপ্নগুলো জলাঞ্জলি দিয়ে কেউ যদি শিহরণ জাগানো সমাজব্যবস্থার মধ্যে নির্ভরতার জায়গাটুকু হারিয়ে ফেলে, বুঝতেই হবে সেখানে নেতিবাচক কিছু ঘটতে যাচ্ছে। এমনকি নির্যাতনের ভয়াবহতাও চরম পর্যায়ে চলে আসে। ফলে বীভৎস সমাজব্যবস্থা জানান দেয়। স্তম্ভিত হয়ে আসে সামগ্রিক জীবনের গতিধারা। সেখানে বিরাজ করে বীভৎসতার শত রূপ, শত আঙিনা!

বীভৎসতা যখন ধেয়ে আসে, সমাজ তখন স্তম্ভিত হয়ে আসে। স্তব্ধতা তাদের পিছু টানে, আষ্টেপৃষ্ঠে বিরাজ করে নির্মমতা। আমরা আমাদের আদিম সমাজকে নষ্ট সমাজের সঙ্গে তুলনা করি। বর্বরতার চরম মুহূর্তে বর্তমান এই সমাজও আদিম সমাজের ভাবাবেগে নিয়ে আসে। সেখানে বিবেকের আত্মতুষ্টি বলতে কিছু থাকে না।

যখন সামাজিক সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্কের মধ্যেও একটি শিশু নির্যাতনের শিকার হয় কিংবা পিতা তার কন্যাকে নিয়ে দায়গ্রস্ত হিসেবে সময় পার করেন, সে সমাজে নিষ্ঠুরতার গ্লানি মনে বেঁধে। পরিবারের মধ্যেই বেড়ে ওঠা কন্যাটি সামাজিকভাবে এখনো ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের পথটি বেছে নিতে পারে না। সদাভয়ার্ত হৃদয়ে পথচলা শুরুর রাস্তাটিও শেষ করতে হয় শঙ্কিত চিত্তে। মানবিকতার দ্বার সেখানে রুদ্ধ থাকে। হঠাৎ করে মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে নষ্ট সমাজের ছত্রচ্ছায়া। দু-একটি নেতিবাচক ঘটনা শঙ্কিত করে তোলে। সমাজে দেখা দেয় ছন্দপতন। ফলে, কেউবা অসহায়ত্বের গ্লানিতে ভোগে, কেউ নিজের সম্ভ্রম দিতে বাধ্য হয়। সেখানে পুরুষ ও নারীর মধ্যে দেয়াল তৈরি করলে আরও শঙ্কিত হয়ে ওঠে সমাজব্যবস্থা। ফলে অসহায়ত্বের বেড়াজাল থেকে মুক্তি পেতে কেউবা হাত বাড়িয়ে অপেক্ষায় থাকে।

ভালোবাসার আত্মিক বন্ধনে জড়ানো সমাজের মধ্যে কিছু অন্ধশ্লাঘা লোক তাদের দীর্ঘদিনের প্রয়াস পূরণে জেগে ওঠে। ফলে, সমাজের মানুষ দুশ্চিন্তার আঁধারে নিমজ্জিত হয়। মাঝেমধ্যে অসহায়ত্ব থেকে রক্ষা পেতে কারও কারও করুণা দাক্ষিণ্য করে। তাদের অসহায়ত্বের করুণ দৃষ্টি কাউকে ভাবায় না। নিভৃতে সমাজের এক কোণে ঠাঁই হয়। সারাটা জীবন তাদের এভাবেই নির্বাহ করতে হয়। রহস্যময় পরিবেশে কেউ কেউ খাপ খেয়ে মানিয়ে নিতে সক্ষম হয়। কেউবা অন্ধকারের অতল গহ্বরে হারিয়ে যায়। নিয়তি এখানে ভাগ্যনির্বাহক।

আবার যারা অসহায়ত্ব থেকেও নির্বিকার, তাদের ওপর নির্যাতনের ছায়া দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হয়। তাদের প্রতি সংক্ষুব্ধতার প্রকাশ সমাজ থেকে আসে। কিন্তু যে সমাজব্যবস্থায় নিজেদের প্রাধান্য দিয়ে আত্মিক স্তুতির সাপেক্ষে এ ধরনের পাশবিক কাজ করতে পারে, সে পাশবিক সমাজের একজন মানুষ হিসেবে চিন্তা নয়, নগ্ন চিন্তার বহিঃপ্রকাশ দেখতে পাওয়া যায়। তারই প্রতিফলন ঘটে কোনো একটি বিবেক বর্জিত কাজ করে। গর্হিত কাজের জন্য কখনো সমাজব্যবস্থাকে কেউ দায়ী করে, কেউবা সামগ্রিক পরিবেশটাকেই স্তম্ভিত করে রাখে।

ইদানীং আমাদের সমাজে ঘটে যাওয়া ধর্ষণের মতো নেতিবাচক ঘটনা আমাদের আরও শঙ্কিত করে তোলে। ফলে, সমাজে গভীর ক্ষতের সৃষ্টি হয়। নারীদের অবস্থান সুদৃঢ় হওয়ার বদলে সীমাবদ্ধতায় কড়া নাড়ে।

তাই এ দেশের সরকারকে নারী নির্যাতন রোধে বিশেষ উদ্যোগ নিয়ে জনসচেতনতা তৈরি করতে হয়। অবশ্যই সরকারি এসব উদ্যোগ প্রশংসনীয় বটে। কিন্তু আমাদের সমাজের সদিচ্ছা যত দিন না স্বতঃস্ফূর্ত হয়ে উঠবে তত দিন এই ধরনের বিরূপ বা নেতিবাচক অবস্থান থেকে আমাদের উত্তরণ সম্ভব নয়।

বিষণ্ন মনে শঙ্কিত হয়ে ভাবিয়ে তুলে বর্তমান সমাজের গতিপ্রকৃতি। কখনো ভাবি, এ সমাজটাই আমাদের আগলে রাখে, আবার এ সমাজেরই দু–একজন নিকৃষ্ট কাজে সায় দিয়ে আতঙ্কিত করে তোলে। আমাদের সমাজটাকে আমরা এখনো নষ্ট বলতে পারি না। এই সমাজে এখনো ভালো মানুষ আছে, যাদের আমরা সবাই সুন্দর মনের অভিসারী বলে মনে করি। তারাই হয়তো এ সমাজকে পিছুটান থেকে রক্ষা করবে। আশার কথা এই যে বর্তমান প্রজন্মের তরুণেরা এসব অনৈতিক কিংবা নেতিবাচক কাজ মানতে নারাজ। তারা স্তব্ধ সমাজে খুঁজে ফেরে প্রাণের পরশ।

তাই বলি, ভবিষ্যতে শ্বাপৎসংকুলমুক্ত এক সুন্দর সমাজের চিত্রিত রূপের স্বপ্ন কি আমরা দেখতে পারি না?

*ব্যাংক কর্মকর্তা। [email protected]