তোমরা তো সবাই দিবানিশি

বুয়েট

নিজ নিজ গল্প রচনায় ব্যস্ত থাকো, তোমাদের মধ্যে কারও কারও আবার আত্মজীবনীমূলক বইও বের হয়! ভেবে দেখো তো একবার, মানুষের তো এই ষাট–সত্তর বছরের জীবন, আর আমার? সে কোন উনিশ শতকে আমায় বানিয়েছিলেন ব্রিটিশ রাজাধিরাজ, এরপর থেকে শুরু করে সময়ের প্রবহমানতায় কত কিছুর সাক্ষী আমি! কিন্তু আমার সে গল্প আজ অবধি কেউ লিখল না, কারও সময় হয়ে উঠল না।

তোমরা কি ভাবো, কথা বলতে পারি না বলে আমার গল্পেরা ছটফট করে না? আজ তবে আমি শোনাব তোমাদের আমার ভেতরে জমানো কথাগুলো।

পুরোনো কথা বলে তোমাদের কান ঝালাপালা করে দেওয়ার ইচ্ছে নেই আজ আমার, তোমাদের ব্যস্ত সময় তালিকার এক চিলতে অবসরকে রসহীনও করতে চাই না। কেননা ইতিহাস বলতে শুরু করলে কলম থামানো দুরূহই হবে বটে।

আজ আমি একা, বড্ড একা। এ মাস সাতেক আগেও আমার প্রাঙ্গণটা ছিল কৈশোর পেরোনো যৌবনে পদার্পণ করা কতগুলো ছেলেমেয়ের পদচারণের প্রাণকেন্দ্র। সকাল সাতটা–সোয়া সাতটা বাজলেই বুয়েট বাসগুলো দিয়ে একঝাঁক ছেলেমেয়ের আগমন ঘটত এ আঙিনায়। ক্যাফেটেরিয়ার ধোঁয়া ওঠা গরম চা হাতে ক্যাম্পাসে হেঁটে বেড়িয়ে নতুন সকাল দেখত তারা। এখানটার আরেক দল মানুষ হলো হলবাসীরা, যাদের বেশির ভাগই ক্লাস শুরুর মিনিট পনেরো আগে হল ক্যানটিন বা ক্যাফের দুটো পরোটা ভাজি মুখে পুরে দৌড়ে ক্লাসে যেত।

প্রতিটি ক্লাসেই এমন এক দল মানুষ ছিল যারা কিনা ঘুমে ঢুলতে ঢুলতে ক্লাসে এসে হাজির হতো, লাস্ট বেঞ্চের এক কোনায় শিক্ষকের চোখ ফাঁকি দিয়ে ঘুমানোর চেষ্টা করত। আবার আরেক দল ছিল সাংঘাতিক রকমের মনোযোগী আর পড়ুয়া। কলম কামড়ে স্যারদের সব কথা শুনত আর ঝড়ের বেগে নোট করে যেত।

তবে যে যেমনই ছিল, আমার এ বুয়েট ক্যাম্পাস ছিল তাদের সবার কলহাস্যে মুখর।
কিন্তু আজ; আজ আমার চারদিকে অন্তহীন নিস্তব্ধতা। কোভিড-১৯ নামক নভেল এক ভাইরাসের কারণে ছাত্রছাত্রীরা সব ক্লাসে যোগ দেবে না বলে সিদ্ধান্ত নিল, বাধ্য হয়ে কর্তৃপক্ষকেও বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ করতে হলো।

তারপর একদিন প্রাণঘাতী ভাইরাসের আক্রমণ ঘটেছিল টিচার্স কোয়ার্টারে। তখন থেকে আরও যেন থমকে গেল চির সাধের ক্যাম্পাস। একটা লোকের আনাগোনাও নেই। এখন আমার মাঝে সেকি ভয়ানক শূন্যতা! সকাল–বিকেল কাকপক্ষীর ডাকাডাকি ছাড়া আর কোনো শব্দের বাস নেই আমার মাঝারে। ভরদুপুরের নিঃসঙ্গতার ভার কত বেশি, তা কেবল আমিই জানি। শেষ কবে এমন একাকিত্বের রাজ্যে পা রাখতে হয়েছিল আমায়, মনে পড়ে না। ইদানীং অবশ্য ঢাকার বাসিন্দা দু–চারজন ছেলেমেয়ে আসে, তারা এদিক–ওদিক ঘুরে বেড়ায়, ছবিও তোলে কেউ কেউ। সেদিন একটা মেয়ে এল, সঙ্গে তার দুই বন্ধু। সাইকেল চালানো শেখাচ্ছে মেয়েটাকে বাকি দুজনে মিলে। আমার দেখতে ভালোই লাগে। তারা আমায় ভোলেনি।

মাস দেড়েক আগে থেকে হলগুলো খুলে দেওয়া হলো, তখন কিছু ছেলেমেয়ে এসে বইপত্তর নিয়ে গেল। শিক্ষক–শিক্ষিকারা প্রতিদিনই অবশ্য আসেন উপস্থিতির জন্য।
কিন্তু এখন তো আর রোজকার মতো র‍্যাগ কর্নার থেকে গানের সুর ভেসে আসে না।

হাফ ওয়ালে পা ঝুলিয়ে ছেলেমেয়েদের বসে থাকতে দেখি না। খেলার মাঠে ছাত্রদের দাপিয়ে বেড়ানো চোখে পড়ে না। কপোত–কপোতীদের হাতে হাত রেখে হাঁটতে দেখি না। আচ্ছা, একটা ঘটনা বলি। বেশ কয়েক দিন আগে শহীদ মিনার থেকে কয়েক পা এগোলে যে হাফ ওয়ালটা, ওখানে একটা মেয়ে বসে ছিল। আমি ভাবলাম, এ সময়ে এভাবে একটা মেয়ে কেন বসে আছে এভাবে? ঘণ্টাখানেক হয়ে গেল, সে একবার বসে, পায়চারি করে, মোবাইল টিপে, আবার সতর্ক হয়ে চারদিকে তাকায়ও। চোখ দেখে বুঝতে পারি, কিছুটা ভয়ও কাজ করছে তার মধ্যে। নির্জন পরিবেশে একা সে এসেছে ক্যাম্পাসে, আজকাল দেশের যা অবস্থা, ভয় পাওয়াটাও অস্বাভাবিক নয়। আমিও বেশ চিন্তিত। হঠাৎ মেয়েটা কাকে যেন ফোন করল, কথা শেষ করে ব্যাগ থেকে একটা গোলাপ বের করল। কিছুক্ষণ পর একটা ছেলে এল। বুঝলাম কপোত–কপোতী, এ ক্যাম্পাসে তাদের আগে কখনো একসঙ্গে দেখিনি, তাই বলছি আরকি! এরপর তারা ঘুরে বেড়াল এদিক–ওদিক অনেক্ষণ। বিকেলের দিকে মেয়েটাকে রিকশায় উঠিয়ে দিয়ে ছেলেটা চলে গেল গন্তব্যে।

মাঝেমধ্যে একদল ছেলেমেয়ে চার–পাঁচজন বন্ধুবান্ধব মিলে দেখতে আসে আমায়। তারা আমায় না দেখে থাকতে পারে না। এক সুবিশাল পূর্ণ আনন্দের বন্যা হয়ে যায় আমার মধ্যে।

আমি কথা বলি তোমাদের সবার সঙ্গে, এক সমুদ্র অনুভূতির জলে স্নান করে আমি প্রতিদিন তোমাদের স্বাগত জানাই। কিন্তু সৃষ্টিকর্তার ইচ্ছা, তাই তোমরা সে আওয়াজ শুনতে পাও না, এ নিয়ে কোনো আক্ষেপ নেই। অনেক তো বললাম কাজের–অকাজের অনেক কথা, এবার বিদায় নেওয়ার পালা।

আচ্ছা, মহামারি শেষে সবাইকে কি পাওয়া যাবে সুস্থ দেহ–মনে প্রাণের ক্যাম্পাসে? এ যেন এক উদ্দেশ্যহীন পথে চলছে যাত্রা। কবে দেখা মিলবে এর সমাপ্তিরেখা?

আমার তো প্রাণ নেই, কিন্তু প্রিয় ছাত্রছাত্রীরা, তোমরা কথা বললেই কথা বলতাম আমি। কবে তোমরা ফিরবে তোমাদের প্রিয় জায়গাটায়? কবে আমি তোমাদের কণ্ঠে কণ্ঠ মেলাব আবার? আমি অধীর অপেক্ষায় আছি।

* শিক্ষার্থী, পুরকৌশল বিভাগ, লেভেল-১, টার্ম-২, বুয়েট