ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ডে উদাহরণ সৃষ্টি হবে কি

ধর্ষণ একটি ভয়ংকর শাস্তিযোগ্য অপরাধ। পৃথিবীব্যাপী এই অপরাধ আগেও ছিল, এখনো আছে। মোট কথা মানবজাতির অস্তিত্ব পৃথিবীতে যত দিন থাকবে তত দিন পর্যন্ত বিকৃত যৌন বাসনা চরিতার্থ করার চেষ্টা বিকৃত মানসিকতার পুরুষ চালিয়েই যাবে—এটাই বাস্তবতা এবং বাংলাদেশও এই বাস্তবতার ঊর্ধ্বে নয়। সম্প্রতি বাংলাদেশে ধর্ষণজনিত অপরাধ মাত্রাতিরিক্তভাবে বেড়ে যাওয়ায় বিভিন্ন মহল থেকে ধর্ষণকারীর শাস্তি মৃত্যুদণ্ড প্রদানের দাবি উঠেছিল এবং সরকার গণদাবির প্রতি সম্মান দেখিয়ে ধর্ষণজনিত অপরাধের সর্বোচ্চ শাস্তি যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের পাশাপাশি মৃত্যুদণ্ড সংযোজন করে এক অধ্যাদেশ জারি করেছে। সেই সঙ্গে ধর্ষণজনিত মামলার বিচার দ্রুততম সময়ের মধ্যে বিচারপ্রক্রিয়া সম্পন্ন করারও আশ্বাস দিয়েছেন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক। বিধান রাখা হয়েছে সংশোধিত আইনে। গণদাবির প্রতি সরকারের সম্মান প্রদর্শনকে নিশ্চয়ই সব মহলেই প্রশংসিত হবে বলে আমাদের বিশ্বাস।

ধর্ষণ এমন একটি অপরাধ, যার যন্ত্রণা শারীরিক ও মানসিকভাবে একজন ভুক্তভোগীকে আজীবন বয়ে বেড়াতে হয়। বিশেষভাবে মানসিক ট্রমার হাত থেকে ভুক্তভোগী নারী-শিশুর মুক্তি কখনো ঘটে না বলেই ধারণা করা যায়। বিশেষত বাংলাদেশের নারী, শিশুর ক্ষেত্রে, যেখানে বিজ্ঞানসম্মত মানসিক চিকিৎসার অপ্রতুলতা ব্যাপক। উন্নত দেশে ধর্ষণজনিত অপরাধের শিকার নারী-শিশু মানসিক চিকিৎসাসেবা, সামাজিক বা রাষ্ট্রীয় সুরক্ষাব্যবস্থার কল্যাণে স্বাভাবিক জীবনে ফেরার সুযোগ পেলেও বাংলাদেশের ক্ষেত্রে সেটা সম্ভব হয় না। এ ছাড়া বাংলাদেশে সামাজিকভাবে এমনকি পারিবারিকভাবে ভুক্তভোগী নারী–শিশুকে আরও বেশি নিগ্রহের শিকার হতে হয়। ধর্ষণজনিত অপরাধের বিচার পেতে একজন ভুক্তভোগী বা তার পরিবারকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে বা আদালতের দরজায় বছরের পর বছর ধরনা দিতে হয়।

ডাক্তারি পরীক্ষা, উন্মুক্ত বিচারকক্ষে প্রতিপক্ষ আইনজীবীর জেরার জবাব দিতে  দিতে একজন ভুক্তভোগীর ‘ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি’ দশা হয়ে হাল ছেড়ে দেওয়া ছাড়া উপায় থাকে না। বাংলাদেশে আইনের কোনো অভাব আগে ও ছিল না, এখনো নেই। শুধু যে জিনিসটির অভাব তা হলো সঠিক সময়ে আইনের সঠিক প্রয়োগ। জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে ‌অপরাধের মাত্রা। কয়েক বছর আগেই পূর্বের তুলনায় থানার সংখ্যা বাড়লেও আদালত বা বিচারকের সংখ্যা সেভাবে বাড়েনি। ১৭ কোটি মানুষের দেশে কেবল পুলিশ বা আদালতের সংখ্যা বৃদ্ধি করে বা মৃত্যুদণ্ডের মতো কঠোর আইন করে ধর্ষণের মতো অপরাধ নিয়ন্ত্রণ করা অসম্ভব। মৃত্যুদণ্ডের মতো কঠোর আইনই যদি অপরাধ নিয়ন্ত্রণ করতে পারত, তাহলে ‘মানুষ হত্যা করলে মৃত্যুদণ্ড অবধারিত’ জেনেও মানুষ হত্যার মতো অপরাধ করা থেকে বিরত হয় না।

জনসংখ্যা বৃদ্ধি, বেকারত্ব, হতাশা, বিনোদনের অভাব, পারিবারিক বন্ধনের শিথিলতা, সন্তানদের প্রতি অভিভাবকদের দায়িত্বশীল আচরণের অভাব, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষকদের যথোপযুক্ত শিক্ষা প্রদানের ঘাটতি, পারিবারিক ও সামাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয় সর্বোপরি আকাশ সংস্কৃতির যথেচ্ছ প্রচার এবং প্রযুক্তির লাগামহীন ব্যবহারের সুযোগ ভবিষ্যৎ তরুণ সমাজকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। এমনকি শিশু-কিশোরেরাও জড়িয়ে পড়ছে বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে এবং আমাদের ভবিষ্যৎ এক গন্তব্যহীন অনিশ্চয়তার অন্ধকার গহ্বরে নিমজ্জিত হতে যাচ্ছে। সেই সঙ্গে আমাদের নারী-শিশু, কিশোর-কিশোরী হচ্ছে ধর্ষণ, অপহরণ আর পাচারের মতো সব ভয়ংকর অপরাধের শিকার।

Prevention is better than cure অর্থাৎ প্রতিকারের চেয়ে প্রতিরোধ উত্তম—এই মূলনীতি মাথায় রেখে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে রক্ষা করা এবং নারী–শিশুকে সুরক্ষার যথাযথ পদক্ষেপ নেওয়া এখনই অত্যন্ত জরুরি হয়ে পড়েছে। আইন আইনের গতিতে চলবে কিন্তু আমাদের নারী-শিশুরা যাতে আত্মরক্ষামূলক ব্যবস্থা তাৎক্ষণিকভাবে নিজেরাই নিতে পারে, তার জন্য কারাতে শেখানোর মতো প্রতিষ্ঠান স্থাপন একান্ত আবশ্যক। ধর্ষণের শিকার হয়ে ধর্ষকের পরিচয় নিশ্চিত হওয়ার জন্য ডিএনএ ল্যাবের সংখ্যা বাড়ানোর চেয়ে কারাতে শেখানোর প্রতিষ্ঠান স্থাপন কম ব্যয়বহুল হবে, এতে সন্দেহের অবকাশ নেই।

শরীর জখম হলে সে জখম দেখা যায় এবং প্রতিষেধকের মাধ্যমে সেটা নিরাময়যোগ্য। কিন্তু ধর্ষণের শিকার ভুক্তভোগীর আঘাতপ্রাপ্ত মনের সুচিকিৎসার জন্য পর্যাপ্ত আধুনিক ও বিজ্ঞানসম্মত মানসিক চিকিৎসা ব্যবস্থা থাকা একান্ত প্রয়োজন। নয়তো এ ধরনের ভয়ংকর অপরাধের শিকার ভুক্তভোগী অনেক সময় সমাজ ও পরিবারের গ্লানি সহ্য করতে না পেরে বা লোকলজ্জার ভয়ে আত্মহননের মতো সর্বনাশা পথে পা বাড়ায়। ‌অথচ ধর্ষণের শিকার হওয়ার ক্ষেত্রে তার নিজের কোনো দায় নেই।

কথায় আছে ‘অলস মস্তিষ্ক শয়তানের কারখানা’। আমাদের তরুণসমাজের এখন অনেকটা সেই অবস্থা। তাদের আত্ম উন্নয়নের সব দ্বার রুদ্ধ! তাদের খেলার মাঠগুলো বেদখল হয়ে সেখানে দাঁড়িয়ে যাচ্ছে প্রভাবশালীদের বহুতলবিশিষ্ট সুরম্য অট্টালিকার সারি! তাদের অভিভাবকেরা জীবিকার প্রয়োজনে অথবা অর্থের নেশায় দিগ্‌বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে ছুটছে। সন্তান কোথায় যাচ্ছে, কার সঙ্গে মিশছে, রাতে ঘরে ফিরছে কি না, বা একা ঘরে অথবা বন্ধুদের সঙ্গে ইন্টারনেটে কী দেখছে, সেদিকে বিন্দুমাত্র নজর দেওয়ার সময় নেই তাদের। ফলে সর্বনাশ যা হওয়ার তা–ই হচ্ছে। এসব দায়িত্বজ্ঞানহীন অভিভাবকদের সন্তানেরা জড়িয়ে পড়ছে খুন, ধর্ষণ, মাদকের নেশার মতো বিপজ্জনক সব কর্মকাণ্ডে।

আমাদের আগামীর ভবিষ্যৎ তরুণসমাজকে বাঁচাতে হলে একদিকে তাদের শিক্ষার পাশাপাশি খেলাধুলা, সাংস্কৃতিক চর্চার সুযোগ বাড়ানো এবং সেই সঙ্গে সামাজিক উন্নয়নমূলক কাজে তাদের সম্পৃক্ত হতে উদ্বুদ্ধ করা জরুরি। গ্রাম বা শহরাঞ্চলের পাড়া-মহল্লার কিছু কিছু ক্লাব মাদক, জুয়াসহ অনৈতিক কর্মকাণ্ডের আখড়া হয়ে উঠেছে। এগুলোতে পুলিশের নজরদারি বাড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে স্থানীয় জনগণের সহযোগিতা গ্রহণ করলে সুফল পাওয়া যাবে নিশ্চয়ই। ধ্বংসপ্রাপ্ত মূল্যবোধের জায়গাটিতে মলম লাগানোর কাজটি করতে হবে পরিবার ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকেই।

কোনো শিক্ষক বা আইনশৃঙ্খলা রক্ষার কাজে নিয়োজিত ব্যক্তি অথবা দায়িত্বপূর্ণ ব্যক্তি যদি ধর্ষণ বা নারী-শিশুর সঙ্গে যৌন ‌অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট হয়ে পড়ে, তখন ওই সমাজের পচনটি দ্রুত হতে থাকে। এসব ক্ষেত্রে যত দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে, সমাজের পচনও তত দ্রুত রোধ করা সম্ভব হবে।

আমরা আশা করব, প্রশাসন সিলেটের এমসি কলেজ হোস্টেলের ধর্ষণের কুশীলবসহ সম্প্রতি ঘটে যাওয়া ধর্ষণগুলো এবং নোয়াখালীর বেগমগঞ্জে অসহায় নারীকে বিবস্ত্র করে ভিডিও ধারণ এবং তা ইন্টারনেটে ছড়িয়ে দেওয়ার মতো সীমাহীন স্পর্ধাধারীদের সংশোধিত নতুন আইনের আওতায় এনে দ্রুততম সময়ের মধ্যে তদন্ত সম্পন্ন করে বিচারের আওতায় এনে রায় কার্যকরের মাধ্যমে গণদাবির প্রতি সম্মান প্রদর্শন করবেন। এর ফলে একদিকে সরকারের প্রতি জনগণের আস্থা যেমন বাড়বে, ‌অন্যদিকে নতুন আইনের আওতায় দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির উদাহরণ সৃষ্টি হলে ঘৃণ্য অপরাধীরাও অপরাধ ঘটানোর আগে অন্তত একবার চিন্তা করবেন। সব নারী–শিশু নতুন আইনের প্রতি ভরসার জায়গা খুঁজে পেলেই এ নতুন আইনের সার্থকতা প্রমাণিত হবে, নতুবা অতীতের মতোই ‘বিচারের বাণী নীরবে নিভৃতে গুমরে কেঁদে মরবে’! সেই দুঃস্বপ্ন যেন আর ফিরে না আসে, আমরা সেই আশাতেই বুক বাঁধতে চাই।

  • আইনজীবী, জেলা ঢাকা জজকোর্ট এবং সদস্য, মহিলা আইনজীবি সমিতি, ঢাকা